খুলনার উপকূলীয় উপজেলা কয়রায় সুপেয় পানির চরম সংকট রয়েছে। চাহিদা মেটাতে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন দাতা সংস্থাও কাজ করছে। সম্প্রতি এলজি ইলেক্ট্রনিক্স বাংলাদেশ ব্রাঞ্চের অর্থায়নে ট্রাই ডিজিটালের পর্যবেক্ষণে ১০ গ্রামে ১০ টি গভীর নলকূপ স্থাপনের দায়িত্ব পান ইনিশিয়েটিভ ফর কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট (আইসিডি)। কিন্তু অনিয়মের কারণে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ভেস্তে যাচ্ছে।
নলকূপগুলো বিতরণে সুফলভোগীদের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে ১২ থেকে সাড়ে ১২ হাজার টাকা। এছাড়া ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় স্থাপন করার কথা বলা হলেও ৩টি বসানো হয়েছে একই গ্রামে ১০০ মিটারে দূরত্বের মধ্যে। বিশেষ সুবিধা নেয়ার বিনিময়ে বাড়ির অভ্যন্তরে পারিবারিকভাবে ব্যবহারের ন্যায় বসানোর ফলে প্রতিবেশি পরিবারগুলোও সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
শিমলার আইট গ্রামের সুফলভোগী মনিরুল ইসলাম বলেন, আমরা দিন আনি দিন খাই। ঘাটে মুটির কাজ করি। নলকূপ পেতে সমিতি থেকে টাকা তুলে স্থানীয় একজনের মাধ্যমে সাড়ে ১২ হাজার টাকা দিই। এছাড়া নিজেরা সম্পূর্ণ খরচ করে গোড়া পাকা করি। পরে জানতে পারি এলজি আমাদের ফ্রিতে নলকূপ দিয়েছে। যদি ফ্রি হয় তাহলে আমাদের কষ্টের টাকাগুলো ফেরত দেওয়ার অনুরোধ রইল।
একই গ্রামে পাশাপাশি বসবাসরত মোজাম মোড়লের ছেলে আক্তারুল ও লুৎফর রহমানের ছেলে আব্দুর রহমানকেও নলকূপ দেয়া হয়। তাদের থেকেও সাড়ে ১২ হাজার টাকা নেয়া হয় ও গোড়া তারা নিজেরা পাকা করে নেয় বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়।
আরেক উপকারভোগী শিক্ষক আজিজুল হক জানান, আশিকের কাছে সাড়ে ১২ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। একমাস আগে নলকূপ বসানো হয়েছে। পানি ভালো হয়নি। এখনও গোড়া পাকা করা হয়নি।
উপকারভোগী ২নং কয়রা গ্রামের আয়ুব শেখের স্ত্রী জানান, নলকূপের পানি ভালো হয়েছে। সাড়ে ১২ হাজার টাকা দিয়ে নলকূপটি নেন তিনি। আইসিডি ১৭০ পিস ইট দিয়ে গোড়া পাকা করে দিতে গেলে নিচু হয়ে যাওয়ায় তারা নিজেরা অতিরিক্ত কিছু খরচ দিয়ে উচু করে নেয়।
২ নং কয়রার সুবাসী দাসী বলেন, আশিক ভাইয়া আমার পরিচিত। গোড়া পাকা নিজেদের করে নিতে হবে এই শর্তে নলকূপ দেয়া হয়। এজন্য পাকা করতে আমরা তার কাছে ১২ হাজারের মত টাকা দেই। তিনি (আশিক) ৩শ’ ইট দিয়ে গোড়া পাকা করে দেন। তবে কথাগুলো বলার সময় তিনি একপর্যায়ে বলেন, আমরা নিজেরা মিস্ত্রী ধরে পাকা করেছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সুফলভোগী বলেন, গণমাধ্যম কর্মীদের মাধ্যমে বিনামূল্যের বিষয়টি জানাজানি হলে তাদেরকে নানা কথা বলে প্রথমে টাকা দেয়ার কথা কারো সাথে বলতে নিষেধ করা হয়। একপর্যায়ে টাকার বিষয়টি ধামাচাপা দিতে ব্যর্থ হয়ে পুনরায় তাদেরকে গোড়া পাকা করার জন্য টাকা দিয়েছে এটা বলতে বলা হয়।
জয়পুর শিমলারআইট সবুজ সংঘের সাধারণ সম্পাদক মোঃ ইনসান আলী এলজির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, আমাদের এলাকায় সুপেয় পানির অভাব দীর্ঘকালের। এলজিসহ যেসব দাতা সংস্থা সুপেয় পানির সমস্যা মেটাতে সহায়তা করছে নিঃসন্দেহে খুবই ভালো কাজ। তবে পরবর্তীতে নলকূপ দিলে সেটা উন্মুক্ত স্থানে বসানোর জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে বিনীত অনুরোধ রইল। তাছাড়া গোড়া পাকার জটিলতায় যথাযথ উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না, সেকারণে পরবর্তীতে গোড়া পাকাসহ প্রকল্প গ্রহণের অনুরোধ রইল। তিনি আরও জানান, তাদের এলাকায় ৪৩০/৪৫০ ফুট নিচের লেয়ারে ভাল পানি পাওয়া যায় এবং ৩০ হাজার টাকার মধ্যে গোড়া পাকাসহ গভীর নলকূপ বসানো সম্ভব।
এ ঘটনার ৩/৪ মাস আগে জয়পুর-শিমলারআইট এলাকায় তিনটি নলকূপ দেওয়া হয়। তখন গোড়া পাকা ছাড়া শুধু নলকূপ স্থাপনের জন্য ১২ হাজার টাকা করে নেয়া হয়। গোড়া পাকা সুফলভোগীদের করে নিতে হয়েছে। তবে দাতা সংস্থার প্রতিনিধি পরিদর্শনের সময় বিনামূল্যের বিষয়টি সুফলভোগীরা জানতে পারায় টাকা ফেরত নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে তাদেরকে ৭ হাজার টাকা ফেরত দেয়া হয়। ওই তিনটি নলকূপের বরাদ্দসহ বিস্তারিত তথ্য চাইলে আজও দেননি আইসিডি’র প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আশিকুজ্জামান। তবে একটি সূত্রে জানা যায় ‘আর আর’ নামের একটি সংস্থা থেকে বিনামূল্যে দেয়া হয়।
অভিযোগের বিষয়ে আইসিডি’র প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আশিকুজ্জামান বলেন, আমরা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এলজিসহ নানা সংস্থা থেকে নলকূপ এনে কয়রার সাধারণ মানুষের উপকার করি। নলকূপের গোড়া পাকা করার জন্য কোন টাকা বরাদ্দ থাকে না। এজন্য বাঁধাইসহ খরচের জন্য কিছু টাকা নেই। আমরা সামান্য কিছু রেখে কয়েকজনকে ৭ হাজার টাকা ফেরত দিয়েছি। আর কয়েকজনকে গোড়া পাকা করে দিয়েছি।
এজেন্সি প্রতিষ্ঠান ট্রাই ডিজিটাল টেকনোলজি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক মইনুল ইসলাম খাঁন বলেন, নলকূপগুলো বিতরণে কোন অর্থ নেওয়ার সুযোগ নেই। অভিযোগগুলোর সত্যতা যাচাই করে দেখার পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ১০টি টিউবওয়েল বাবদ বরাদ্দের কথা জানতে চাইলে তিনি অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের পরে বাকী তথ্য শেয়ার করবেন বলে জানান।
এলজি ইলেক্ট্রনিক্স, বাংলাদেশ ব্রাঞ্চের একাউন্টিং এন্ড ট্যাক্স কর্মকর্তা রেহানুদ্দিন বলেন, আমাদের হেড অফিসের নির্দেশনায় এজেন্সির মাধ্যমে এ কাজগুলো করা হয়। এটা মূলত ডোনেশন প্রক্রিয়া ছিল। ওখানে ১০টি টিউবওয়েল সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেয়া হয়েছে। সুফলভোগী সিলেক্ট করেছেন আমাদের অ্যাম্বাসিডর। কিভাবে কি করবে এ বিষয়ে আমাদের এজেন্সির সাথে অ্যাম্বাসেডরদের কন্ট্রাক হয়। তিনি আরও জানান, সুফলভোগী যদি বাসার মধ্যে রেখে দেয় তাহলে অন্যরা পাবে না। এজন্য এমন একটি স্থানে বসাতে হবে যেখান থেকে সাধারণ মানুষ সব সময় পানি নিতে পারবে। বাড়ির ভিতরে স্থাপন করা যাবে না।