বিনোদন ডেস্কঃসময় ২০০৯ সালের ৪ এপ্রিল। লন্ডনের বিখ্যাত কনসার্ট হল ‘ওটু এরেনা’ থৈ থৈ করছে সহস্র অপেক্ষমান ভক্তের কলকাকলিতে। সবাই যার জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি ‘কিং অফ পপ’। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর অবশেষে মহাতারকা দেখা দিলেন। কালো রঙা গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পী ‘মাইকেল জ্যাকসন’।
মাইক্রোফোনের সামনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চারপাশের ভক্তদের উল্লাস উপভোগ করলেন তিনি। তারপর লাজুক কণ্ঠে সবার উদ্দেশে বললেন, ‘আই লাভ ইউ’। ভক্তকুলের উচ্ছ্বাস যেন থামছেই না। আর থামবেই বা কেন? ১৯৯৭ সালে বিরতিতে যাওয়ার পর ৮ বছরের দীর্ঘ নিঃসঙ্গ-নির্বাসিত জীবনের ইতি টেনে মঞ্চে ফিরেছেন প্রিয় শিল্পী।
সেদিন মাইকেল ঘোষণা দিলেন, যুক্তরাজ্যের মাটিতে শেষবারের মতো পারফর্ম করতে যাচ্ছেন তিনি। কনসার্ট ট্যুরের নাম ‘দিস ইজ ইট’। বিদায় নেবার সময় প্রিয় ভক্তদের বলে গেলেন মাইকেল, আবার দেখা হবে! কিন্তু কোনো ভক্ত কল্পনাও করতে পারেনি পপ জগতের এই সম্রাট আর কখনো মঞ্চ কাঁপাতে হাজির হবেন না।
২০০৯ সালের ২৫ জুন, থেমে যায় মাইকেল জোসেফ জ্যাকসনের জীবন তরী। নাচ, গান আর মিউজিক ভিডিওর আবেদন- এই তিনটি গুণেই ভরপুর ছিলেন মাইকেল। তাকে ভালোবাসার জন্য এই কারণগুলোই যথেষ্ট ছিল।
মাইকেলের শৈশব-
১৯৫৮ সালের ২৯ আগস্ট ইন্ডিয়ানার গ্যারিতে এক বর্ধিষ্ণু কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারে মাইকেল জ্যাকসনের জন্ম। দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারটির কর্তা ও মাইকেলের বাবা জোসেফ ওয়াল্টার জ্যাকসন তার ছেলেদের সঙ্গীত প্রতিভা নিয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন। ছেলেদের দিয়ে গানের দল বানিয়ে আয়ের পথও বের করে ফেলেন তিনি। পাঁচ ভাইকে নিয়ে গড়া সেই ব্যান্ডের নাম ‘জ্যাকসন ফাইভ’, যে দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন মাইকেল।
ধীরে ধীরে ‘জ্যাকসন ফাইভ’ জনপ্রিয়তা পাচ্ছিল। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া মাইকেল আলোচনায় আসেন এই ব্যান্ডের কারণেই। বড় ভাইদের সাথে মঞ্চে তার সরব উপস্থিতি দর্শকদের অভিভূত করে। তখন হয়তো কেউ ভাবতে পারেনি এই বিস্ময় বালকই একদিন সঙ্গীতের জগতে রাজত্ব করবেন।
সর্বোচ্চ বিক্রিত অ্যালবাম ‘থ্রিলার’-
১৯৮২ সালে মাইকেল ফিরে আসে নতুন অ্যালবাম ‘থ্রিলার’ নিয়ে। পৃথিবীর ইতিহাসে এই অ্যালবাম এখন অব্দি সর্বোচ্চ বিক্রিত গানের অ্যালবাম। এই অ্যালবাম সঙ্গীতের ইতিহাসে অনন্য সাধারণ এক মাত্রা যোগ করে।
মোট ১২টি গ্র্যামি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়ে ৮টিই জিতে নেয় এই মাস্টারপিস। থ্রিলারের সবগুলো গানই জনপ্রিয় হয়েছিল, কিন্তু আলাদা করে টাইটেল ট্র্যাক ‘থ্রিলার’-এর কথা না বললেই নয়। জন ল্যান্ডিসের পরিচালনায় নির্মিত হয় থ্রিলারের ১৪ মিনিটের মিউজিক ভিডিও। হরর সিনেমার মতো ভিডিওতে জম্বির সাজে হাজির হন খোদ মাইকেল, তার মোহনীয় নাচের ভঙ্গি আর কণ্ঠের জাদুতে থ্রিলার আমেরিকায় তোলপাড় ফেলে দেয়।
একের পর এক অসাধারণ কাজের মাধ্যমে দর্শকের মনে জায়গা করে নেন মাইকেল। নাচে-গানে বিমোহিত করেন দর্শক-শ্রোতাদের। মাইকেল পান তার উপাধি ‘কিং অফ পপ’।
মাইকেলের বিবাহিত জীবন-
১৯৯৪ সালে এলভিস তনয়া লিসা মেরি প্রিসলিকে বিয়ে করেন মাইকেল। নিজের আইডলের মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করলেও মাত্র দুবছর সংসার করেছিলেন তারা। ১৯৯৬ সালে মাইকেল বিয়ে করেন ডেবি রোও নাম্নী এক নার্সকে। এই দম্পতির ঘরে জন্ম নেয় মাইকেলের দুই সন্তান প্রিন্স জ্যাকসন আর প্যারিস জ্যাকসন। ডেবি রোও-এর সাথেও খুব বেশি দিন সংসার করা হয়নি মাইকেলের, ১৯৯৯ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
মাইকেলের বর্ণালী জীবন-
ব্যক্তিজীবনে মাইকেল ছিলেন অত্যন্ত লাজুক ও প্রচারবিমুখ, খুব প্রয়োজন না হলে তিনি ক্যামেরার সামনে সাক্ষাৎকার দিতেন না। মাইকেল মেক্সিকান খাবার ভালোবাসতেন, সময় পেলেই বই পড়তেন। পোষা প্রাণীর বাতিক ছিল তার। শিম্পাঞ্জী বা অজগর- সবই ছিল তার পোষ্য।
মিউজিক ভিডিও নিয়ে মাইকেলের খুঁতখুঁতে স্বভাব ছিল। সবসময় চাইতেন নিজের সেরাটা দিতে। তার বোন জ্যানেট জ্যাকসনকে নিয়ে বানিয়েছিলেন সর্বকালের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মিউজিক ভিডিও ‘স্ক্রিম’। ৭ মিলিয়ন ডলার বাজেটের ভিডিওটি সম্পূর্ণ সাদাকালো।
বাংলাদেশ ও মাইকেল-
বাংলাদেশের সাথে মাইকেলের সরাসরি যোগসূত্র না থাকলেও এক সময় বাংলা সংস্কৃতিতে বেশ জোরালো জায়গা করে নেয় মাইকেলের পপ গান। কেউ কেউ বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে নিলেও অনেকেই নেতিবাচকভাবে গ্রহণ করেন বিষয়টি। ১৯৮৬ সালে ‘ঢাকা ৮৬’ সিনেমাতে মাইকেলের পপ সঙ্গীতকে ব্যঙ্গ করে একটি গান গেয়েছিলেন শিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী। গানটির লাইনগুলো ছিল- “আউল বাউল লালনের দেশে, মাইকেল জ্যাকসন আইলো রে… সবার মাথা খাইলো রে… আমার সাধের একতারা কান্দে রে..”
ব্যঙ্গ করে গাওয়া হলেও এই গানটি সে সময় ভীষণ জনপ্রিয় হয়। এমনকি এই গানের জন্যই সৈয়দ আবদুল হাদী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
মাইকেলের প্রয়াণ-
মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন পপ জগতের এই সম্রাট। পঞ্চাশ বছর বয়সী মাইকেলের মৃত্যুর খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সংবাদমাধ্যমে। কেউ যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। সবাই একসঙ্গে ব্রাউজ করায় ওয়েবট্রাফিকে পড়ে অস্বাভাবিক চাপ। অপ্রত্যাশিত এত ব্যবহারকারী দেখে গুগল ধরেই নেয় তাদের সার্চ ইঞ্জিনে কেউ হামলা করেছে!
ইনস্ট্যান্ট মেসেঞ্জার, ইউটিউব, উইকিপিডিয়াসহ অনেক জনপ্রিয় ওয়েবসাইটের সার্ভার ক্র্যাশ করে। প্রতি মিনিটে ছয় হাজারের বেশি টুইটের চাপ নিতে পারেনি সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট টুইটার। ৪০ মিনিট ওয়েবসাইটটি ছিল ক্র্যাশড অবস্থায়।
মাইকেলের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে গোটা বিশ্বে। তার প্রিয় সহকর্মী আর বন্ধুরা ব্যথিত হৃদয়ে বিদায় জানান মাইকেলকে। মাইকেল জ্যাকসনের মতো মহান শিল্পীর আসলেই মৃত্যু নেই। তিনি যুগ-যুগ বেঁচে থাকবেন তার শুভাকাঙ্ক্ষী