বিশ্বব্যাপী পরিচিত আল জাজিরা স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলটি বাংলাদেশ বিষয়ে “All Are Prime Minister Sheikh Hasina’s Men” শিরোনামে চরম আপত্তিকর,বহুলাংশে অসত্য এবং সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত যে একপেশে ডকুমেন্টারি প্রকাশ করেছে তার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।পাশাপাশি দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে দেশ ও সরকারের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিতর্কিত কিছু মানুষের সহায়তায় আল জাজিরার মত স্বনামধন্য টিভি চ্যানেলটি ডকুমেন্টারির নামে যে ডকুড্রামা প্রযোজনা করেছে সে সম্পর্কে আমার মূল্যায়নটি তুলে ধরার তাগিদ অনুভব করছি।
একটি হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ঢাকার মোহাম্মদপুরের “আহমেদ পরিবারকে” বিভিন্ন তথ্য ও ভিডিও এবং বাংলাদেশবিরোধী কিছু বিতর্কিত মানুষের বক্তব্যকে সংযোজন করে “মাফিয়া পরিবার” হিসেবে দেখানোে হয়েছে আল জাজিরার প্রতিবেদনে।একইসাথে তাদেরকে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার লোক হিসেবে ডকুমেন্টারিতে উপস্থাপন করা হয়েছে।যাদেরকে বাংলাদেশের “মাফিয়া চক্র” এবং “শেখ হাসিনার লোক” হিসেবে দেখানো হয়েছে শেখ হাসিনা রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে ১৯৯৯ সালে বিচারিক আদালত একটি হত্যা মামলায় তাদের মৃত্যুদন্ড ও যাবজ্জীবন শাস্তির রায় দেন।নিম্ন আদালতে ফাঁসির দন্ড পাওয়া বহুল আলোচিত জোসেফের এই মামলায় হাইকোর্ট ফাঁসির দন্ড বহাল রাখলেও ২০০৯ সালে আপিল বিভাগে সাজা বাতিলের জন্য আবেদনের প্রেক্ষিতে দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তার দন্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।প্রায় দেড় যুগ জেল খাটার পর মহামান্য রাষ্ট্রপতি বরাবর ২০১৬ সালের জুন মাসে তার মায়ের করা সাজা মওকুফের আবেদনের প্রেক্ষিতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের ৪০২ ধারায় তার সাজা মানবিক বিবেচনায় মওকুফ করলে ২০১৮ সালের ২৭ শে মে প্রায় ২০ বছর জেল খাটার পর তিনি ছাড়া পান এবং চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যান। জোসেফের ২০ বছরের কারাজীবনের ১২-১৩ বছরই কেটেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রথম তিন মেয়াদে। ডকুমেন্টারিতে তাদেরকে “প্রধানমন্ত্রীর লোক” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর লোক অথচ প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার তিন মেয়াদ তাকে কারান্তরীণ থাকতে হয়েছে! আল জাজিরার এই অযৌক্তিক দাবি কি ধোপে টেকে? হারিছ ও আনিস প্রধানমন্ত্রীর টানা ১২ বছরের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মেয়াদের পুরো সময় বিদেশে পলাতক এমনকি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন প্রথম সরকারের সময়ও তারা বিদেশে পলাতক ছিলেন।প্রধানমন্ত্রীর লোক হলে তো তাদেরকে বিদেশ থেকে দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তি মওকুফ করার কথা।কিংবা হারিছ ও আনিসের বিদেশ থেকে দেশে এসে আদালতে আত্মসমর্পণ করার কথা।প্রধানমন্ত্রী তাদের লোক হলে তো তারা দেশে ফিরে আসার সাহস দেখাতেন।কিন্তু কোনটিই ঘটেনি যেমনটি জোড়া খুনের আসামি সুইডেনে পলাতক সুইডেন বিএনপির সভাপতি মহিউদ্দিন জিন্টুর ক্ষেত্রে ঘটেছিল। ৮০’র দশকের জোড়া খুনের আসামি মহিউদ্দিন জিন্টু বিদেশে ২২ বছর পলাতক থাকার পর ২০০৫ সালে দেশে ফিরে আদালতে আত্মসমর্পণের মাত্র ১০ দিনের মাথায় ২০০৫ সালের ১৩ ই জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্ত হয়ে আবার সুইডেনে পাড়ি জমান।আবার হারিছ,আনিস কিংবা জোসেফ কে তো হাঙ্গেরি,মালয়েশিয়া কিংবা ভারত আওয়ামীলীগের সভাপতিও বানানো হয়নি।তাহলে কিভাবে তারা প্রধানমন্ত্রীর লোক হলেন?
জোসেফ,হারিছ,আনিসের আরেক ভাই সাঈদ আহমেদ টিপু যিনি ৮৯ সালে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন,তাকেও ডকুমেন্টারিতে মাফিয়া হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।অথচ যারা তাকে খুন করেছে খুনীর দল ফ্রিডম পার্টির সে সব খুনি সদস্যকে শেখ হাসিনার “প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক শক্তি” হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে! এই একটি ঘটনাতেই তো স্পষ্ট যে আল জাজিরার ডকুমেন্টারিটি বস্তুনিষ্ঠ বিবর্জিত পুরোপুরি পক্ষপাতদুষ্ট একটি একপেশে প্রতিবেদন।মোহাম্মদপুরে ৯০’র দশকে যুবলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকা হারিছের শেখ হাসিনার একটি জনসভা মঞ্চে উপস্থিতির ছবি দেখিয়ে তাকে শেখ হাসিনার দেহরক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে কথিত ডকুমেন্টারিতে।অথচ বাস্তবতা হচ্ছে হারিছ কখনই শেখ হাসিনার দেহরক্ষী ছিলেন না।এই দাবির পক্ষে প্রতিবেদনে কোন তথ্য প্রমাণাদিও দেখানো হয়নি।এভাবে মনগড়া ডকুমেন্টারি নির্মাণের মাধ্যমে চ্যানেলটি তার নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।ডকুমেন্টারিতে বাংলাদেশের শত্রু রাষ্ট্র ইসরায়েল থেকে ওয়াইফাই,সেলুলার ও ভিডিও নজরদারি করার যন্ত্র “স্পাই ওয়্যার” কেনার যে বায়বীয় অভিযোগ ভিডিও চিত্রে করা হয়েছে সেখানে কোথাও কোনো ডকুমেন্টারি ইভেন্টে ইসরায়েল থেকে স্পাই ওয়্যার কেনার কোন তথ্য প্রমাণাদি দেখাতে পারেনি।বরং ক্রয় সংক্রান্ত ডকুমেন্ট পেপারে হাঙ্গেরি থেকে কেনা হয়েছে মর্মে ভিডিওতেই দেখানো হচ্ছে।তাদের ডকুমেন্টারি অনুসারে দেখা যাচ্ছে স্পাই ওয়্যার হাঙ্গেরি থেকে কেনা হয়েছে অথচ তারা দাবি করছে ইসরায়েল থেকে কেনা হয়েছে।সুতরাং তাদের ডকুমেন্টারি কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? আল জাজিরার প্রতিবেদনে “স্পাই ওয়্যার” ব্যবহার করে নজরদারী করাকে “মানবাধিকারের লঙ্ঘন” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।অথচ তারা সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ কর্তৃক বিমানে বসে ভাই হারিছ আহমেদ ওরফে হাসান হাঙ্গেরি কে মোবাইল ফোনে পাঠানো বার্তা কিংবা সেনা প্রধান ও তার ভাই হারিছের বিভিন্ন ফোন কল রেকর্ডিং ধারন করে যে ডকুমেন্টারি তৈরি করা হয়েছে সেখানে “নজরদারী” যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে বলে সহজেই অনুমেয়।তাহলে এক্ষেত্রে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হয়েছে কিনা আল জাজিরা কর্তৃপক্ষের কাছে সেই প্রশ্ন রাখলাম।সেনাপ্রধানের ছেলের বিয়েতে সেনাপ্রধান সহ পরিবারের সদস্যদের আনন্দ উদযাপনের যে ভিডিও চিত্র ডকুমেন্টারিতে প্রকাশ করা হয়েছে সেটি কতটুকু আইনসিদ্ধ? এর মাধ্যমে কি সেনাপ্রধানের ব্যক্তি গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হয়নি?
১৯৯৬ সালের ৭ ই মে ফ্রীডম পার্টির গুলিবিদ্ধ সন্ত্রাসী মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর আগে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া একটি জবানবন্দি আল-জাজিরার প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। ভিডিও চিত্রে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুলিখনে মোস্তফার বয়ান হল- “হারিস আমাকে তাঁর লাইসেন্স করা বন্দুক দিয়ে প্রথমে গুলি করে।হারিসের পর জোসেফ আমার কোমর থেকে পিস্তল নিয়ে আমার পেটে গুলি করে।” অর্থাৎ মোস্তফা নিজেও অস্ত্রধারী ছিল সেটি তার জবানবন্দিতে স্পষ্ট।শুধু তাই নয়, ১৯৮৯ সালের ১০ ই আগষ্ট মধ্যরাতে ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনে ফ্রিডম পার্টির কাজল,কবির ও সোহেলের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে যে গ্রেনেড হামলা ও গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল তার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ছিলেন এই মোস্তফা।সন্ত্রাসী মোস্তফা একাধিক চাঁদাবাজি মামলার ও আসামি ছিল।অথচ অত্যন্ত সুকৌশলে প্রতিবেদনে এই বিষয়গুলো এড়িয়ে গিয়ে সন্ত্রাসী মোস্তফাকে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে! প্রতিবেদনের এই অংশটি চরম আপত্তিকর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।মোস্তফা জবানবন্দিতে আরও বলেছেন, হারিস এবং জোসেফ ছাড়া অন্যরা তাকে ‘র্যান্ডমলি’ গুলি করেছে। তাকে নয়টি গুলি করা হয়েছে বলে মোস্তফা তাঁর জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন।একজন গুলিবিদ্ধ মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির পক্ষে নিজের দেহে কয়টা গুলি লেগেছিল তা গুনে গুনে বলা কি আদৌ সম্ভব?এটি কি আসলেই বাস্তবসম্মত? প্রতিবেদনে সেনাপ্রধানের সাথে তাঁর প্রবাসী পলাতক ভাইদের যোগাযোগ রাখা এবং সেনাপ্রধানের ছেলের বিয়েতে তাদের উপস্থিত থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে।আল-জাজিরা এই তথ্য দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছে সেনাপ্রধানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাফিয়াদের যোগাযোগ আছে। হারিস বা তাঁর অন্য কোনো ভাই কি আসলেই আন্তর্জাতিক মাফিয়া? ৯৬ সালের একটি হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়া ছাড়া বিগত প্রায় দুই যুগ বিদেশে অবস্থানকালে কি তারা কোন হত্যা,চোরাকারবারি অথবা অন্য কোন অপরাধের সাথে যুক্ত ছিল? এধরনের কোন তথ্য বা প্রমাণাদি তো ডকুমেন্টারিতে উপস্থাপন করতে পারেনি আল জাজিরা কর্তৃপক্ষ।তাহলে কিভাবে তাদেরকে আন্তর্জাতিক মাফিয়াচক্র বলা হল? ভাই আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী হলেও তাকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা,কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা কিংবা তাকে ভাল রাখার চেষ্টা করা কি আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ? তবে সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামির বিয়ের অনুষ্ঠানে দেশে আসার বিষয়টি কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য নয়।এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাফিলতির বিষয়টি খতিয়ে দেখা যেতে পারে।তবে পাসপোর্টে নিজের নাম পরিবর্তন করায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য তাদের ধরাটা অতটা সহজ ছিল না বলেই স্বাভাবিকভাবে প্রতীয়মান হয়।
সেনাপ্রধানের ভাই পলাতক হারিছ আহমেদের সাথে ডিজিএফআই কর্মকর্তার ফোনকলের যে ভিডিওচিত্রটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সেখানে এক প্রান্তে হারিছকে দেখানো হলেও অপর প্রান্তে ডিজিএফআইয়ের কোন কর্মকর্তাকে দেখাতে পারেনি আল জাজিরা কর্তৃপক্ষ।এমনকি ফোনকলে হারিছের কথা শোনা গেলেও অপর প্রান্ত থেকে ডিজিএফআইয়ের কোন কর্মকর্তার কন্ঠস্বর শোনা যায়নি।সুতরাং ডিজিএফআই কর্মকর্তাকে অনৈতিক সুবিধা আদায় করতে ফোন করার বিষয়টি কতটুকু সত্য? তিনি কি আসলেই ডিজিএফআই কর্মকর্তার সাথে কথা বলছিলেন নাকি অন্য কারো সাথে সে বিষয়টি কি আদৌ পরিষ্কার হয়েছে ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে? এ ধরনের বায়বীয় অভিযোগ কি আদৌ গ্রহনযোগ্য? বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তা স্পাই ওয়্যার ব্যবহার করে ওয়াইফাই,সেলুলার এবং ভিডিও নজরদারী কিভাবে করতে হয় এ বিষয়ে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থার দু’জন বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তার কাছ থেকে বিদেশে বসে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এ ধরণের একটি তথ্য-উপাত্তহীন মনগড়া অভিযোগ করা হয়েছে ডকুমেন্টারিতে।কিন্তু অভিযোগের স্বপক্ষে ন্যূনতম কোন প্রমাণপত্র হাজির করতে পারেনি চ্যানেলটি।সুতরাং এ ধরনের অভিযোগ কি পরিকল্পিতভাবে আমাদের সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার অপপ্রয়াস নয়? আল জাজিরার এই বিতর্কিত,ভিত্তিহীন এবং কাল্পনিক ডকুমেন্টারির নামে ডকুড্রামা নির্মাণের সাথে জড়িতদের খুঁজে বের করে এদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।
মোঃ নজরুল ইসলাম,তরুণ আওয়ামীলীগ নেতা।