দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৭৯ শতাংশ নলকূপে অতিমাত্রায় আর্সেনিক
সাতক্ষীরা প্রতিনিধিঃদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৭৯ শতাংশ নলকূপে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক রয়েছে যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এছাড়া পদ্মা প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্নতা ও ব্যাপকভাবে লোনা পানির চিংড়ি চাষের দরুণ এলাকায় লবণাক্ততার তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো সুপেয় পানির সংকট। এ অঞ্চলের ৬০ লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে প্রায় ৫০ লক্ষ এ সমস্যায় আক্রান্ত। ক্রমেই এ সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে, যার কারনে জীবন-জীবিকায় ও বসবাসে মারাত্মক ধরনের সংকট সৃষ্টি হচ্ছে।
গতকাল সোমবার সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের কনফারেন্স রুমে “নারী ও প্রতিবন্ধীদের ওয়াশ অধিকার, সুপেয় পানি ও স্যানিটেশনে বাজেট বরাদ্দ” বিষয়ক এক সংবাদ সম্মেলনে উত্তরণ পরিচালিত এক গবেষণা রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে এতথ্য জানান কেন্দ্রীয় পানি কমিটির নেতৃবৃন্দ। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান কেন্দ্রীয় পানি কমিটির সভাপতি এবিএম শফিকুল ইসলাম। এ সময় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন উত্তরণ পরিচালক শহিদুল ইসলাম, পানি কমিটির মইনুল ইসলাম ও অধ্যক্ষ আশেক ই এলাহি।
নেতৃবৃন্দ বলেন, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের উপকূলীয় অঞ্চল সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট দুর্যোগপ্রবণ অতি ঝুঁকিপূর্ণ জেলা। উপকূলের এই তিন জেলায় প্রায় ৫০ লাখ মানুষ খাবার পানি সংকটে ভুগছে। এ এলাকার ৭৯ শতাংশ নলকূপে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের প্রভাব রয়েছে। অপরদিকে গভীর নলকূপেও রয়েছে লবণাক্ততা ও আর্সেনিক। স্বাস্থ্যের জন্য এই পানি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। সুপেয় পানি সংকটের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগকালীন সময়ে ও পরবর্তীতে এ এলাকার স্যানিটেশন ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।
তারা আরো বলেন, এ এলাকাটি ব-দ্বীপের নিম্নাংশ হওয়ায় সুক্ষè দানার পলিদ্বারা এর ভূমি গঠিত হয়েছে। এখানকার অধিকাংশ স্থানে ভূগর্ভের প্রায় ১২শ’ ফুটের মধ্যে পানির স্তর বা জলাধার পাওয়া যায় না। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের মাধ্যমে গভীর নলকূপ খনন করে পািন সংকট নিরসনের চেষ্টা করলেও বাস্তবে তাতে চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। এ জন্য এখনও গ্রামের নারীদের প্রতিদিন ভোরে ও বিকেলে ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে ২/৩ শ্রম ঘন্টা ব্যয় করে কলসীতে করে পানি নিয়ে আসতে হয়। এই সংকট দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ এলাকায় যেসব পুকুর ছিল তা একদিকে যেমন ভরাট হয়ে যাচ্ছে তেমনি লোনা পানির চিংড়ি চাষ প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মিষ্টি পানি মিলছে না।
বিশ^ ব্যাংকের রিপোর্ট তুলে ধরে তারা আরও বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে দারিদ্র্য হার ২১.৬ শতাংশ। অথচ সাতক্ষীরা জেলায় দারিদ্র্যের হার ৪৬ শতাংশ। তাদের পক্ষে পািন কিনে খাওয়া সম্ভব না হওয়ায় তারা আয়রণ, লবণ ও আর্সেনিকযুক্ত পানি খেয়ে নানা রোগের মুখে পড়ছেন। একইভাবে দুর্যোগে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত ল্যাট্রিন পুনঃনির্মাণ বা সংস্কার করার মতো আর্থিক সঙ্গতিও নেই। এসব কারণে তারা চর্মরোগ, পেটের পীড়া, আমাশয়, জ¦র, ডায়রিয়া, জন্ডিসসহ নানা রোগের কবলে পড়ে। সংকটের কারণে শুধু খাবার পানি নয়, গৃহস্থালি কাজেও তারা লবণাক্ত ও দূষিত পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। এ এলাকায় সুপেয় পানি এবং ল্যাট্রিন সরবরাহ সহজলভ্য করলে তা দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক হবে।
তারা আরও বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকার ভূমি গঠন ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনায় না নিয়ে সরকার দেশের অন্যান্য এলাকার মতো এই অঞ্চলে এখানেও গভীর ও অগভীর নলকূপ নির্ভর প্রযুক্তি ব্যহার করছে। কোনো প্রকার হাইড্রলজিক্যাল জরিপ ছাড়াই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করায় মানুষ তা থেকে কোন উপকার পচ্ছে না।
সংবাদ সম্মেলনে চার দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এগুলি হচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ পানির অবস্থান নিয়ে হাইড্রলজিক্যাল অনুসন্ধান পরিচালনা, পুকুর, দীঘি খনন করে দূষণমুক্ত জলাধার সৃষ্টি করা, দরিদ্র, প্রতিবন্ধী, দলিত ও নারীদের জন্য সরকারের বিশেষ বরাদ্দ, সুপেয় পানির জন্য এ এলাকায় প্রযোজ্য নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা।