সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় আসামি ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ৭ আসামিকে শুক্রবার (৭ আগস্ট) রাত পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিজেদের হেফাজতে নিতে পারেনি র্যাব। কক্সবাজার কারা কর্তৃপক্ষ বলেছে, আদালতের আদেশ তাদের কাছে না পৌঁছানোয় তারা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এদিকে ওসি প্রদীপসহ টেকনাফ থানার ৭ পুলিশ সদস্যকে শুক্রবার বরখাস্ত করা হয়েছে।
কক্সবাজারের আদালত বৃহস্পতিবার আত্মসমর্পণ করা ৭ আসামিকে ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হলেও সবাই বর্তমানে কক্সবাজার জেলা কারাগারে আছেন। বৃহস্পতিবার রাতে আদালতের কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর রাত ১০টার দিকে সাত আসামিকে কক্সবাজার কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
এদিকে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, আত্মসমর্পণ করা সাত আসামিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এর আগে মামলা হওয়ার পর তাদের দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল।
র্যাব-১৫ এর উপ-অধিনায়ক মেজর মেহেদী হাসান বলেন, ‘আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। জিজ্ঞাসাদের জন্য প্রক্রিয়া শুরু করেছে র্যাব। তবে, কাউকে এখনো রিমান্ডে নেওয়া হয়নি।’
সিনহা হত্যা মামলার আসামিদের রিমান্ডের বিষয়ে আদালত থেকে এখনো কোনো কাগজপত্র কারা কর্তৃপক্ষের কাছে আসেনি বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলা কারাগারের সুপার মো. মোকাম্মেল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আসামি সাত জনই জেলা কারাগারে বন্দি আছেন। রিমান্ডের আসামিদেরকে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করার জন্য এখনো কোনো ধরণের আইনি অনুমতি বা আদালতের নির্দেশনা হাতে পৌঁছেনি।’
‘আদালত থেকে আদেশের কপি হাতে আসলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে’, যোগ করেন তিনি।
এদিকে কক্সবাজারের কারাগারে থাকা কয়েদিদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন টেকনাফ থানার বিতর্কিত ওসি প্রদীপের করা মামলার আসামি। সেই প্রদীপ তাদের সঙ্গী হতে চলেছেন বলে বৃহস্পতিবার দুপুরে কারাগারের ভেতর খবর চাউর হলে ওই কয়েদিরা ক্ষোভ নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন। শত শত কয়েদি অধীর অপেক্ষায় ছিলেন প্রদীপের কারাগারে ঢোকার দৃশ্যটি একটু হলেও অবলোকন করতে। কিন্তু তাদের সেই ইচ্ছা পূরণ হয়নি আদালতের কার্যক্রম সারতে দেরি হওয়ার কারণে। রাত ১০টার পরই আদালত থেকে ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকতসহ সাত পুলিশ আসামিকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। ততক্ষণে নিয়মানুযায়ী কারাগারের সব ওয়ার্ড বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
বন্দিদের মধ্যে ক্ষোভ লক্ষ করে কারা কর্তৃপক্ষ ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকতসহ সাত আসামিকে আলাদাভাবে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। এ সত্ত্বেও শুক্রবার সকাল থেকেই বন্দিরা ওসি প্রদীপের নাম ধরে চিৎকার করে নানা কথা বলেন। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কায় সাত আসামিকে সকাল থেকে ওয়ার্ডের বাইরে বের হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি। বন্দিদের সঙ্গে নিয়মমাফিক দেখা করা তাদের স্বজনদের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। তবে কারাগারের সুপার মোজাম্মেল হোসেন বলেছেন, কারাভ্যন্তরে কোনো সমস্যা নেই, সব ঠিকঠাক রয়েছে।
মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার সাত পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। শুক্রবার তাদের বরখাস্ত করা হয়। তারা হলেন টেকনাফ থানার প্রত্যাহার হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, সিনহাকে গুলি করা পুলিশের পরিদর্শক লিয়াকত আলী, কনস্টেবল সাফানুর করিম, উপপরিদর্শক নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল কামাল হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন এবং সহকারী উপপরিদর্শক লিটন মিয়া।
প্রসঙ্গত, দুই বছর আগে সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়া সিনহা মো. রাশেদ খান ‘লেটস গো’ নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য গত প্রায় একমাস ধরে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকায় ছিলেন। আরো তিন সঙ্গীকে নিয়ে তিনি উঠেছিলেন নীলিমা রিসোর্টে। গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন।
ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারের কথা জানিয়ে সে সময় পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, সিনহা তার পরিচয় দিয়ে ‘তল্লাশিতে বাধা দেন’। পরে ‘পিস্তল বের করলে’ চেক পোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ তাকে গুলি করে। এই ঘটনায় পুলিশ মামলাও করে। তবে পুলিশের এই ভাষ্য নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও প্রশাসনের প্রতিনিধি নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
এদিকে সিনহাকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে বুধবার কক্সবাজারের আদালতে মোট ৯ পুলিশকে আসামি করে মামলা করেন তার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। আদালতের নির্দেশে বুধবার রাতেই মামলাটি টেকনাফ থানায় নথিভুক্ত হয়। এই হত্যা মামলায় বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে ১ নম্বর এবং টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে দুই নম্বর আসামি করা হয়েছে। অন্য আসামিরা হলেন- এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কনস্টেবল কামাল হোসেন, কনস্টেবল আবদুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এএসআই টুটুল ও কনস্টেবল মো. মোস্তফা।
মামলার পর ওইদিন বিকালে টেকনাফ থানা থেকে ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে প্রত্যাহার করা হয়। পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ২০ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনসে পাঠানো হয় দুদিন আগেই। এ মামলায় বৃহস্পতিবার টেকনাফ থানা থেকে প্রত্যাহার হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, শামলাপুর তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতসহ ৭ আসামির প্রত্যেককে র্যাব হেফাজতে সাত দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। একই সঙ্গে পলাতক ২ আসামি এএসআই টুটুল ও কনস্টেবল মো. মোস্তফাকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
এজাহারে সিনহার বোন অভিযোগ করেন, ওসি প্রদীপের ফোনে পাওয়া নির্দেশে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের এসআই লিয়াকত আলী গুলি করেছিলেন সিনহাকে। এ মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় ‘ইচ্ছাকৃত নরহত্যা’, ২০১ ধারায় আলামত নষ্ট ও মিথ্যা সাক্ষ্য তৈরি এবং ৩৪ ধারায় পরস্পর ‘সাধারণ অভিপ্রায়ে’ অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০২ ধারার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ঘটনার সময় সিনহার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে (২১) মামলার প্রধান সাক্ষী করা হয়েছে। ঘটনার দিনই তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ, মাদক ও অস্ত্র আইনের মামলায় তাকেও আসামি করা হয়।
সিনহা নিহতের ঘটনায় জড়িত সব পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে বুধবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তাদের সমিতি রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (রাওয়া)। একই দিন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ কক্সবাজারে গিয়ে সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, এই ঘটনায় যে এই ঘটনায় দায়ী হিসেবে যে বা যারা চিহ্নিত হবে, তারাই শাস্তি পাবে। এর দায় বাহিনীর উপর পড়বে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মঙ্গলবার সিনহার মা নাসিমা আখতারকে ফোন করে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের আশ্বাস দেন।