জাহাঙ্গীর হাফিজ :: ২১ আগস্ট পৃথিবীর ইতিহাসে এক জঘন্যতম বর্বরোচিতো হামলা। এই নির্মম ঘটনা বাংলাদেশের জন্য এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের সপরিবারে হত্যার ধারাবাহিকতারই একটি অংশ। ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট তৎকালীন বিরোধী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জনসভা ছিল বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে।
তখন বিএনপি খালেদা জিয়ার সরকার দেশকে লুটপাটের রাজ্যে কায়েম করেছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের প্রধান হিসেবে এক জনসভার ডাক দেয়। সেই জনসভা ছিল শান্তিপূর্ণ। জনসভা চলার এক পর্যায়ে নির্লজ্জভাবে ১১টি শক্তিশালী গ্রেনেড ছুড়ে দেওয়া হয় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে। তারপর এক ভয়াবহ দৃশ্যের অবতারণা হয়। সেই বিভৎস ঘটনার বর্ণনা করতে গেলে শুধু মৃত্যুপথযাত্রী শত শত লোকের আহাজারির কথা আজও কানে ভাসে। সেদিন প্রায় ২৪ জনের অধিক ও নাম নাজানা অরো অনেকের মৃত্যু হয়। সেদিন একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। পরপর ১১টি শক্তিশালী গ্রেনেড শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়তে শুরু করে জঙ্গিগোষ্ঠী হরকাতুল জিহাদ প্রধান মুফতি হান্নানসহ আরো অনেকে। শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও প্রায় তিন শতাধিক নিরীহ মানুষসহ এবং নেত্রী অইভি রহমান আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা জিল্লুর রহমানের স্ত্রী। শেখ হাসিনাকে রক্ষা করার জন্য মঞ্চে উপবিষ্ট প্রেসিডিয়াম সদস্যবৃন্দ ও সিনিয়র নেতারা নিজেদের জীবনকে উপেক্ষা করে শেখ হাসিনাকে বাঁচানোর জন্য এক দেয়াল প্রাচীর তৈরি করে। শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও তার শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেন। শেখ হাসিনার প্রাণ বাঁচাতে তার বডিগার্ড নিজের জীবন দিয়ে কোনোরকমে তাকে বুলেট প্রুফ গাড়িতে তুলে দেন।
দলের কর্মীরা বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে গ্রেনেড হামলার পরপরই ধানমন্ডির ৫ নম্বর সড়কে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। ধীরে ধীরে সেখানে জড়ো হতে থাকে বিভিন্ন ধরনের নেতা কর্মী ও সাধারণ জনগণ। সন্ধ্যা ৬টার দিকে দলের নেত্রী শেখ হাসিনা সুধাসদনে এসে পৌঁছান। এবং সেই সাথে পৌঁছান দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, মতিয়া চৌধুরী ও দলের অন্যান্য নেতারা। সেদিন সেখানে উপস্থিত থাকা আওয়ামী লীগের মহানগরের নেতা আব্দুল হক সবুজ সাংবাদিকদের বলেন ” সুধাসদনের সামনে উপস্থিত দলীয় নেতা কর্মীদের একটাই জানার ছিল নেত্রী কেমন আছেন? — নেত্রী ঠিক আছেন তো।”
এদিকে ঘটনার পর অহতদের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে রাজধানীর হাসপাতালগুলো। আহতদের পাশে দাড়াঁতে নেতা কর্মী আর স্বজনদের ভিড়ে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে রাজধানীর অধিকাংশ হাসপাতাল।
আহতদের আর্তচিৎকার আর স্বজনদের গগনবিদারী আর্তনাদে প্রকম্পিত হয়ে উঠে সেখানকার পরিবেশ। আতঙ্ক আর অবিশ্বাস নিয়ে এদিক-ওদিক মানুষের ছোটাছুটি। আর কিছুক্ষণ পরপর অহতদের দলে যুক্ত হওয়া নতুন নতুন নাম যা ছিল এক মর্মান্তিক দৃশ্যের অবতারণা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ, মিডফোর্ড, পঙ্গু হাসপাতাল, হলি ফ্যামিলি, হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, শমরিতা হাসপাতালসহ প্রায় সবহাসপাতাল ভরে যায় গ্রেনেড হামলায় আহতরা। গুরুতর আহতদের ভিড়ে হাসপাতালে জরুরি বিভাগে তিল ধারণের জায়গা ছিলনা সেদিন। স্থান সংকুলান না হওয়ার সেদিন বিভিন্ন হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। রক্তাক্ত হাত পা উড়ে যাওয়া কিংবা স্পিন্টারের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া হতভাগ্যদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠে হাসপাতালের সামনের রাস্তা, সিঁড়ি করিডোর ও বিভিন্ন ওয়ার্ড।
সেদিন আওয়ামী লীগের জনসভায় বোমা বিস্ফোরণের পর থেকেই পুরো ঢাকা শহর হয়ে উঠে এক আতঙ্কের নগরী। ঘটনার পর দেখা যাচ্ছিল, বঙ্গবন্ধু এভিনিউর ওপরটা ঢেকে ছিল কালোধোঁয়ার আস্তরণ। রাস্তায় ভাঙা কাঁচের উপর দিয়ে ছুটে পালাচ্ছিল চলন্ত গাড়িগুলো। দুই ট্রাক পুলিশ ছিল হাইকোর্টের সামনের রাস্তায়। পুলিশের বুটের শব্দে প্রকম্পিত হচ্ছিল ঢাকার রাস্তা। দুই পাশের রাস্তায় দাড়িঁয়ে ছিল হাজার খানেক নারী পুরুষ। সচিবালয়ে কাজ শেষে বাসায় ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন কর্মকর্তা কর্মচারীগণ। কিন্তু কেউই রাস্তায় বের হওয়ার সাহস পাচ্ছিলেন না।
গ্রেনেড হামলার পরপরই বিবিসি থেকে ফোন আসে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার কাছে।
সেদিন তিনি প্রথমেই বলেছিলেন আমার নেতা কর্মীরা তাদের জীবন দিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছেন। গ্রেনেড যখন বিস্ফোরিত হচ্ছিল তখন নেতা কর্মীরা আমাকে ঘিরে রেখেছিলেন। তাদের অনেকেই আহত নিহত হয়েছেন। বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন তিনি। ঐ সাক্ষাৎকারে তিনি আরো বলেছিলেন বিএনপি সরকারের মদদে জঙ্গিগোষ্ঠীকে ব্যবহার করে আমাকে ও আমার দলকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছে। আমাদের এই জনসভা ছিল বোমা হামলা নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে। এজন্যই তারা গ্রেনেড হামলা করে জঘন্যতম ইতিহাস রচনা করলো। জনসভায় আমার বক্তব্য শেষ হতে না হতেই বৃষ্টির মতো গ্রেনেড ছুঁড়তে থাকে সরকারি দলের মদদপুষ্ট জঙ্গিরা। আমার নেতা কর্মীরা আমাকে ঘিরে রাখে আমার জীবন রক্ষার জন্য। এখনো আমার কাপড়ে তাদের রক্ত লেগে আছে। তাদের টার্গেট ছিল আমাকে হত্যা করা ও আমার দলকে নিশ্চিহ্ন করা।
এক অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৮ সালের পর থেকে হুজি বাংলাদেশের ভেতরে নাশকতামূলক তৎপরতা শুরু করে। লক্ষ্যবস্তু করে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের (১৯৯৬-২০০১) বিভিন্ন সভা সামবেশে হুজি জঙ্গিরা আটটি বড়ো ধরনের বোমা হামলা চালিয়েছিল। তখন তিন দফায় আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালায় এই জঙ্গিরা। এর মধ্যে প্রথম চেষ্টা হয়েছিল ২০০০ সালের জুলাইয়ে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় হেলিপ্যাডের কাছে দূরনিয়ন্ত্রিত দুটি শক্তিশালী বোমা পুতে রাখে। কোটালীপাড়ায় হত্যা চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ২০০১ সালে ৩০ মে খুলনায় রুপসা নদীর উপর নির্মিত ব্রিজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা করা হয় ।
এই জঘন্যতম গ্রেনেড হামলা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। পাকিস্তানি প্রেতাত্মা বিএনপি জামাত ৪ দলীয় সরকার ও তাদের কুচক্রীমহল আজো তৎপর। অপবাদীদের রুখে দিতে বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধ। আজকে বাংলাদেশ সারাবিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। জিডিপি গ্রোথসহ বাংলাদেশ আজ এগিয়ে চলেছে জাতির পিতার সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে।
একদিকে গার্মেন্টস শিল্প অন্যদিকে কৃষি পল্ট্রি অবারিত কর্মসংস্থাপন এবং দণ্ডায়মান স্বপ্নের পদ্মাসেতু। সরকারের টানা দশ বছরে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে উন্নয়নের পথ মসৃণ ছিল না। জ্বালাও- পোড়াও, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাসহ দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র বাধা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগুতে হচ্ছে।
বর্তমান সরকারের সময় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, ক্রীড়া, পরিবেশ, কৃষি,খাদ্য, টেলিযোগাযোগ, সংস্কৃতি, সামাজিক নিরাপত্তা, মানবসম্পদ উন্নয়নে এমন কোনো খাত নেই যে খাতে অগ্রগতি সাধিত হয়নি। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে গত কয়েক বছরে দেশে অবকাঠামো উন্নয়ন, দারিদ্র্যমোচন, পুষ্টি, মাতৃত্ব এবং শিশু স্বাস্থ্য, প্রাথমিক শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল উজ্জীবিত আছে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।