- ৭ কোটি ৯ লাখ ৫১ হাজার টাকা ব্যয়ের পর প্রকল্প বাতিল
- উচ্ছেদকৃত চার শতাধিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর পরিবারে চাপা কান্না
দীর্ঘ ২৬ মাস ধরে পথে ঘাটে বসে কোন রকম বেচাবিক্রি করে সংসার পরিচালনা করছেন খুলনা সিটি কর্পোরেশন (কেসিসি) কর্তৃক নির্মাণাধীন খালিশপুর পৌর সুপার মার্কেটের উচ্ছেদকৃত চার শতাধিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। চরম অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে চলছে তাদের ব্যবসার ভবিষ্যত। অসহনীয় কস্ট আর আর্থিক অনটনে তারা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। দেনার দায়ে জর্জরিত ব্যবসায়ীদের একটি অংশ বাঁচার তাগিদে অন্য পেশাকে বেছে নিয়েছেন।
এদিকে, ৭ কোটি ৯ লাখ ৫১ হাজার টাকা ব্যয়ের পর ‘ঠুনকো’ অজুহাতে বাতিল করা হয়েছে প্রকল্পটি। কিন্তু কবে নাগাদ এ প্রকল্প নতুন করে শুরু হবে তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না।
কেসিসির তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা জানান, ২০১৯ সালের ৩০মে ৯ কোটি ৬০ লাখ ৮৯ হাজার টাকা ব্যয়ে খালিশপুর পৌর সুপার (চিত্রালী কিচেন) মার্কেট প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। কাজ শেষ করার কথা ছিল ২০২১ সালের ৩০ মে। কিন্তু ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে না পারায় গত ১৬ জুন বিএমডিএফ (বাংলাদেশ মিউনিসিপ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফান্ড) কর্তৃপক্ষ প্রকল্পটি বাতিল করে দেয়। যদিও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের প্রায় ৭৫ ভাগ কাজ সম্পন্ন করে ৭ কোটি ৯ লাখ ৫১ হাজার টাকার চূড়ান্ত বিল উত্তোলন করে নিয়েছে।
কেসিসির দায়িত্ব প্রাপ্ত তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা ও প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন বলেন, সম্পূর্ণ মার্কেটের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে আরো সাড়ে ৬ কোটি টাকার প্রয়োজন। প্রকল্পের কাজের অসমাপ্ত অংশ বিএমডিএ’র মাধ্যমে শেষ করার জন্য অর্থ বরাদ্দ চেয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু এতে কোন সাড়া মেলেনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নির্মাণাধীন খালিশপুর পৌর সুপার মার্কেট প্রকল্প বাতিলের প্রস্তাব করে বিএমডিএফ (বাংলাদেশ মিউনিসিপ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফান্ড)। গত ১ ফেব্রুয়ারি বিএমডিএফ’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হাসিনুর রহমান কেসিসির নির্বাহী কর্মকর্তাকে চুক্তি বাতিলের সুপারিশ করে চিঠি দেন।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বিএমডিএ’র অর্থায়নে বাস্তবানাধীন সকল উপ-প্রকল্প আগামী ৩০ জুনের মধ্যে আবশ্যিকভাবে সমাপ্ত করতে হবে। কিন্তু কেসিসির আওতাধীন এমজিএসপি-বিএমডিএফ অংশের উপ-প্রকল্প নং-ড-০২৮ –এর কাজের গতি অত্যন্ত মন্থর, যা দাখিলকৃত হালনাগাদ কার্য পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
আরও উল্লেখ করা হয়, এ পর্যায়ে অসম্পাদিত পূর্ত কাজসমূহ শুরু করে অনুমোদিত সময়সীমার মধ্যে সম্পন্ন করে উক্ত উপ-প্রকল্প সমাপ্ত করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। এমতাবস্থায়, পরবর্তী জটিলতা পরিহারের স্বার্থে বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শে উপ-প্রকল্প ড-০২৮-এর কাজের জন্য ঠিকাদারের সাথে সম্পাদিত চুক্তি অবিলম্বে বাতিল করার জন্য অনুরোধ করা হলো।
এ চিঠি পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মের মালিক মোঃ তাহিদুল ইসলাম ঝন্টুকে ডাকা হয়। সে মতে, ঠিকাদার গত ৩ ফেব্রুয়ারী কেসিসি’র প্রধান প্রকৌশলীর নিকট নির্মানাধীন মার্কেটের কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে অঙ্গিকারনামা দেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেন, মার্কেটের নির্মাণ কাজ চলছে। উক্ত নির্মাণ কাজ ইতোমধ্যে ৭৫ ভাগ শেষ করেছি। অবশিষ্ট ২৫ ভাগ কাজ নির্ধারিত সময় ৩১ মে’র মধ্যে সম্পন্ন করা হবে। তারই প্রেক্ষিতে, কেসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা একই দিন বিএমডিএ’র ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নিকট চিঠি দেন।
চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, খালিশপুরে মার্কেট নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার পত্রের মাধ্যমে জানিয়েছেন, সংশোধিত চুক্তি অনুযায়ী ৩০ মে’র মধ্যে কাজটি সমাপ্ত করতে পারবেন। বিগত অর্থ বছর হতে করোনা মহামারি, অতিবৃষ্টি, আম্ফানসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে থাকা সত্বেও বর্তমানে কাজের অগ্রগতি ৭০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। পাইল কাস্টিং, বেইজমেন্ট ঢালাই গ্রাউন্ডফ্লোর ঢালাইসহ কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক। সূত্রে বর্ণিত স্মারকের প্রেক্ষিতে এখনই কাজটি বাতিল করা হলে মার্কেটের প্রায় চারশ’ ব্যবসায়ী জীবিকা অর্জনে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে কেসিসির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে।
এদিকে, মার্কেট নির্মাণ কাজ বাতিলের খবর খালিশপুর পৌর সুপার মার্কেটে পৌছালে ক্ষোভে ফেটে পড়েন ওই মার্কেটের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। সুপার মার্কেট ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক রাফেল ফেরদৌস রানা বলেন, মাকের্ট নির্মাণ কাজ বাতিল হওয়ায় তারা চারশত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পুঁজি হারিয়েছে। তারা অনেকেই মানবেতর জীবন যাপন করছে। অবিলম্বে বাকী কাজটি শেষ করতে মানবিক মেয়রের হস্তক্ষেপ কামনা করেন এই নেতা।
মেহেদী হাসান নামের মুদি ব্যবসায়ী বলেন, গত আড়াই বছর ধরে মার্কেট ভাঙ্গার পর থেকে তারা পথে বসে কোন রকম পণ্য বিক্রি করছেন। তারপরও তারা কেসিসির সকল টোল ট্যাক্স দিয়ে আসছেন। এতে করে তারা আজ ব্যবসায়ীকভাবে চরম দুর্দশার মধ্যে রয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত এসব ব্যবসায়ীরা তাদের ক্ষতিপূরণের জোর দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা পুঁজি হারাতে বসেছে। এমনই সংকটে কেসিসি দোকানের ভাড়া বাড়িয়েছে। যা চরম অমানবিক বলে তিনি দাবি করেন। একই সাথে নির্মানাধীন মার্কেটের আন্ডার গ্রাউন্ড পার্কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে পঁচা দুর্গন্ধ সৃষ্টি হচ্ছে। এখানে মশার প্রজনন ক্ষেত্র হয়েছে।
বাজারের ব্যবসায়ী কুতুব উদ্দীন বলেন, উচ্ছেদকৃত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে। অনেকে বাঁচার তাগিদে অন্য পেশা বেছে নিয়েছে। যারা আছেন তারা সড়কের পাশে বসে গত দু’ বছর ধরে মালামাল বিক্রি করে কোন রকম জীবন যাপন করছেন। অবিলম্বে নির্মানাধীন মার্কেটের কাজ সম্পন্ন করার জোর দাবি জানান এই ব্যবসায়ী।
সড়কের পাশে বসে উচ্ছেদকৃত কাঁচামাল বিক্রেতা কবির হোসনে জানান, আগের থেকে অর্ধেকের কম মালামাল বিক্রি হচ্ছে। প্রায় আড়াই বছর ধরে এই সড়কের পাশে বসেই পণ্য বিক্রি করছেন। তবে আগের মতই কেসিসিকে প্রতিদিন পাঁচ টাকা করে খাজনা দিতে হয়। অবিলম্বে মার্কেটের বাকি কাজ শেষ করে তাদের পূর্নবাসনে দাবি জানান এ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।
বাজার পরিচালনা কমিটির সভাপতি হাসান হাফিজুর রহমান বলেন, এ মার্কেটটি আধুনিকায়ন করার জন্য তিন দফা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। কিন্তু একটি প্রকল্পও আলোর মুখ দেখেনি। প্রথম প্রকল্প নেয়া হয় ৩৫ কোটি টাকার। পরে নেয়া হয় ১৮ কোটি টাকার। সর্বশেষ নেয়া হয় প্রায় ১০ কোটি টাকার প্রকল্প। এসব প্রকল্পের কাজ শেষ করতে না পারায় এ বাজারের ব্যবসায়ীরা চরম ক্ষতির মুখে। হতাশাগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা অন্য পেশায় মনোনিবেশ করছে।
তিনি বলেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থতার জন্য কেসিসির সহকারি প্রকৌশলী শেখ মোহাম্মদ হোসনেকে মেয়র সাময়িক বরখাস্ত করেছে। অন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি করেন তিনি। সাবেক ভারপ্রাপ্ত মেয়র আনিছুর রহমান বিশ্বাসের নিকট বাজারের নস্ট গেটগুলো মেরামত করার জন্য গেলে তিনি পরিত্যক্ত মার্কেটের পিছনে কোন অর্থ ব্যয় করা যাবে না মর্মে সাফ জানিয়ে দেন। অথচ সেই মার্কেটের ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে কেসিসি নিয়মিত টোল ট্যাক্স নিচ্ছে। এমন কি সম্প্রতি দোকান ঘরের ভাড়া বৃদ্ধি করেছে। যা কমানোর দাবি করে মেয়রের নিকট স্মারকলিপি দেয়া হলেও এখনও কোন ফলাফল পাওয়া যায়নি। অবিলম্বে অসমাপ্ত কাজ দ্রুত শেষ করতে মেয়রের হস্তক্ষেপ কামনা করেন এই নেতা।
সোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. তাহিদুল ইসলাম তার ব্যর্থতার কথা অস্বীকার করে বলেন, প্রথমে এ প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শুরু করতে পারেনি। এছাড়া করোনার কারণে কেসিসি গত ২৫ মার্চ’২০ পৌর সুপার মার্কেট নির্মাণসহ সকল উন্নয়ন কাজ বন্ধ করে দেয়। পরে কেসিসির নির্দেশনা মোতাবেক গত ৭ মে থেকে মার্কেট নির্মাণ কাজ শুরু করা হলেও নানা প্রতিবন্ধকতায় তা শেষ করা সম্ভব হয়নি। তার আগেই বিএমডিএফ প্রকল্প বাতিল করে দেয়। ইতোমধ্যে মার্কেট ভবনের ৭৫ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তবে তিনি কাজের পুরো বিল এখনও পাননি। তার এখনও এক কোটি ৮৯ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে (অতিরিক্ত কাজের)। মার্কেট নির্মাণ প্রকল্প শেষ করতে মেয়রের চেষ্টার কোন কমতি ছিল না। দায়িত্বরত প্রকৌশলী শেখ মোহাম্মদ হোসেন সঠিকভাবে কাজের বিবরণ মেয়রের নিকট উপাস্থাপন করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
উল্লেখ্য, কেসিসি পরিচালিত খালিশপুর পৌর সুপার (কিচেন) মার্কেটটি নতুন আঙ্গিকে গড়ে তোলা সকল প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে এ মার্কেটটি নতুন করে করছে সিটি কর্পোরেশন। গত ২০১৯ সালের মার্চ মাসে কার্যাদেশ হয়। পুরাতন মার্কেট অপসারণসহ নানা জটিলতায় মার্কেট নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৫ সেপ্টেম্বর। নিয়ম অনুযায়ী ৩০ মার্চ’২০ মার্কেট নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু পারেনি। পরে ৩০ মে’২১ পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। বেজম্যান্টসহ চারতলা ফাউন্ডেশনের মার্কেটটি করা হবে সেমিব্যাজমেন্টসহ একতলা।