নিজস্ব প্রতিবেদকঃ সামান্য বৃষ্টিতে ডুবে যাচ্ছে খুলনার বেশির ভাগ সড়ক। ৩০ মিনিটের বৃষ্টির পানি নিরসনে একবেলা লাগছে। গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, অলি-গলি, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিপনী বিতানের সামনে জমে থাকছে পানি। বিভিন্ন এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে স্থায়ী জলাবদ্ধতা। জলাবদ্ধতা নিরসনে কেসিসি’র বিভিন্ন পদক্ষেপ থাকলেও নেই বাস্তবায়ন। ফলে জনদুর্ভোগের নগরবাসী।
গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১২ টায় খুলনায় প্রায় এক ঘন্টা টানা বৃষ্টি বৃষ্টি হয়। আর এই সামান্য বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে নগরীর কেডিএ এভিনিউ রোড, লোয়ার যশোর রোড, ডাকবাংলা মোড়, পিটিআই মোড়, রয়েল মোড়, শান্তিধাম মোড়, ফুল মার্কেট, টুটপাড়া, নতুন বাজার, জোড়াগেট, খালিশপুর বাস্তহারা, বয়রা এলাকা, মুজগুন্নী, হাউজিং বাজার, নতুন কলোনী, দৌলতপুরসহ নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক।
স্থানীয়দের অভিযোগ, অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, ময়লা-আবর্জনা, বড় বড় খাল ভরাট ও অবৈধভাবে দখলসহ নানা কারনে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। খালিশপুর এলাকার বাসিন্দা নুরুল আমিন বলেন, আষাঢ়ের তীব্র তাপমাত্রায় অতিষ্ঠ নগরবাসী বৃষ্টি মধ্য দিয়ে স্বস্তি খুজে পেল। তবে স্বস্তির মাঝেও সৃষ্টি হয়েছে জনদুর্ভোগ। বর্ষা মৌসুমের শুরু হয়েছে। এখনই জলাবদ্ধতা নিরসনে কেসিসি’র স্থায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে সামনে আরও ভারী বর্ষণে আটকে পড়বে দৈনন্দিন জীবন যাত্রা। সৃষ্টি হবে স্থায়ী জলাবদ্ধতা।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ মোশারফ হোসেন বলেন, খুলনা নগরীতে আমরা জলাবদ্ধতা নিরাসন চাই। ২২ খাল পুনরুদ্ধার সহ খনন চাই। দীর্ঘদিন যাবৎ আমাদের এই আন্দোলন চলছে। বাংলাদেশ বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশ, সেই হিসেবে আমাদের এই অঞ্চলে অতি দ্রুত জলাবদ্ধতা নিরসন হওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, ওয়াসার সুয়ারেজ ব্যবস্থা হলে এ অঞ্চলে অতি দ্রুত জলাবদ্ধতা নিরসন হবে।
গ্লোবাল খুলনার আহবায়ক শাহ মামুনুর রহমান তুহিন বলেন, জলাবদ্ধতা খুলনাবাসীর দীর্ঘদিনের সমস্যা। মূলতঃ সিটি কর্পোরেশন ও অন্যান্য যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে তারা দীর্ঘদিন যাবৎ বলে আসছে আমরা জলাবদ্ধতা নিরসন করবো, ২২ খাল উদ্ধার করবো, অন্যান্য সমস্যার সমাধান করবো। কিন্তু বিষয়গুলো শুধু কাগজে কলমে হচ্ছে কার্যকারী কোন পদক্ষেপ আমরা এখনও পর্যন্ত দেখি নাই। খুলনা শহর থেকে পানি নিরসনের প্রধান জায়গাগুলো পরিস্কার করে দিলে কোন জলাবদ্ধতা থাকবে না। সামান্য কিছু অসাধু ব্যক্তির জন্য ১৬ লাখ নগরবাসী কষ্ট পাবে এটা কারো কার্ম হতে পারে না। অতি দ্রুত এদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে।
সামাজিক সংগঠন দীপ্তআলোর সভাপতি হাসানুর রহমান বলেন, অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও খাল গুলো অবৈধ দখল হয়ে পড়ায় মূলতঃ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। জলাবদ্ধতা নিরসনে জনগণ ও কর্পোরেশনকে দায়িত্ববান এবং কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি খালগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করতে হবে।
খুলনা আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তবে আষাঢ়ের অবিরাম বৃষ্টি মতো এ বৃষ্টি বেশি সময় স্থায়ী হবে না। দুই-তিন ঘণ্টা হয়ে থেকে যাবে। আবার শুরু হবে।
উল্লেখ্য, খুলনা মহানগরীর ময়ূর নদ ও সংযুক্ত ২২টি খালের প্রায় ১৪ হাজার বর্গমিটার জায়গা বেদখল হয়ে গেছে। এর মধ্যে ময়ূর নদের বেদখল হওয়া জমির পরিমাপ ১০৭৫ বর্গমিটার। নদের আয়তন কমেছে চার দশমিক ১৭ শতাংশ। অবৈধ দখলের কারণে খালগুলো সংকীর্ণ হওয়ায় পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ব্যাহত হয়েছে। ফলে প্রতি বর্ষা মৌসুমে নগরীর বড় অংশজুড়ে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা।
কেসিসি’র সূত্রে জানা যায়, মহানগরী এলাকার ২২টি খালের মধ্যে সাহেবখালী খাল, বাটকেমারী খাল, ছড়িছড়া খাল, ময়ূর নদ, মন্দার খাল, হরিণটানা খাল, তালতলা খাল, তমিজ উদ্দিন খাল, মতিয়াখালী খাল, খুদে খাল, নারকেলবাড়িয়া খাল, ছোট বয়রা শ্মশানঘাট খাল ও মজুমদারের খাল ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ অবৈধভাবে দখল হয়ে আছে। এর মধ্যে সাহেবখালী খালের ওপর রূপসায় সিটি করপোরেশন মার্কেট তৈরি করেছে; আছে ২৮ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয়, লবণচরা খালের ওপর তৈরি হয়েছে ৩১ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয়। নবীনগর খালের ওপর তৈরি হয়েছে ট্রাক টার্মিনাল, বাস টার্মিনাল এবং ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। পিটিআই মোড়ে তৈরি হয়েছে ওয়ার্ড কার্যালয়। এর ফলে ২৩, ২৮ ও ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের পানি নিষ্কাশিত হয় না। রেলওয়ে এলাকায় যে খালটি ছিল তার ওপর এখন হলুদ-মরিচের আড়ত। নগরীর পশ্চিম দিক বরাবর ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ ময়ূর নদের আড়ংঘাটা থেকে গল্লামারী পর্যন্ত অংশ দখল ও দূষণে একেবারে মৃতপ্রায়। ময়ূর নদের উত্তর প্রান্ত আড়ংঘাটা হয়ে বিল ডাকাতিয়ার মধ্যে গিয়ে মিশেছে। আশপাশে দখলের কারণে পানি কমে আড়ংঘাটার তিন ভেন্ট (কপাট) এলাকায় জমেছে কচুরিপানা, ফলে ভালো পানি পায় না এবং প্রশস্ততা খুবই কম। সেখান থেকে ভাটিতে গল্লামারীর দিকে যেতে তিন কিলোমিটারের বেশি পথে দুই দিকেই স্থানীয়রা দখলে নিয়ে নানা স্থাপনা গড়ে তুলেছে। সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালের পশ্চিমে তৈরি মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের কারণে একটি খালের মুখ বন্ধ হয়ে আছে। পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় আলুতলা বাঁধ দিয়ে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ কমে গেছে।
২০০৮-১৩ সালে মেয়র থাকা কালে তালুকদার আব্দুল খালেক নগরীর ২২টি খাল পুনরুদ্ধার করার উদ্যোগ নেন। কিছুদিন পর বিভিন্ন জটিলতায় বন্ধ হয়ে যায় উদ্ধার অভিযান। ২০১৩ সালে মেয়র প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক পরাজিত হন। দখলদাররা আরো বেপরোয়া হয়ে কেসিসির খাল-নালার ওপর একের পর এক স্থাপনা গড়ে তোলে। ২০১৮ সালের মে মাসে কেসিসি নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে তালুকদার আব্দুল খালেক নগরবাসীকে খাল উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দেন। এ বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি কেসিসি ও জেলা প্রশাসন একত্রে পুনরায় নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ২২টি খাল পুনরুদ্ধার করার উদ্যোগ নেন। যার কার্যক্রম এখনও চলছে।