চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃকৈয়া বাজারের বিকাশ দে। সাধারণ মানুষের কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। গত বুধবার রাতে র্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার সাথে সাথে তার সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে। নিরীহদের মাঝে ফিরেছে স্বস্তি। হয়েছে মিষ্টি বিতরণ। এরপর একে একে বেরিয়ে আসছে তার জমি দখল, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসার রোমহর্ষক কাহিনী। গতকাল শুক্রবার ডুমুরিয়ার কৈয়া বাজার ও শোলমারি এলাকায় সরেজমিন ঘুরে তার বিরুদ্ধে পাওয়া গেছে অনেক অজানা তথ্য।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, নড়াইল জেলার বাসিন্দা বিকাশ দে’র পিতা বিরেন দে ছিলেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গফ্ফার সাহেবের হোটেলের মেসিয়ার। ৮০’র দশকে ওই ব্যবসায়ী তার বাবাকে কৈয়া বাজারে ভাটায় কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দেন। ভাটার পাশে ২ কাঠা জায়গাও দেন ওই ব্যবসায়ী। বিকাশ ওই বাসায় বড় হয়। যৌবনে পদার্পনের আগেই জড়িয়ে পড়ে নেশা ও চোরাচালানীর জগতে। প্রথমে ভারতীয় শাড়ি, সুপারি ও ফেন্সিডিলের চালান আনা নেওয়ার কাজ শুরু করে। জিরো পয়েন্টের ‘জিরে জামাল’ তার এ কাজে সহযোগিতার হাত বাড়ায়। আস্তে আস্তে কৈয়া বাজারে তৈরি করে একটি বিশেষ বাহিনী। ওই বাহিনীর মাধ্যমে জমি দখল ও চাঁদাবাজি করে হঠাৎ আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে যায় বিকাশ দে।
সূত্র জানায়, তার জমি দখলের ফিরিস্তি অনেক লম্বা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নিরালার বাসিন্দা বৃদ্ধা সবুরন্নেছা। এই বৃদ্ধার কৈয়া বাজারের ৫ শতক জমি দখল করেছে বিকাশ বাহিনী। দখল করেছে মিষ্টির দোকানী রমেশ পালের ২ শতক জমি। এছাড়া অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা আতিয়ার রহমানের ১৫ শতক, বিলপাবলার ভগিরথ ওরফে ভগা ডাক্তারের ২৫ শতক, বিধান সড়কে দিপুর এক বিঘা ও সাধু এবং গোলকের ৮ শতক জমি সে দখল করেছে। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত বয়রার রফিকের সাড়ে ৭ শতক ও ডুমুরিয়ার খলশী গ্রামের রাজ্জাকের ৮০ শতক জমি দখল করে সে প্লট তৈরি করে বিক্রি করছে। গত সপ্তাহে কৈয়া বাজারের ফারুকের রাইস মিলের কাছে ৪টি দোকান সে দখল করে নেয়। ফারুকের মা বাধা দেয়ায় তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। কৈয়া বাজারের মধ্যে ঈদগাহ করার জন্য সরকারের কাছে আবেদনকৃত খাস জায়গা দখল করে ইউসুফ নামের এক ব্যক্তিকে দখল বুঝে দিয়ে বিনিময়ে তার কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা নিয়েছে। শোলমারির পিযুষ বৈরাগীরও ২৫ শতক জমি দখল করে নিয়েছে।
সূত্র জানায়, শোলমারীর দেবেন বৈরাগীর কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। না দেয়ায় বিকাশ ও তার বাহিনী ওই বাড়িতে হামলা করে। হামলায় দেবেনের ঠাকুর মা রঞ্জিতা বৈরাগীর পা ভেঙে যায়। ২০১৬ সালে ভেজাল বিরোধী অভিযানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট ডাক্তার দিলীপের কাছে ভেজাল ওষুধ পাওয়ায় জরিমানা করলে ওই ম্যাজিস্ট্রেটের ওপর হামলা চালায় বিকাশ ও তার বাহিনীর সদস্য তরুণ শীল, উজ্জ্বল ও মহাদেব। ২০১৮ সালে ভাটা সরদার আব্দুল্লাহ জুম্মার নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরার পথে বিকাশ ও তার বাহিনী মসজিদের সামনে তাকে মারপিট করে। তেলের দোকানী মনার দোকান ভাঙচুর ও তাকে মারপিট করে দোকান থেকে তাড়িয়ে দেয়। এ রকম অসংখ্য জমি দখল ও চাঁদাবাজির ঘটনার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আর এসব চাঁদার টাকায় খালি হাতে আসা বিকাশ কৈয়া বাজারে প্রায় ৫০ শতক জায়গার ওপর তৈরি করছে ৪ তলা বাড়ি। নির্মাণাধীন বাড়িটি রাজমিস্ত্রী রেজাউল করিমের কাজের বিল হয়েছে ১৯ লাখ টাকা। ৯ লাখ টাকা দেয়ার পরে পুনরায় টাকা চাইতে গেলে তাকে মারপিট করে তাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমানে রেজাউল এলাকা ছাড়া।
বিকাশের রয়েছে একটি লাল রঙের প্রাইভেট কার। ঢাকা মেট্রো-গ ১১-৫২২৫ নম্বরের প্রাইভেট কারে চড়ে চাঁদার টাকা আদায় করে। গ্রেফতারের দিন বিকেলে তার ক্যাডার শহিদ ও রাজাপুরের মেহেদীকে নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা সহিদের কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা আনতে যায় নগরীর ময়লাপোতা মোড়ে। ফেরার সময় র্যাবের হাতে আটক হয় তারা। বিকাশের জমি দখল ছাড়াও ছিল মাদকের একটি বড় ব্যবসা। কৈয়া বাজারের মন্দিরের পাশে রায়ের মহল সড়কে বিকাশ ফেন্সি কর্ণার নামে একটি জায়গা রয়েছে। ওই খান থেকে ফেন্সিডিল বিক্রি ও বিভিন্ন জায়গায় চালান দেয়া হয়। ভাটা সড়কে মহাদেবের চায়ের দোকানের পাশে বিকাশের রয়েছে গাঁজা পট্টি বা কর্ণার। ওখান থেকে গাঁজা সাপ্লাই দেয়া হয়। কালাচাঁদ ও মহাদেব ওই গাঁজার পট্টির দায়িত্বে রয়েছে। জমি দখল, চাঁদাবাজি ও মাদক বিক্রি এবং চালান আনা নেওয়ায় শোলমারির গোপি হালদার, তরুণ শীল, উজ্জ্বল স্বর্ণকার, হাতো শহিদ, মুসা, আবু কালাম, মনা, মামুনসহ ২০/৩০ জন ক্যাডার দায়িত্ব পালন করে। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে এসব অপকর্ম দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে বলে এলাকাবাসী জানায়। হরিণটানা থানায় নব-নির্মিত রান্নাঘরটি বিকাশ তৈরি করে দিয়েছে বলে জনশ্র“তি রয়েছে। এদিকে গত বুধবার বন্দুকযুদ্ধে বিকাশ নিহত হওয়ার খবরে কৈয়া বাজারে মিষ্টি বিতরণ হয়েছে। এলাকায় ফিরে এসেছে স্বস্তির নিঃশ্বাস। তবে তার কিছু অনুসারী গ্রেফতার আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে।