টেকসই বেড়িবাঁধ, সুপেয় পানি নিশ্চিত, লবণ পানি নিয়ন্ত্রণ করে কৃষির উন্নয়ন এবং জলবায়ু ঝুকি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের দাবি জানিয়েছেন খুলনা-৬ (পাইকগাছা-কয়রা) আসনের সংসদ সদস্য মো. রশীদুজ্জামান। তিনি বলেছেন, উপকূলীয় জনগণকে প্রকৃতির সাথে নিরন্তর যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই যুদ্ধ কঠিন হয়ে উঠেছে। তাই উপকূলের জীবন-জীবিকা রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সুদৃষ্টি জরুরি।
জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটের উপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়েএসব কথা বলেন তিনি। ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুর সভাপতিত্বে অধিবেশনে তিনি আরো বলেন, কৃষি আমাদের প্রধান উপজীব্য ও চালিকা শক্তি হলেও উপকূলের কৃষি মুখ থুবড়ে পড়েছে। এর প্রধান কারণ লবন পানিতে বাণিজ্যিক চিংড়ি চাষ। অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষের কারণে এলাকার ভূমিহীন কৃষক, নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী কৃষি পেশা হারিয়ে অন্য পেশা খুঁজে নিতে বাধ্য হয়েছে। এই ঢাকা শহরেও দৈনিক দিনমজুর খেটে জীবিকা নির্বাহ করছে পাইকগাছা-কয়রার কয়েক হাজার মানুষ। অথচ তারা যে এলাকার মানুষ সেখানেই এক-সময় ধানের ফসল ফলতো। সেই ধান কাটার জন্য বাহিরে থেকে শ্রমিক নিতে হতো। এখন চিংড়ি চাষের কারণে পরিস্থিতি বদলে গেছে।
এমপি রশীদুজ্জামান বলেন, বর্তমানে চিংড়ি চাষ আগের মতো অর্থকারী নেই। অনেকেই নিরুৎসাহী হয়ে চিংড়ি চাষ বন্ধ করে কৃষির দিকে ঝুকেছে। এবারের তরমুজ ফসল পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলাতে বাম্পার ফলন হয়েছে। আড়াই মাসের ফসলে যে তরমুজ পেয়েছে, সেগুলো অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। এবার প্রায় ২৫০ কোটি টাকা তরমুজ ক্ষেতের থেকে বিক্রয় হয়েছে। তরমুজ ক্ষেতে কাজ করে নারী শ্রমিকেরা এই মৌসুমে প্রত্যেকে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় করেছে। তরমুজের পাশাপাশি একই জমিতে বছরের অন্য সময়ে আরো ফসল ফলানোর সুযোগ আছে। ওই জমিতে মিষ্টি পানিতে সকল প্রকার মাছ চাষ সম্ভব হচ্ছে। যা লবণ পানিতে চিংড়ি চাষের থেকে অনেক বেশি লাভজনক ও পরিবেশবান্ধব। চিংড়ি চাষের লভ্যাংশ মালিক, অর্থাৎ এককেন্দ্রীক থাকে। আর কৃষি কাজ থেকে প্রাপ্ত অর্থ শুধু কৃষকই নয়, অনেকে ভোগ করতে পারে। যা বেকারত্ব দুরীকরণে সহায়ক। তিনি আরো বলেন, ওই অঞ্চলের নদী-নালা, খাল আশংকজনক ভাবে ভরাট হয়ে গেছে। তাই কৃষির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে লবণ পানির প্রবেশ বন্ধ করে এলাকার ভরাটকৃত খালগুলো পুন:খনন করে মিষ্টি পনির আধার তৈরী করতে হবে। কৃষকরা যেন শুষ্ক মৌসুমে সেচের কাজে ব্যবহার করতে পারে।
সুপেয় পানির সংকটের কথা তুলে ধরে সংসদ সদস্য রশীদুজ্জামান বলেন, সুপেয় পানির অভাবে পাইকাগাছা-কয়রাসহ সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ হাহাকার করছে। এখানে ধনী, দরিদ্রের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। বর্তমানে সকল পানির আধার লবণ পানিতে ভর্তি, যা পানের অযোগ্য। একমাত্র ভরসা বৃষ্টির পানি। বছরে চার মাস বৃষ্টি হতে পারে, বাকি আট মাসের পানি সঞ্চয় করে না রাখতে পারলে পানির হাহাকার বেড়ে যাবে। পানি সঞ্চয় করে রাখার জন্য সকল পরিবারে পানির ট্যাংকি সরাবরাহ করা অতীব জরুরি। তাই আমার দাবি হয় সুপেয় পানির ব্যবস্থা করে দনি, না হয় সাগরের লবণাক্ত পানি পান করে বেঁচে থাকার উপায় বের করে দিন।
আওয়ামী লীগ নেতা রশীদুজ্জামান বলেন, প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে আমার নির্বাচনী এলাকা কয়রা ও পাইকগাছা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্যোগের মধ্যে শত শত মানুষ নিয়ে কাজ করেও বাঁধ রক্ষা সম্ভব হয়নি। চোখের সামনে ভেসে গেছে বাঁধ ভেঙ্গেছে, রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ক্ষেতের ফসল, মাছের ঘের সবকিছুই। ক্ষতির একটি তাৎক্ষণিক তালিকা দাখিল করেছি। কিন্তু আঙ্কিক হিসেবে এই ক্ষতি নিরুপন করা সম্ভব নয়। দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী কয়রা উপজেলাতে গিয়েছিলেন। তিনি দু’উপজেলার ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা গ্রহণ করেছেন। নেত্রীর সাথে আলোচনা করে সমাধান করবেন বলে প্রতিশ্রæতিও দেন। জনগণ দ্রæত প্রতিশ্রæতির বাস্তবায়ন চায়।
সরকার দলীয় ওই সংসদ সদস্য বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের দুরে্যাগ নিত্য দিনের সঙ্গী। এর থেকে রক্ষা পাওয়ার অন্যতম অবলম্বন টেকসই বেড়িবাঁধ। সেই বেড়িবাঁধ নির্মাণে প্রধানমন্ত্রী বরাদ্দ দিয়েছেন, কিন্তু কাজের অগ্রগতি নেই। ষাটের দশকে যে ওয়াপদার বাঁধ তৈরি হয়েছিলো, সেই বাঁধ আর সংস্কার হয়নি। মাটি ক্ষয় হয়ে দিনে দিনে বাঁধ নিচু হয়েছে, আর নদীর বুকে পলি জমে জমে পানির উচ্চতা বেড়েছে। ফলে এবারের জলোচ্ছ¡াসে পানি ছাপিয়ে পাইকগাছা ও কয়রার বহু জায়গায় বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হয়েছে। আপাততঃ দৃষ্টিতে টেকসই বেড়িবাঁধের বিকল্প নেই। বাঁধের তলদেশ দিয়ে পানি সরাবরাহের পাইপ থাকলে বেড়িবাঁধ টেকসই সম্ভব হবে না। কোন পাইপ ছাড়াই বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।
এমপি রশীদুজ্জামান বলেন, ২০০৯ সালের আইলা থেকে ২০২৪ সালের রেমাল পর্যন্ত সকল ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে সুন্দরবন লন্ডভন্ড হয়েছে। সুন্দরবন নিজে বিপর্যস্ত হয়ে ঝড়ের গতিকে দুর্বল করে দিয়েছে। অতীতের সরকারগুলো সেই সুন্দরবন লুটপাট করেছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার সূদুর প্রসারী পদক্ষেপে সুন্দরবনের লুটপাট বন্ধ হয়েছে, সুন্দরবনের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। বন্যপ্রাণিদের নিরাপদে বেঁচে থাকার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার দাবি, সুন্দরবন অভন্তরে প্রত্যেকটা দ্বীপে বন্যপ্রাণির উপযোগী আশ্রয়কেন্দ্র করে দেওয়া হোক। আপদকালীন সময়ে তারা যেন সেখানে আশ্রয় নিতে পারে। তিনি আরো বলেন, সুন্দরবন আমাদের অক্সিজেন ফ্যাক্টরী। এক শ্রেণির দুস্কৃতিকারীরা চুরি করে বনের গাছ কাটে, বিষ দিয়ে মাছ ধরে এবং সুযোগ পেলে বাঘ মারে ও হরিণ ধরে। এদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।
আওয়ামী লীগ নেতা রশীদুজ্জামান বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলের দরিদ্র নারীদের জীবিকার জন্য চিংড়ি ঘেরে লবণ পানিতে কাজ করতে হয়। শ্যাওলা ভরা লবণ পানিতে ঘন্টার পর ঘন্টা শরীর ডুবিয়ে রাখার জন্য তাদের শরীরে বাসা বাঁধে নানা রকম দুরারোগ্য ব্যাধি। তাদের চেহারা নষ্ট হয়ে যায়, চর্মরোগ এবং ক্যান্সার সহ বহুবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এক শ্রেণির নারীরা নদীতে ঘন্টার পর ঘন্টা গলা সমান পানিতে ঠেলা জাল ঠেলে বাগদা চিংড়ির পোনা আহরণ করায় তারা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই মানবেতর পেশার পরিবর্তে ওই সকল দরিদ্র নারীদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত কর্মসংস্থান সৃষ্টির জোর দাবি জানাচ্ছি।