রাজধানী ঢাকায় গত বছরের এই সময়ের তুলনায় বর্তমানে মশার ঘনত্ব বেড়েছে চারগুণ। আর মশা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেয়া না হলে আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত মশার ঘনত্ব বেড়ে চরমে পৌঁছাবে।
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় এমন তথ্য জানানো হয়েছে। গবেষণাটি পরিচালনা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. কবিরুল বাশার।
তিনি বলেন, প্রতি মাসেই যাতে মশার ঘনত্ব কেমন হচ্ছে তা তুলনা করার জন্য এই গবেষণাটি পরিচালনা করছেন তিনি।
এর অংশ হিসেবে জানুয়ারির শেষের দিকে তিনি দেখতে পান যে, মশার ঘনত্ব অন্য সময়ে যা থাকে তার চেয়ে চারগুণ বেশি বেড়েছে।
‘গত বছরের এপ্রিল থেকে শুরু করা হলে জানুয়ারিতে অন্যান্য মাসের তুলনায় চারগুণ মশার ঘনত্ব পেয়েছি, বিশেষ করে লার্ভার ডেনসিটি।’
মশার ঘনত্ব কেমন বাড়ছে সেটা জানতে ঢাকার উত্তরা, খিলগাঁও, শনির-আখড়া, শাঁখারিবাজার, মোহাম্মদপুর ও পরীবাগসহ ছয়টি এলাকার নমুনা নিয়ে গবেষণা চলছে।
বাশার বলেন, ‘ছয়টা জায়গাতে গড় ঘনত্ব প্রতি ডিপে (মশার ঘনত্ব বের করার পরিমাপক) আমরা মশা পেয়েছি ৬০টিরও বেশি। যেখানে আমরা অন্যান্য সময় পাই ১৫-২০টি।’
‘মশা বসুন্ধরার সম্পদ’
রাজধানী ঢাকার বসুন্ধরা এলাকায় থাকেন নিহার সুলতানা। মশার উপদ্রব কেমন এমন প্রশ্নের উত্তরে কিছুটা ঠাট্টা করেই তিনি বলেন, মশাকে বসুন্ধরার সম্পদ বলা হয়।
তিনি বলেন, বসুন্ধরা এলাকায় বরাবরই মশার উৎপাত বেশি। তবে ইদানীং মশার পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে।
‘বারান্দায় গেলে আমি ঢোকার আগেই এক ঝাঁক মশা ঢুকে পড়ে। ঘর ভাড়া আমি দিলেও আমার বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকে মশারা,’ বলেন তিনি।
তিনি জানান, ১০-১৫ দিন পর পর মশার ওষুধ দেয়ার আওয়াজ পাওয়া গেলেও বাস্তবে আসলে তা থেকে কোনো লাভ হয় না। মশা কমে না।
মোহাম্মদপুরের শেখেরটেক এলাকার বাসিন্দা রোমানা আফরোজ। তিনি জানান, সম্প্রতি মশার উপদ্রব প্রচুর পরিমাণে বেড়েছে তার এলাকায়। মশার ভয়ে বিকেল থেকেই দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখতে হয়।
‘সন্ধ্যার পরেও যদি রাতে নয়টা-দশটার দিকে জানালা-দরজা একটু খুলি, মশা সারা ঘরে ভরে যায়।’
তিনি জানান, বেশ কয়েক মাস ধরে ওই এলাকায় দেয়া হয়নি মশা মারার কোনো ওষুধও।
মশার উপদ্রবের ঠিক একই চিত্রের কথা তুলে ধরেন বাসাবোর কদমতলা এলাকার নাজমা আক্তার।
তিনি বলেন, তার বাড়ির পাশে একটি খাল রয়েছে। সেটি পরিষ্কার আর সংস্কারের কাজ চললেও মশা এখনো কমেনি।
শুধু ঢাকা নয়, রাজধানীর বাইরে দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রামের একই অবস্থা। সেখানকার ঈদগাঁ বরফকল এলাকার বাসিন্দা আয়েশা সিদ্দিকা পিংকি বলেন, মশার উপদ্রবের কারণে দিনের বেলাতেও মশারি টাঙিয়ে রাখতে হয়।
‘কয়েল দিলেও কোনো কাজ হচ্ছে না। মশারি লাগায় রাখতে হচ্ছে। আমার বাসায় ছোট বাচ্চা আছে তো, এর জন্যই বেশি প্রবলেম হচ্ছে।’
মশা কেন বেড়েছে?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কবিরুল বাশার বলেন, এই সময়ে যে মশা দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে ৯৯% হচ্ছে কিউলেক্স মশা। যেটি আসলে এডিস মশা নয়।
তিনি জানান, এই মশা সাধারণত পঁচা পানিতে হয়। নর্দমা, ড্রেন, ডোবা, বিল ঝিলে পানি এখন পঁচে গেছে। সেই সাথে বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে এবং পানি বহমান না থাকার কারণে কিউলেক্স মশার জন্মানোর হার বেড়ে যায়।
শীতের শেষে তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে প্রকৃতিতে যে মশার ডিম থাকে সেগুলো একযোগে ফুটে যায়। যার কারণে ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে মশার ঘনত্ব বেড়ে যায়।
কিউলেক্স মশার কামড়ে অনেক সময় গোদ রোগ হয়। যেটাকে ফাইলেরিয়াসিস বা এলিফ্যান্টিয়াসিসও বলা হয়। এটি হলে হাত পা ফুলে বড় হয়ে যায়।
কয়েল বা স্প্রে-তেও মশা যাচ্ছে না কেন?
অনেকেই অভিযোগ করে থাকেন যে, মশা মারতে বা তাড়াতে এর আগে কয়েল এবং অ্যারোসল স্প্রে ব্যবহার করা হলে তা কাজ করত। তবে ইদানীং কয়েল বা স্প্রে ব্যবহার করলেও মশা তাড়ানো যাচ্ছে না।
এমন প্রশ্নের উত্তরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. কবিরুল বাশার বলেন, নির্দিষ্ট কোন একটি কীটনাশক একটানা পাঁচ বছরের বেশি ব্যবহার করা হলে মশা সেই কীটনাশকের বিপক্ষে সহনশীলতা তৈরি করে।
‘এটি একটি জেনেটিক মেকানিজম।’
এই প্রক্রিয়ায় ওই কীটনাশকের প্রতি সহনশীল হওয়ায় সেটি আর কাজ করে না। আর এজন্যই মশা নিয়ন্ত্রণে প্রতি পাঁচ বছর পর পর কীটনাশক পরিবর্তন করা দরকার। তার বিরুদ্ধে
মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে কী করতে হবে?
বাশার বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে র্যাপিড অ্যাকশনের মতো পদক্ষেপ নিতে হবে। এর আওতায় সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডের প্রতিটি জায়গায় যেখানে পানি রয়েছে সেখানে একযোগে লার্ভা নিধনের ওষুধ দেয়া ছিটিয়ে দিতে হবে। সেই সাথে জনগণের সহায়তা বিল-ঝিল-ডোবা-নর্দমা পরিষ্কার করতে হবে। কারণ এসব স্থানেই মশা বেশি জন্মায়।
আর প্রাপ্ত বয়স্ক মশা দমনে ফগিং করতে হবে। এই অভিযান শুরু করার পর তিন দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে। যাতে মশা আবার ডিম পাড়ার সুযোগ না পায়।
এ ছাড়া স্থায়ীভাবে মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে সারা বছরব্যাপী সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হবে বলে মনে করেন তিনি। যার মধ্যে প্রথমেই পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা করতে হবে। অর্থাৎ আশপাশের পরিবেশ বা জলাশয় পরিষ্কার ও দূষণমূক্ত রাখতে হবে।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে জৈবিক নিয়ন্ত্রণ। এক্ষেত্রে যেসব প্রাণী প্রাকৃতিকগতভাবেই মশা খেয়ে থাকে সেগুলো যেমন গাপ্পি ফিস, ব্যাং, ড্রাগন ফ্লাই-এগুলো ব্যবহার করতে হবে। এগুলোকে প্রকৃতিতে ছাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
তৃতীয়টি হচ্ছে কীটনাশক। দুই ধরণের কীটনাশক রয়েছে যাদের মধ্যে এক ধরণের কীটনাশক লার্ভা ধ্বংস করে এবং অন্যটি পূর্ণ বয়স্ক মশা মেরে ফেলতে ব্যবহার করা হয়।
আর চতুর্থটি হচ্ছে, মশা নিধন কর্মযজ্ঞে জনগণকে সম্পৃক্ত করা। শুধু কোন একটি কর্তৃপক্ষ বা সিটি কর্পোরেশনের একার পদক্ষেপে মশা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি। এর জন্য জনগণের সচেতনতা এবং অংশগ্রহণ দরকার।
‘সাঁড়াশি অভিযান চলছে’
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান বলেন, তাদের পক্ষ থেকে এরইমধ্যে দুটি জরিপ করা হয়েছে যেখানে আসলে মশা বেড়ে যাওয়ার চিত্রটি ধরা পড়েনি।
তবে তার পরও মশা নিয়ন্ত্রণে সম্ভাব্য সব ধরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। এরই মধ্যে কিউলেক্স মশা দমনে ২০শে ফেব্রুয়ারি থেকে বিশেষ সাঁড়াশি অভিযান শুরু করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
এই অভিযান চলবে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এই অভিযানের পর মশা কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
খবর বিবিসি বাংলার