করোনা মহামারিতে বিধ্বস্ত হয়ে পৃথিবীর গোটা জনসংখ্যা যখন গত প্রায় এক বছর ধরে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে উল্লেখিত ভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কারের দিকে, তখন থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রোগজীবাণু বিশারদরা এবং প্রতিষেধক তৈরির কোম্পানিগুলো আদাজল খেয়ে নেমে পড়ে দ্রুততম সময়ে টিকা আবিষ্কার করেছে মানবজাতিকে রক্ষা করার মানসে। সব ওষুধ প্রস্তুত কোম্পানিই যে পুরোপুরি মানবিক বিবেচনায় এ কাজে ব্যস্ত হয়েছিল তা নয়। এদের অনেকেই নেমেছিল মুনাফার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে।
মানবিক কারণে যারা এ উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাদের নাম বলতে গেলে প্রথমেই আসে পৃথিবী শ্রেষ্ঠ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা, যার বিজ্ঞানীরা বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পর সব শেষে করোনা প্রতিরোধক টিকা আবিষ্কার করতে সক্ষম হন, যে টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন লাভ করেছে, লাভ করেছে তাদের আবাসভূমি যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের অনুমোদন। অক্সফোর্ডে গবেষণায় আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন বিশ্বনন্দিত দানবীর, ধনকুবের বিল গেইটস এবং তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠিত গেইটস ফাউন্ডেশন। আরও টিকা বের করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফাইজার কোম্পানি, রাশিয়া এবং চীনের বিভিন্ন কোম্পানি।
ফাইজার নিশ্চিতভাবে একটি মুনাফালোভী কোম্পানি। ’৮০-র দশকে ওই কোম্পানি আকস্মিকভাবেই যৌন উত্তেজক ভায়াগ্রা বড়ি আবিষ্কারের পর তা বাজারজাত করে মুনাফার চরম শিখরে পৌঁছেছিল। তদুপরি তাদের টিকাগুলো প্রয়োগের আগে এত নিু তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয় যা বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই কঠিন। রাশিয়া অনেকটা জোর করেই, অর্থাৎ যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে, তাদের টিকা বাজারে ছেড়েছে বলে অনেক বিশেষজ্ঞই বলেছেন। চীনা কোম্পানির টিকা মাত্র ৫০ শতাংশ কার্যকর বলে যেসব দেশ সে টিকা কিনেছে তাদের অভিযোগ।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কোনো বাণিজ্য সংস্থা নয় বিধায় তাদের কোনো মুনাফা ভাবনা নেই এবং তাদের টিকার মূল্যই সর্বনিু এবং কার্যকারিতার হারও বেশ উঁচু। অক্সফোর্ডের আবিষ্কারের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা।
অক্সফোর্ড তাদের টিকা তাদের ফর্মুলা মতে প্রস্তুত এবং বাজারজাত করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট নামক কোম্পানির সঙ্গে। এ সিরাম ইনস্টিটিউট বিশ্বের সর্ববৃহৎ টিকা প্রস্তুতকারী সংস্থা। পোলিও, হাম, রেবিস, ডিপথেরিয়া, এইচআইভি, বিসিজি, ধনুষ্টংকার, রুবেলা মামস-এর টিকাসহ বহু ধরনের টিকা এ সংস্থা প্রস্তুত করে। এটি সারা বিশ্বের গোটা চাহিদার কমবেশি ৬৫ শতাংশ বিভিন্ন টিকা বাজারজাত করে থাকে। আমাদের জনদরদী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শুরু থেকেই উদগ্রীব ছিলেন দ্রুততম সময়ে সর্বনিু মূল্যে, সর্বোৎকৃষ্ট টিকা আনতে। বিশ্বের সব পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তিনি ভারতের সিরাম কোম্পানি থেকে অক্সফোর্ডের লাইসেন্স, তাদের উপাদান এবং ফর্মুলায় তৈরি টিকা আনার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা টিকাটির গুণগত মান এবং মূল্যের বিবেচনায় ইতিবাচক। যেসব টিকা এ পর্যন্ত বাজারজাত করা হয়েছে, আমাদের কেনা টিকার মূল্য তাদের মধ্যে সর্বনিু। এ জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিতভাবে প্রশংসা এবং সাধুবাদের দাবিদার। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের কিছু লোক দলীয় এবং এমনকি ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে এ টিকা নেওয়া থেকে মানুষকে নিবৃত্ত করার জন্য যেসব প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, নিন্দনীয় বলা খুবই কম হবে। যেখানে এ টিকা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য বিকল্পহীন, সেখানে মির্জা ফখরুল, রুহুল কবির রিজভি, এমনকি ডা. জাফরুল্লাহর কথায় মনে হচ্ছে তারা চায় দেশের মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কাফেলা গড়ে তুলুক, কিন্তু তাদের নিজেদের এবং দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থ যেন প্রাধান্য পায়।
ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং রিজভি সাহেবরা বলছেন, আগে প্রধানমন্ত্রী টিকা নিয়ে প্রমাণ করুক এ টিকা কার্যকর এবং নিরাপদ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার জবাবে যা বলেছেন সেটাই আমরা সবাই ভাবছিলাম। অর্থাৎ প্রথমে টিকা নিলে এই আলমগীর, রিজভি গংরা বলতেন প্রধানমন্ত্রী নিজের স্বার্থ আগে দেখলেন। আমি সেদিনটির জন্য অপেক্ষা করছি যেদিন দেখব ফখরুল-রিজভি গং টিকা নিচ্ছেন।
ডা. জাফরুল্লাহ যে কথা বলেছেন, তার মুখ দিয়ে এ ধরনের মানসিকতাপূর্ণ কথা মানায় না। তিনি বলেছেন, এ টিকা নাকি বুড়িগঙ্গার পানি বা মুরগির টিকা হতে পারে। আমরা সবাই জানি, ভারতের সিরাম কোম্পানি থেকে টিকা আনার ব্যাপারে তার ব্যক্তিগত ক্ষোভের একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, তার গণস্বাস্থ্যের করোনা পরীক্ষার কিট সরকারের অনুমোদন পায়নি। দ্বিতীয়ত, তার প্রিয় চীন থেকে টিকা আনা হয়নি। সুতরাং অনেকটা ব্যক্তিগত কারণে তিনি এ ধরনের বেফাঁস কথা বলে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা যে নষ্ট করছেন, আমি তার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসাবে তাকে সেটি জানিয়ে দেওয়া আমার দায়িত্ব বলে মনে করছি। আমি তার বহু কর্মকাণ্ডেরই প্রশংসক। তাই তার ওপর আমার আস্থা এবং দাবি দুটিই রয়েছে। তার ভিত্তিতেই আমি তাকে বলতে চাই, তার সুনাম এবং কথার বিশ্বাসযোগ্যতাকে এ ধরনের উদ্ভট বাক্য চয়ন দিয়ে নষ্ট করা কাম্য নয়। তিনি অনেক সময় ভালো কথা বলেন। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন উদ্ভট এবং অবিশ্বাস্য কথা বলেন যা তার কথার বিশ্বাসযোগ্যতাকে খর্ব করতে বাধ্য। গত বছর আমাদের সেনাপ্রধান সম্পর্কে ঘটনার সত্যতা যাচাই না করেই কিছু অসত্য কথা বলে পরে নিজেই স্বীকার করেছিলেন, কথাগুলো অসত্য। কিছুদিন আগে এই মর্মে আরও উদ্ভট কথা বলে তার কথার মর্যাদা নষ্ট করেছিলেন যে, ১৯৭১ সালে ফজলে হাসান আবেদ সাহেব যখন একজন নগণ্য, অচেনা ব্যক্তি ছিলেন, তখন তিনি বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত করতে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে একক ভূমিকা রেখেছিলেন। যেহেতু ১৯৭১ সালে আবেদ সাহেব বর্তমান বিশ্বের সর্ববৃহৎ এনজিও ব্র্যাকের স ষ্টা হয়ে ওঠেননি, ব্রিটিশ রানি থেকে স্যার খেতাব পাওয়া থেকে বহু বছর দূরে ছিলেন, সেহেতু তার ওই উদ্ভট বক্তব্যও তার কথার বিশ্বাসযোগ্যতাকে বহু গুণে খণ্ডিত করেছে। স্যার ফজলে হাসান আবেদ জীবিত থাকলে নিশ্চয়ই তিনিও ডা. জাফরুল্লাহর উদ্ভট ভাষণের জন্য লজ্জিত হতেন। একজন চিকিৎসক হিসাবে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের পরিচয় তার কাছে অজানা নয়। এ সিরামের টিকা নিয়ে দুদিন আগে ব্রাজিলের রাষ্ট্রপ্রধান ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, সিরামের টিকা কিনেছেন সৌদি আরবসহ বহু দেশ, গ্রহণ করেছে নেপাল, ভুটানও।
গত ২৭ জানুয়ারি বেশ কিছু লোক এ টিকা নিয়ে যখন জানালেন তারা ভালো আছেন, সুস্থ আছেন, তখন ডা. জাফরুল্লাহ, ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং রিজভিদের মুখ কোথায় রইল? তারা যা বলেছেন, সেগুলো কি জনগণকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার শামিল নয়? এর জন্য কি তাদের বিচার হওয়া উচিত নয়?
ডা. জাফরুল্লাহর সব অভিযোগ যখন ব্যর্থ প্রমাণিত হলো, তখন তিনি ভিন্ন সুরে গাইতে শুরু করলেন এই বলে যে, টিকাগুলো বেশি দামে কেনা হয়েছে। আরও সস্তায় টিকা পাওয়া যেত ইত্যাদি। তার সেই সুর অনুকরণ করলেন বিএনপি নেতারাও। প্রশ্ন হচ্ছে, ডা. জাফরুল্লাহ এসব তথ্য কোথায় পেলেন? তার তো উচিত ছিল টিকার মূল্য সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন তার সমর্থনে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তো কত টাকা দিয়ে এগুলো কেনা হয়েছে, প্রতিটি টিকার মূল্য কত সব খুলেই বলেছেন। তার কথার সত্যতায় প্রশ্ন করতে হলে ডা. জাফরুল্লাহর তথ্য-প্রমাণ দিয়ে কথা বলা উচিত ছিল। আজ এটি প্রমাণিত যে, প্রতিটি টিকা আমরা পাঁচ ডলারে কিনলেও অন্য কেউ সে দামে সিরাম কোম্পানির টিকা কিনতে পারেনি। এটি সত্য যে, এ টিকাই সর্বনিু মূল্যে কেনা হয়েছে। বেক্সিমকোর প্রধান কর্মকর্তা সংসদ সদস্য পাপন সাহেব বলেছেন, ভারতে টিকা যে দামে বিক্রি হচ্ছে, আমরাও সে দামেই কিনেছি। সিরাম ইনস্টিটিউট যে অন্যান্য দেশে আরও বেশি মূল্যে এ টিকা বিক্রি করছে তাও এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ছোটবেলায় এক অত্যাচারী জমিদারের গল্প শুনেছি। তার এক রাইয়ত বিএ পরীক্ষায় পাশ করলে জমিদার ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, বিএ পাস করলে কী হবে, চাকরি পাবে না। এরপর সে প্রজা একদিন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে জমিদার বলেন, তাতে কী আছে, রাইয়ত প্রজা কখনো ভালো চাকরি পাবে না। এরপর সে ছেলে ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি পেলে জমিদার বলতে থাকে, এ ম্যাজিস্ট্রেটের কোনো ক্ষমতা থাকবে না। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে একদিন এক দরিদ্র প্রজাকে প্রহার করেছে জানার পর সেই রাইয়ত প্রজা ম্যাজিস্ট্রেট জমিদারকে গ্রেফতার করার জন্য পুলিশ পাঠিয়ে তার আদালতে আনতে বললেন। আদালতে এসে জমিদারের দম্ভ চূর্ণ হলো, তিনি বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে এবার ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তার সব অপকর্মের জন্য হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলেন। আর আদালতে উপস্থিত বহু রাইয়ত তখন হাসিতে ফেটে পড়লেন।
ফখরুল, রিজভি, জাফরুল্লাহদের একই অবস্থা। তারা প্রথম বলেছিলেন, এ টিকা কখনো আসবে না এবং এটি আসবে না শুনে খুব উৎফুল্ল হয়েছিলেন। পরে যখন জানলেন এটি আসবে, তখন মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বলতে থাকলেন এতে কাজ হবে না, এ টিকা বিপজ্জনক, বুড়িগঙ্গার পানি ইত্যাদি। তারপর যখন দেখলেন জনগণ তাদের কথায় বিভ্রান্ত হয়নি তখন বলতে শুরু করলেন এটি বেশি দামে কেনা হয়েছে।
যারা জনগণের কল্যাণের জন্য রাজনীতি করেন বলে সোচ্চার থাকেন, এ ধরনের জনক্ষতিকর কথা কি প্রমাণ করে না তাদের দাবি আসলে হঠকারিতামূলক?
গত ২৭ জানুয়ারি করোনার টিকাদান কর্মসূচি উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে কুর্মিটোলা হাসপাতালের সেবিকা রুনু ভেরোনিকা কস্তা, বঙ্গবন্ধু চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়াসহ বিশ্বখ্যাত বেশ কয়েকজন এ টিকা নিয়েছেন, যাদের মধ্যে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের যকৃত বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মামুন আল মাহতাব এবং তার স্ত্রী চক্ষু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নুজহাত চৌধুরী শম্পার নাম উল্লেখযোগ্য। তারা সবাই টিকা নেওয়ার পর সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। এরই মধ্যে যারা টিকা নিতে আগ্রহী হয়ে নাম লেখাচ্ছেন তাদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
কে আগে টিকা নিতে পারবে এই নিয়ে শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা। ২৭ তারিখে টিকা নেওয়ার অনুষ্ঠানগুলো উৎসবমুখর পরিবেশে চলেছে। এর ফলে ফখরুল ইসলাম আলমগীর, রিজভি এবং ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী গং-এর কথা অসত্য প্রমাণিত হলো। আরও প্রমাণিত হলো জনগণ তাদের কথায় কান দেয়নি। প্রমাণিত হলো তারা যা বলেছেন তার পেছনে ছিল অশুভ উদ্দেশ্য। এমন অবস্থায় সেই গল্পের সেই গণধিকৃত জমিদারের মতো তাদেরও উচিত হাতজোড় করে জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা।
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি