আন্তর্জাতিক ডেস্কঃলাদাখে চীনা ও ভারতীয় সেনাদের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষের ঘটনায় পরস্পরকে দুষছে বেইজিং ও দিল্লি। এ ঘটনায় সেনাদের প্ররোচনা দেওয়া বন্ধ করে ভবিষ্যতে নিজ বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণের জন্য দিল্লির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। অন্যদিকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর অভিযোগ করেছেন, সেদিন পরিকল্পিতভাবে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলেছিল চীনা বাহিনী। এর জেরেই দুই দেশের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। তবে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসের প্রচ্ছন্ন হুমকি, শুধু বেইজিং-এর নয়, বরং চীন, পাকিস্তান ও নেপালের ত্রিমুখী সামরিক চাপে পড়তে পারে দিল্লি।
সাংহাই একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স ইনস্টিটিউট-এর একজন রিসার্চ ফেলো হু ঝিয়াং। বুধবার গ্লোবাল টাইমস-কে তিনি বলেন, ‘সীমান্ত পরিস্থিতি পরিবর্তনের কোনও ইচ্ছা আদৌ চীনের নেই। ঘটনাটি নিয়ন্ত্রণরেখার চীনা অংশেই ঘটেছে। ফলে সংঘর্ষকালে ভারতের ২০ জন সেনাসদস্য নিহত হয়। এই সংঘাতে ভারতীয় পক্ষ থেকে পুরোপুরি উসকানি দেওয়া হয়েছিল।’
এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক বলেন, ‘ভারত একই সময়ে চীন, পাকিস্তান ও নেপালের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধে জড়িয়েছে। পাকিস্তান চীনের নির্ভরযোগ্য কৌশলগত অংশীদার। নেপালের সঙ্গেও বেইজিং-এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশই চীনের প্রস্তাবিত বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।’
হু ঝিয়াং বলেন, ‘ভারত যদি সীমান্ত উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলে তবে তারা দুইটি বা এমনকি তিনটি ফ্রন্টের সামরিক চাপের মুখোমুখি হতে পারে। এটি দিল্লির সামরিক সক্ষমতার অনেক বেশি বাইরে। এটি বরং ভারতকে একটি বিপর্যয়কর পরাজয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘এখনই এই পরাজয় দিল্লির জন্য বিপর্যয়কর হবে। কেননা সেখানকার উদীয়মান হিন্দু জাতীয়তাবাদ এমন একটি ব্যর্থ পরিণতি মেনে নেবে না এবং মোদি সরকারের পতন ঘটবে।’
এই চীনা বিশ্লেষক বলেন, ‘ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের এই পরিস্থিতি ভুলভাবে নেওয়া উচিত নয়। কেননা, তাদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, চীন-মার্কিন সম্পর্কের অবনতিশীল পরিস্থিতি দিল্লিকে বেইজিংকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সুযোগ করে দেবে। কেননা, চীন বা যুক্তরাষ্ট্র কারও জন্যই ভারত কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।
চীনা বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে গ্লোবাল টাইমস লিখেছে, মোদি সরকারের ভারতে মার্কিনপন্থী শক্তি নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। কেননা চীনকে উস্কে দেওয়ার মতো মূর্খতাপূর্ণ আন্দোলন গুরুতর পরিণতি ঘটাতে পারে।
এদিকে সোমবারের ওই রক্তক্ষয়ী হামলায় নিজেদের ২০ সেনাকে হারানোর কথা স্বীকার করলেও দৃশ্যত চুপ ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এ নিয়ে বিরোধীদের তোপের মুখে পড়তে হয় তাকে।
১৭ জুন বুধবার সকালে এক টুইটে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী চুপ কেন? কেন তিনি লুকিয়ে আছেন? যথেষ্ট হয়েছে! কী ঘটেছে (ভারতীয় সেনাদের প্রাণহানি) তা আমাদের জানতে হবে। আমাদের জওয়ানদের হত্যা করার স্পর্ধা চীনের হয় কী করে? কোন সাহসে তারা আমাদের জমি নিয়ে নেয়?’ কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীসহ বিরোধীদলীয় অন্য নেতারাও এ ইস্যুতে মোদির বক্তব্য দাবি করেন। সমালোচনার মুখে এদিকে করোনাভাইরাস সংকট নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকে এ নিয়ে কথা বলেন মোদি। তিনি বলেন, ‘আমি জাতিকে আশ্বস্ত করতে চাই, সেনাদের আত্মত্যাগ বিফলে যাবে না।’
ভারতীয় সেনাদের প্রাণহানির ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে মোদির নীরবতার ঘটনায় দেশজুড়ে সমালোচনা হলেও ভিন্ন যুক্তি দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, চীনা সেনাদের ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশের কথা স্বীকার করলে মোদি সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার শঙ্কা তো ছিলই। এর সঙ্গে রয়েছে চীন-ভারত বাণিজ্য সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা। উল্লেখ্য, ২০১৭-১৮ সাল পর্যন্ত ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার ছিল চীন।
জেএনইউ-এর সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিটিকস, অর্গানাইজেশন অ্যান্ড ডিসআর্মামেন্ট অ্যাট দ্য স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এর সহকারী অধ্যাপক হ্যাপিমন জ্যাকব। হাফিংটন পোস্টকে তিনি বলেন, ‘যে বিজেপি সরকার জাতীয় নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারার গর্বে সারাক্ষণ বুক চাপড়ে বেড়ায়, চীনা সেনারা ভারতে প্রবেশ করার কথা স্বীকারের মধ্য দিয়ে তাদের ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতে পারে।’
হ্যাপিমন জ্যাকব মনে করেন, বেইজিং যদি নিজে থেকে সেনা প্রত্যাহার না করে, তবে ভারতের পক্ষে সীমান্ত থেকে চীনা বাহিনীকে হটানো সহজ হবে না।’
এমন পরিস্থিতিতে ভারতে দানা বাঁধছে চীনা পণ্য বর্জনের ডাক। দেশটির বিভিন্ন স্থানে চীনের পতাকা এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর কুশপুতুল জ্বালিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছে বিক্ষোভকারীরা। কনফেডারেশন অব অল ইন্ডিয়া ট্রেডার্স-এর মহাসচিব প্রবীণ খানদেলওয়াল বলেন, ‘আমি হয়তো সীমান্তে গিয়ে চীনাদের সঙ্গে লড়াই করতে পারবো না। তবে নিজের জায়গা থেকে আমি যেটা করতে পারি সেটা হচ্ছে ব্যক্তিগতভাবে এবং সারাদেশে ব্যবসায়ীদের পর্যায়ে চীনা পণ্য বর্জন।’ সূত্র: পিপলস টাইমস, রিপাবলিক ওয়ার্ল্ড, টাইমস অব ইন্ডিয়া।