বেনাপোল প্রতিনিধি :: ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে পণ্য আমদানি-রফতানির পাশাপাশি দু’দেশের পাসপোর্ট যাত্রীর ভিড়ে সবসমময় সরগরম বেনাপোল স্থলবন্দর। যানবাহন আর যাত্রীদের ভিড়ে যানজটও নিয়মিত চিত্র। যানজটের কবলে পড়ে স্থানীয়সহ স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতে যাতায়াতকারী দুই দেশের নাগরিকদের সময় নষ্ট হওয়াটাও পরিণত হয়েছিল স্বাভাবিকতায়।
সেই যানজট থেকে রক্ষা পেতে প্রশাসনের উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হয়, বেনাপোল বাজার নয়, বাস ছাড়বে ৪ কিলোমিটার দূরের পৌর বাস টার্মিনাল থেকে। তবে যাত্রীবাহী বাস মধ্যরাত পেরিয়ে ভোর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে পৌঁছালে বেনাপোল চেকপোস্টে যাত্রী নামিয়ে তারপর চলে যাবে টার্মিনালে।
এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন শুরুর পর মধ্যরাতে যাত্রীদের চেকপোস্টে যেতে না দিয়ে টার্মিনালে নামতে বাধ্য করার ঘটনা ঘটেছে। আর সে অভিযোগে বেনাপোল বাস মালিক সমিতি দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। ৪ দিন ধরে দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় বিশেষ করে বন্দর দিয়ে ভারত থেকে আসা যাত্রীরা পড়েছেন বিপাকে। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছাতে ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তাদের।
এ অবস্থায় বিষয়টি নিয়ে রোববার (২৪ নভেম্বর) দুপুরে প্রশাসনের সঙ্গে মালিক সমিতিসহ সংশ্লিষ্টদের বৈঠক হয়েছে। তবে বৈঠক থেকে কোনো সমাধান আসেনি। ফলে বেনাপোল থেকে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দূরপাল্লার সব রুটের বাস চলাচর বন্ধ রয়েছে।
পাসপোর্ট যাত্রীরা বলছেন, সীমান্ত পেরোলেই ভারতের পেট্রাপোল। সেখানে যাত্রীদের সুবিধার্থে ইমিগ্রেশনের সঙ্গেই নির্মাণ করা হয়েছে যাত্রী টার্মিনাল। কিন্তু বেনাপোলে বন্দরসংলগ্ন টার্মিনাল বন্ধ করে দিয়ে ৪ কিলোমিটার দূরের টার্মিনালে পাঠানো হচ্ছে যাত্রীদের। এই ৪ কিলোমিটার দূরত্ব তাদের কাছে বাড়তি চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় রীতিমতো বিপদে পড়েছেন তারা।
পরিবহণ খাত সংশ্লষ্টরা জানান, এক সপ্তাহ আগে যশোরের জেলা প্রশাসকের সঙ্গে স্থানীয় নাগরিক সমাজ ও পরিবহণ কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, বেনাপোল চেকপোস্ট ও বেনাপোল বাজার থেকে যে সব পরিবহণ বাস বা লোকাল বাস ঢাকাসহ বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যায়, সেগুলোকে বেনাপোল বাজার থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে পৌর বাস টার্মিনাল থেকে ছাড়তে হবে। ঢাকা থেকে রাতে ছেড়ে আসা বাসগুলোর যাত্রী ভোরে বেনাপোল চেকপোস্টে নামিয়ে দিয়ে সে বাসগুলি আবার টার্মিনালে চলে যাবে।
বেনাপোল পরিবহণ সমিতির সভাপতি বাবলুর রহমান বাবু বলেন, যানজটের কথা বলে পরিবহণের সব বাস চেকপোস্টের টার্মিনাল থেকে সরিয়ে ৪ কিলোমিটার দূরে কাগজপুকুর টার্মিনাল নিয়ে যায়। গাড়ি সেখান থেকেই ছাড়ার নির্দেশনা দেওয়া হয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা থেকে রাতে ছেড়ে আসা বাসগুলো যাত্রী বেনাপোল চেকপোস্টে নামিয়ে দিয়ে পৌর বাস টার্মিনালে যাচ্ছিল। দিনের ট্রিপ না থাকা বাসগুলো আমরা বেনাপোল চেকপোস্ট ও বেনাপোল বাজার থেকে রাত ৮টা ও সকাল ৮টার মধ্যে ছাড়ছিলাম। আর সারা দিন টার্মিনাল থেকেই গাড়ি ছাড়া হচ্ছিল।
এর মধ্যে শুক্রবার রাতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পরিবহনে আসা যাত্রীদের রাত ৩টার সময় জোর করে টার্মিনালে নামিয়ে দেয়। স্বাভাবিকভাবেই যাত্রীরা ওই সময় নিরাপত্তাহীনতা ভুগেছেন। হয়রানির শিকার হয়েছেন। পরে পৌসভার লোকজন লোকাল বসে করে তাদের চেকপোষ্টে পাঠিয়ে দেয়।
এ ঘটনার প্রতিবাদে দূরপাল্লার বাস বন্ধ রাখা হয়েছে জানিয়ে বাবলুর রহমান বাবু বলেন, লোকাল গাড়ি চেকপোস্টে যেতে পারলে আমাদের গাড়িগুলো কেন যাবে না? আমাদের সঙ্গে এই ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ কেন করছে প্রশাসন? এ ধরনের আচরণের প্রতিবাদেই পরিবহণ মালিক সমিতি বেনাপোল রুটে দূরপাল্লার সব বাস বন্ধ রেখেছে।
ঢাকার যাত্রী আব্দুল আহাদ বলেন, ‘বন্দর থেকে বের হয়ে এসে শুনি এখান থেকে নাকি বাস চলছে না। ট্রেনের খোঁজ করার চেষ্টা করলাম। টিকিট নেই। এখন একটি জেএসএ গাড়িতে করে নাভারন মোড়ের দিকে যাচ্ছি। শুনলাম, ওখান থেকে বাস আছে।’
বেনাপোল পরিবহণ ম্যানেজার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, ‘বৈঠকে জেলা প্রশাসক বলেছেন যে নৌ-পরিবহণ উপদেষ্টার নির্দেশে এটা করা হয়েছে। তার নির্দেশ ছাড়া কিছু করা সম্ভব না। পৌর টার্মিনালেই যাত্রী ওঠানামা করতে হবে। আমাদের দাবি মানা হয়নি। তাই পরিবহণ মালিকরা বলে দিয়েছেন, তারা তাদের গাড়ি এই রুটে চালাবেন না।
বেনাপোল পৌর প্রশাসক ও শার্শার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ড. কাজী নাজিব হাসান বলেন, ‘আমরা তো চেকপোস্টের বাস টার্মিনাল বন্ধ করিনি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বন্দর কর্তৃপক্ষ টার্মিনালের গেট বন্ধ রেখেছিল। ফলে শুক্রবার গভীর রাতে পৌর বাস টার্মিনালে যাত্রী নামিয়ে দিয়েছিল।’ মধ্যরাত বা ভোরে কাউকে বাধা দেওয়া হচ্ছে না জানিয়ে ইউএনও বলেন, ‘শনিবার ভোরের দিকেও চেকপোস্টে যাত্রী নিয়ে গাড়ি গেছে। রাত ১২টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত যাত্রীবাহী বাস চেকপোস্টে গেলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো বাধা দেওয়া হচ্ছে না।’
দায় যারই হোক, চলমান অবস্থায় ভারত থেকে আসা হাজার হাজার যাত্রী পড়েছেন বিপাকে। ঢাকা-চট্টগ্রাম ছাড়াও দেশের অন্যান্য প্রান্তে যারা যাবেন, তারা আটকে পড়েছেন বন্দরে। বাধ্য হয়ে মাইক্রোবাস, ব্যক্তিগত গাড়ির মতো যানবাহনে চড়তে হচ্ছে তাদের। এতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। অনেকে আবার ইজিবাইকসহ অন্যান্য বাহন ব্যবহার করে চলে যাচ্ছেন ১২ কিলোমিটার দূরে নাভারনের সাতক্ষীরা মোড়ে। কেউ কেউ চলে যাচ্ছেন সরাসরি যশোর সদরে। সেসব জায়গা থেকে কাঙ্খিত গন্তব্যের বাস ধরছেন।
যাত্রীরা বলছেন, এ রকম বিকল্প পথে যাতায়াতে ভোগান্তি অনেক বেশি। বিশেষ করে যারা অসুস্থ, তাদের জন্য এই দুর্ভোগ যেন আরও কয়েক গুণ। এর সঙ্গে খরচ আর সময় তো বেশি লাগছেই। অবিলম্বে তারা এ অবস্থার অবসান চাইছেন।