পাবলা সাহাপাড়া এলাকায় তাহমিদের বাড়িতে এখন শোকের আবহ। পঞ্চাশোর্ধ এক নারীকে ঘিরে রয়েছে অন্যরা। মাঝেমধ্যে ভেসে আসছে গোঙ্গানীর শব্দ। তাতে আশপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠছে। তার কান্না দেখে উপস্থিত কেউ চেখে পানি ধরে রাখতে পারেনি। ওই নারী রায়েরমহল কলেজের ডিগ্রী প্রথম বর্ষের ছাত্র তাহমিদের মা। বৃহস্পতিবার দুপুরে দুর্বৃত্তের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে তাহমিদের মা পাগলের মতো প্রলাপ করছেন। ছেলেকে ফিরে পাওয়ার জন্য সকলের কাছে আকুতি করছেন তিনি। শান্তনা দেওয়া ভাষা কারও নেই। উপস্থিত সকলে নিশ্চুপ দাড়িয়ে তাহমিদের মায়ের আহাজারি দেখছেন আর নিরবে চেখের পানি ফেলছেন। কারণ তাহমিদ এ জাগতিক মায়া ছেড়ে যেখানে গেছে সেখান থেকে তাকে আর ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা পৃথিবীর কারও নেই।
তাহমিদের মা সুলতানা আফরোজ বলেন, দুপুরে ভাত খেতে চেয়েছিল। কিন্তু নামাজের কারণে ভাত খেতে পারেনি সে। এরমধ্যে পিয়াল নামে এক যুবক তাকে ডেকে নিয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পর পাশের বাড়ির এক ভাবির মাধ্যমে জানতে পারলাম কাঠমিস্ত্রি পলাশের বাটালির আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে তাহমিদ। তাকে উদ্ধার করে এলাকার যুবকরা খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেছে। হাসপাতলে গিয়ে দেখি আমার বাবার সমস্ত শরীরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়েছে কাঠমিস্ত্রি পলাশ। কি কারণে তাকে মারা হল তা আমি জানিনা।
রাত সাড়ে ৮ টার দিকে তাহমিদের অবস্থা খুব খারাপ হতে থাকে। সে বলতে থাকে মা তুমি আমার পাশ থেকে যেওনা। তুমি চলে গেলে আমি আর হয়ত বাঁচব না। ওর শরীরের অবস্থা আরও খারাপ হলে ওই সময়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে তাকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়। রাত ১২ টার দিকে একজন চিকিৎসক এসে আমাকে জানান, তাহমিদ মারা গেছে। তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লে বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। দুপুরে লাশ বাড়ি নেওয়া হলে বুকের ধন ফিরে পাওয়ার জন্য পাগলের মতো প্রলাপ করতে থাকেন। তখন বার বার মুর্ছা যাচ্ছিলেন নিহতের মা।
এদিকে সকালে নিহত তাহমিদের পিতা তৌহিদুন্নবী বলেন, ঘটনার সময় তিনি বাড়ি ছিলেন না। সংবাদ জানতে পেরে তিনি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। ছেলের অবস্থা খারাপ দেখে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। রাতে মৃত্যুর সংবাদ জেনে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। দুপুরে তাহমিদের লাশ বাড়িতে আনা হলে তিনিও বারবার মুর্ছা যাচ্ছিলেন।
দুপুর দেড়টার টার দিকে তাহমিদের দুলাভাই আর জি উজ্জল লাশ ঘর থেকে মরদেহ বুঝে নেন। দুপুর ২ টার দিকে লাশবাহী গাড়ি বাড়ির সামনে পৌঁছালে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতরণা হয়। এলাকার সকল মানুষ তাহমিদের লাশ এক নজর দেখার জন্য বাড়ির সামনে ভিড় জমাতে থাকে।
কি কারণে খুন হয় তাহমিদ
উঠতি বয়সী যুবক তাহমিদ। পাবলা সাহাপাড়া এলাকায় তার অনেক সহপাঠী রয়েছে। তাদের নিয়ে মঝেমধ্যে ঘটনাস্থলে আড্ডা দিত সে। পাশে ছোট একটি ফার্ণিচারের দোকান ছিল। দোকানের মালিক পলাশ তাকে প্রায় এখানে আড্ডা দিতে নিষেধ করত। এ নিয়ে তাদের মধ্যে প্রায়ই কথা কাটাকাটি হতো। পলাশ যে মনের মধ্যে রাগ পুষে রেখেছে এটি তাহমিদ বুঝতে পারেনি। এরমধ্যে পলাশের দোকান থেকে কয়েকটি যন্ত্রপাতি চুরি হয়ে যায়। চুরি হওয়ার কারণে পলাশ থানায় তাহমিদসহ আরও কয়েকজনের নামে অভিযোগ করে। এটা নিয়ে তাদের উভয়ের মধ্যে বাকবিতন্ডা হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে তাহমিদ কাঠমিস্ত্রি পলাশের কাছে বিষয়টি জানতে চায়। কোন উত্তর না দেওয়ায় তাহমিদ ভাত খাওয়ার জন্য বাড়ি যায়। এরমধ্যে কাঠমিস্ত্রি পলাশ তাহমিদকে ডাকতে পাঠায় পিয়ালের মাধ্যমে। পিয়ালের কথায় তাহমিদ ঘটনাস্থলে পৌছামাত্র কাঠমিস্ত্রি পলাশ বাটলি দিয়ে তাহমিদের শরীরের বিভিন্নস্থানে আঘাত করতে থাকে। পরে ওই এলাকার একজন প্রভাবশালীর বাড়িতে গিয়ে বাটলির রক্ত ধুয়ে পালিয়ে যায়।
থমথমে এলাকা
তাহমিদের মৃত্যুর সংবাদে সাহাপাড়া এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। তাহমিদের মরদেহ বাড়ি নেওয়ার পর এলাকার কিছু মানুষ পলাশের ফার্ণিচারের কাঠ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। সাহাপাড়ার জনৈক কিছলুর বাড়িতে তারা আক্রমণ করে। ঘরের জিনিষপত্র ভাংচুর করে। পথিমধ্যে তার ভাই সাইলুকে স্থানীয়রা মারধরও করে।
থানায় মামলা ও পিয়ালের বয়ান
নিহত তাহমিদের পিতা সৈয়দ তৌহিদুন্নবী বাদী হয়ে দৌলতপুর থানায় পিয়াল ও পলাশের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। দৌলতপুর থানার অফিসার ইনচার্জ মো: নজরুল ইসলাম মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। হত্যাকান্ডের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৪ দিনে আগে পলাশ দোকানের শার্টার নামিয়ে কাজের জন্য বাইরে যায়। এ সময় তার দোকান থেকে কিছু মালামাল চুরি হয়। এ ঘটনায় পলাশ নিহত তাহমিদকে সন্দেহ করে। এ ঘটনার জের ধরে বৃহস্পতিবার দুপুরে তাহমিদকে বাটালি দিয়ে এলোপাতাড়িভাবে কোপাতে থাকে। এ ঘটনায় পিয়াল নামে এক যুবক আটক হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছে। ঘটনার সাথে তার কোন সম্পৃক্ততা নেই বলে পুলিশের কাছে বয়ান দিয়েছে।