২০১৬ সালের ৫ জুন সকাল ৭টা ৩৭ মিনিটে চট্টগ্রামের বহুল আলোচিত মুছার মোবাইল ফোনে কল যায় তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তারের মোবাইল ফোন থেকে। মাত্র ২৭ সেকেন্ডের মোবাইল ফোনের কথোপকথনের রেকর্ডটিই এখন মিতু হত্যার প্রধান আলামত ও সাক্ষী। সালাম দিয়ে মুছা ফোনটি রিসিভ করতেই ওপার থেকে বাবুল আক্তার বলেন, ‘তুই কোপালি ক্যান? ৩/৪ সেকেন্ড থেমে আবার বলেন, বল তুই কোপালি ক্যান? তোরে কোপাতে কইছি? ওপার থেকে মুছার কথা, না মানে’।’ বাবুল আক্তার ফোনটি কেটে দেন। এই ২৭ সেকেন্ড কলের কথোপকথনের রেকর্ড পেয়েই হত্যাকাণ্ডের ১৯ দিন পর ২০১৬ সালের ২৪ জুন রাতে বনশ্রীর শ্বশুরের বাসা থেকে বাবুলকে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে প্রায় ১৪ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তার কিছু দিন পর বাবুল আক্তার পুলিশের চাকরি ছেড়ে দেন। মিতু হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল দুই সন্তান আক্তার মাহমুদ মাহী ও তাবাসুম তাজনিন টাপুরকে নিয়ে ঢাকার বনশ্রীর ভূঁইয়া পাড়ার শ্বশুরবাড়িতে উঠেছিলেন। তবে কয়েক মাস পর আলাদা বাসা ভাড়া করে সন্তানদের নিয়ে চলে যান। বাবুল আক্তার পরে মগবাজারে একটি হাসপাতালের কর্মকর্তা হিসাবে যোগদান করেন।
বাবুল-মিতুর দাম্পত্য কলহ : পরকীয়া প্রেমের এসএমএস নিয়ে বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতুর সঙ্গে দাম্পত্য কলহ ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যায় হত্যার সাত মাস আগে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বাবুল আক্তারের মোবাইল ফোন তল্লাশি করে মিতু আপত্তিকর কিছু এসএমএস দেখতে পান। সেখানে গায়েত্রী এম্মার্সিং নামের এক ভারতীয় নারীর সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্কের তথ্য জানতে পারে মিতু। এ নিয়ে বাবুল আক্তারের প্রত্যহ বাকবিতণ্ডা শুরু হয় দুজনের মধ্যে।
মিতুর পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ১৫ সালের ডিসেম্বরের এক বাবুল আক্তার বিছানার উপর মোবাইল ফোন রেখে বাথরুমে যান। এসময় একটি এসএমএস আসে বাবুলের মোবাইলে। তখন মিতু এসএমএসটি চেক করে দেখতে পান একটি আপত্তিকর বার্তা। তখন মিতু মোবাইলটির সুইস বন্ধ করে বাসার স্টোর রুমে ফোনটি লুকিয়ে রাখে। এরপর বাবুল আক্তার ফোন খোঁজাখুঁজি করলে মিতু ফোনের কথা পুরোপুরি অস্বীকার করেন। পরদিন বাবুল আক্তার বাসা থেকে বের হলে মিতু মোবাইলের সিম বের করে মোবাইলটি অন করেন। এরপর ওই মোবাইল থেকে একে একে ২৯টি এসএমএস (ক্ষুদে বার্তা) পড়েন। পরে এ ব্যাপারটি মিতু প্রমাণ হিসেবে ছেলের ছবি আঁকার আর্ট পেপারে লিখে রাখেন। এদিকে মোবাইল না পেয়ে বাবুল আক্তার ট্র্যাকিং করে নিশ্চিত হন যে তার মোবাইল ফোনটি বাসাতেই রয়েছে। এই মোবাইল ফোন নিয়ে তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ চরমে পৌঁছে। বিষয়টি নিয়ে পরদিন মিতু ফোন দেয় তার মায়ের কাছে।
কি ছিল সেসব ম্যাসেজে: মিতুর মায়ের দাবি করা একটি আর্ট পেপারে লেখা ২৯টি মেসেজের সবগুলোই ইংরেজিতে লেখা। মেসেজগুলোতে গায়ত্রী ও বাবুলের মধ্যে গভীর ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। একটি মেসেজে এমন লেখা হয়েছে, মাই পোয়েট মাই লাভ কাম টু মি’, লাভ ইউ মাই কিং উলড হ্যাভ কিসড ইউ প্যাশোনেটলি, ইফ ইউ ওয়্যার হেয়ার নাউ’, লাভ ইউ বেবি, গুড মর্নিং, কাম টু স্লিপ টু মি’।
গায়ত্রী এম্মারসিং জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক ইউএনএইচসিআর প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশে প্রতিরোধ শাখার একজন কর্মকর্তা হিসাবে কক্সবাজারে কর্মরত ছিলেন। ২০১৩ সালে তখন বাবুল আক্তার কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বর্তমানে গায়ত্রী এম্মারসিং সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় কর্মরত।
যেভাবে হত্যাকাণ্ড : ২০১৬ সালের ২৪ জুন বাবুল আক্তারের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ওই বছরের ২৬ জুন আনোয়ার ও মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম নামে দুজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানায় পুলিশ। তারা আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলে, কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুছার ‘পরিকল্পনাতেই’ এ হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়। জবানবন্দিতে ওয়াসিম জানায়, নবী, কালু, মুছা ও তিনি হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয়। হত্যার সময় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের সামনে ছিল মুসা, এরপর আনোয়ার ও একদম পেছনে ছিল সে।
মোটরসাইকেলের পিছন থেকে সে প্রথমে মিতুকে গুলি করে। জিইসির মোড়ে আগে থেকে ওঁত পেতে থাকা নবী তার বুকে, হাতে ও পিঠে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে। পুরো সময়টা বাবুল আক্তারের ছেলেকে আটকে রেখেছিল মুসা। এরপর মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা চলে যায়। পরে এ ঘটনায় সন্দেহভাজন দুই আসামি নূরুন্নবী ও রাশেদ পুলিশের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। মুছাসহ দুইজন আসামি গুম হয়ে গেছে। এই মামলায় বর্তমানে ওয়াসিম ও আনোয়ার গ্রেফতার হয়ে কারাবন্দী। নবী, কালুসহ ৩ জন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।