ফকির শহিদুল ইসলামঃখুলনায় রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল শ্রমিকদে আমরণ অনশনের তৃতীয় দিনে অসুস্থ হয়ে আব্দুস সাত্তার (৫৫) নামে এক পাটকল শ্রমিক নিহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় তিনি মারা যান। আব্দুস সাত্তার প্লাটিনাম জুট মিলের শ্রমিক ছিলেন। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক খলিলুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, আজ দুপুরে আব্দুস সাত্তার অনশনরত অবস্থায় সকালে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ অবস্থায় তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ধ্যায় মারা যান তিনি।
প্লাটিনাম জুট মিলের সিবিএ সাধারণ সম্পাদক মো. হুমায়ুন কবির খান বলেন, অনশনে থাকা অবস্থায় অসুস্থ হয়ে গেলে প্লাটিনাম জুট মিলের শ্রমিক সাত্তারকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তবে তাৎণিকভাবে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ দিকে, তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বিুব্ধ শ্রমিকদের গগনবিদারী স্লোগানে কেপে ওঠে গোটা শিল্পাঞ্চল।
উল্লেখ্য,পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি হিসেবে ১০ ডিসেন্বর মঙ্গলবার দুপুর থেকে কাঁথা-বালিশ নিয়ে দিন-রাত আমরণ অনশনে বসেছেন খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের শ্রমিকরা। দাবি আদায়ে গত মঙ্গলবার বিকেল ৩টা থেকে নিজ নিজ মিলগেটের সামনের বিআইডিসি সড়কে তাঁরা আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করছেন। কর্মসুচির তৃতীয় দিনে প্লাটিনাম জুট মিলের শ্রমিক সাত্তার মৃত্যু বরন করে । একজন শ্রমিকের মৃত্যুর সংবাদে শ্রমিকদের ডাকা আমরণ অনশনে তাঁদের পরিবারের সদস্যরাও অংশ নেন । ১১ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি থেকে না ফেরার ঘোষণাও দিয়েছেন শ্রমিকরা।
বকেয়া সাপ্তাহিক মজুরি পরিশোধ, মজুরি কমিশন বাস্তবায়নসহ ১১ দফা দাবিতে দির্ঘদিন যাবত বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে এ অঞ্চলের শ্রমিকরা। আর এই কর্মসূচির ডাক দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদ।
সংগ্রাম পরিষদের নেতারা জানান, পূর্বঘোষিত কর্মসূচির আজ তৃতীয় দিন চলছে । আন্দোলনে খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকলের মধ্যে ৮টি মিলের শ্রমিকরা অংশ গ্রহন করছে। শুধু যশোরের জেজেআই জুট মিলের শ্রমিকরা আন্দোলনের অন্যান্য কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও অনশন কর্মসূচিতে অংশ নেয়নি । এ কারনে ঐ মিলের সাধারন শ্রমিক ও সিবিএ নেতাদের মধ্যে চলছে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ। ১০ ডিসেন্বর মঙ্গলবার সকাল থেকে কর্মসূচি শুরু হওয়ার কথা থাকলেও খুলনায় আ’লীগের সম্মেলনের কারণে কর্মসূচি শুরুর সময় নির্ধারণ করা হয় দুপুর থেকে।
এর আগে গত রবিবার খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের শ্রমিকরা ওই আমরণ অনশন কর্মসূচি সফল করতে শপথ নিয়েছিলেন। নিজ নিজ মিল গেটে অনুষ্ঠিত সভা থেকে শ্রমিকরা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ওই কর্মসূচি সফল করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। এসময় খুলনা শিল্পাঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলগুলোর মিল গেটে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল।
রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম-আহ্বায়ক মোঃ মুরাদ হোসেন বলেন, সোমবার রাত থেকেই অনশনের জন্য প্যান্ডেল তৈরি করা হয়। মঙ্গলবার দুপুর থেকে প্যান্ডেলের ভেতরে শ্রমিকরা আসতে শুরু করে। প্যান্ডেল কানাই কানাই পূর্ণ হয়। শ্রমিকরা অনেকেই প্যান্ডেলের ভিতরে থাকতে পারছেন না। কাঁথা বালিশ নিয়ে তারা এখানে রাত-যাপন করেন। দিন-রাত শ্রমিকরা অনশনে থাকায় অনেকে ঠান্ডাজনিত কারনে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ইতিমধ্যে আমাদের প্লাটিনাম জুট মিলের শ্রমিক আব্দুস সাত্তার ভাই মৃত্যুবরন করছেন । তার এই মৃত্যুর শোককে শক্তিতে পুরন করে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
খুলনা অঞ্চলে ৯টি রাষ্ট্রায়ত্তপাটকল রয়েছে। এর মধ্যে খুলনায় রয়েছে সাতটি ও যশোরে রয়েছে দুটি। খুলনায় থাকা পাটকলগুলো হলো ক্রিসেন্ট জুট মিল, খালিশপুর জুট মিল, দৌলতপুর জুট মিল, প্লাটিনাম জুট মিল, দিঘলিয়ায় স্টার জুট মিল, আটরায় আলিম জুট মিল ও ইস্টার্ন জুট মিল। আর যশোরের দু’টি জুট মিল হলো-কার্পেটিং ও জেজেআই।
মহানগরীর খালিশপুরে অবস্থিত চারটি পাটকল। দেশের সবচেয়ে বড় ক্রিসেন্ট জুট মিলের শ্রমিকরা অবস্থান নেন মিলের সামনে বিআইডিসি সড়কে। প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে কাপড় টানিয়ে প্যান্ডেল তৈরি করে অনশনে বসেছেন। বাকী সড়কও শ্রমিকরা আটকে দিয়েছে। এরপরই রয়েছে প্লাটিনাম জুট মিল। ওই জুট মিলের শ্রমিকরা পুরো সড়ক জুড়েই অনশনের স্থলে প্যান্ডেল তৈরি করেন। ফলে সড়কটি বন্ধ হয়ে গেছে। চলাচল করতে পারছে না কোন যানবাহন। এছাড়া ওই এলাকায় থাকা খালিশপুর ও দৌলতপুর জুট মিলের শ্রমিকরা অবস্থান নিয়েছেন নিজ নিজ মিল গেটেস্থ বিআইডিসি সড়কে। গত মঙ্গলবার দুপুর থেকেই কাঁথা-বালিশ নিয়ে শ্রমিকরা অনশনস্থালে আসতে শুরু করে। আশ্রয় নেন সড়কে তৈরি প্যান্ডেল অভ্যন্তরে। প্যান্ডেলের ভেতরেই তৃতীয় দিনের ন্যায় রাত কটিয়েছেন শ্রমিকরা। প্যান্ডেলের মধ্য্য অনেকে অসুস্থ হলে দেখা যায় স্যালাইন পুশরত অবস্থায় শ্রমিকরা শুয়ে আছেন । নামাজের সময় হলে প্যান্ডেলে আদায় করেন নামাজ। প্লাটিনাম জুট মিলের শ্রমিকদের অনশনস্থলে কথা হয় শ্রমিক জামাল হোসেন ও ক্রিসেন্ট জুট মিলের আঃ হক ও সেলিমের সাথে। তারা বলেন,আমাদের দাবি সাপ্তাহিক মজুরি নিয়ে নয়। আমরা আন্দোলন করছি মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন, পাটকলকে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রক্রিয়া বাতিল ও পাটখাতে পযাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দেওয়া এবং সপ্তাহের মজুরী সপ্তাহে প্রদান,অবসর প্রাপ্ত শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনার দাবিতে। এই দাবিগুলো বাস্তবায়নে সরকার বার বার প্রতিশ্রুতি দিয়েও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করছে না । এখন আমাদের ১১দফা দাবী পুরন হলেই অনশনসহ সকল কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হবে । রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বিভিন্ন সমস্যা জর্জরিত থাকায় প্রভাব পড়ে শ্রমিকদের উপর। মিলগুলোর আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকা ও উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে না পারার কারণে শ্রমিকদের মজুরিও ঠিক মতো পরিশোধ করা হয় না। এসব কারণে শ্রমিকরা বিভিন্ন সময় আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছেন। সর্বশেষ নভেম্বরের শেষ দিক থেকে ১১ দফা দাবিতে নতুন করে আন্দোলন শুরু করেছেন শ্রমিকরা। ছয় দিনের কর্মসূচির সর্বশেষ কর্মসূচি হচ্ছে আমরণ অনশন করা। একই দাবি আদায়ে দিঘলিয়ার স্টার জুট মিলের প্রধান ফটকের সামনে অনশন কর্মসূচি পালন করেছে শ্রমিকরা।
আটরা শিল্প এলাকার আলিম ও ইস্টার্ন জুট মিলের শ্রমিক কর্মচারীরা তাদের পোষ্যদের নিয়ে গতকাল দুপুর ২টায় ইস্টার্ন জুট মিল ১নং গেটে আমরণ গণ-অনশন কর্মসূচিতে অংশ নেন। ইস্টার্ন জুট মিল সিবিএ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোঃ আকছার আলীর সভাপতিত্বে আলিম জুট মিলের মোঃ আমিরুল ইসলাম ও ইস্টার্ন জুট মিলের মোঃ সিরাজুল ইসলামের পরিচালনায় বক্তৃতা করেন আলমগীর হোসেন, আঃ হক মহলদার, হাফেজ আঃ সালাম, আমিরুল ইসলাম, ইজদান আলী, মোজাম্মেল হক, হাসান শরীফ, আঃ রব মোল্লা আঃ রশিদ, আঃ মজিদ মোল্লা, শেখ জাকারিয়া, সর্দার আনোয়ার হোসেন, মেহেদি হাসান বিল্লাল, মনিরুল ইসলাম আকুঞ্জি, শেখ শামিমুল ইসলাম, ইদ্রিস আলী অনশন চলাকালে সন্ধায় আন্দোলনরত শ্রমিক কর্মচারীদের ন্যায় সঙ্গত দাবির পে সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন আটরা গিলাতলা ইউপি চেয়ারম্যান শেখ মনিরুল ইসলাম।