সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নিয়ে বৈরাম খান প্রথমেই এগিয়ে যান বিকানিরের দিকে। এরপর বিকানির থেকে তিনি অগ্রসর হন পাঞ্জাব বরাবর। পাঞ্জাবের দিপালপুর থেকে তিনি দূত মারফত আকবরের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে সে যোগাযোগ বাধাগ্রস্থ হয়। বাধ্য হয়ে বৈরাম খান সিদ্ধান্ত নিলেন জলন্ধর দখল করে নেওয়ার। এ উদ্দেশ্যে চলনসই সেনাবাহিনী গঠনেও হাত দিলেন তিনি।
এদিকে বৈরাম খানের বিদ্রোহ ঘোষণা ও সামরিক পদক্ষেপের প্রেক্ষিতে আকবরও দিল্লি ত্যাগ করে জলন্ধরের দিকে অগ্রসর হলেন। তবে ইতোমধ্যেই শামসুদ্দিন আতাগা খানের নেতৃত্বে মুঘল সেনাবাহিনীর একটি অংশ বৈরাম খানকে পরাজিত করে তার বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে সক্ষম হলো। পরাজিত হয়ে বৈরাম খান আশ্রয় নিলেন তিলওয়ারাহ দুর্গে। এখানে শক্তি সঞ্চয় করে তিনি আবারো রাজকীয় বাহিনীর মুকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে লাগলেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য যেন বৈরাম খানের পিছু ছাড়ছিল না। মুনিম খানের নেতৃত্বাধীন রাজকীয় সেনাবাহিনীর হাতে এই তিলওয়ারাহেই তিনি আরেকবার পরাজিত হলেন। বৈরাম খান ঘটনা আর সামনে বাড়াতে চাইলেন না। আকবরের কাছে তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করে আত্মসমর্পণ বার্তা পাঠালেন।
এরপর বৈরাম খান নিজেই আকবরের সামনে উপস্থিত হলেন। আকবর বয়সের দিক থেকে তরুণ হলেও নিজের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত অভিভাবকের সাথে অন্যায় করতে পারলেন না। বৈরাম খানকে তিনি ক্ষমা করে দিলেন। এরপর তাকে হজ্বে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে আকবর ১৫৬০ সালের শেষ নাগাদ পাঞ্জাব থেকে দিল্লি হয়ে আগ্রা পৌঁছান।
২
এদিকে বৈরাম খান হজ্বে যাওয়ার জন্য যাত্রা করলেন। কিন্তু যাত্রাপথেই ঘনিষ্ঠদের উস্কানিতে আবারো বিদ্রোহ করে বসলেন। বৈরাম খানকে দমন করতে আকবরকে আবারো সেনাবাহিনী পাঠাতে হলো। শিবালিক পাহাড়ের পাশে বিপাশা নদীর তীরে আরেকটি যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হলো। তবে বৈরাম খান এবারও সৌভাগ্য থেকে দূরে রইলেন। রাজকীয় বাহিনীর হাতে তাকে আবারো পরাজয় বরণ করতে হলো। এই যুদ্ধে বৈরাম খান নিজেও বন্দী হলেন।
ইতোমধ্যেই আকবর লাহোরে এসে পৌঁছেছিলেন। বৈরাম খানকে লাহোরে আকবরের কাছে নিয়ে আসা হলো। কিন্তু, তাকে আকবর মোটেও অসম্মান করলেন না। পূর্ণ মর্যাদার সাথে অভ্যর্থনা জানালেন। আমির থেকে শুরু করে সবাই অভ্যর্থনা জানাতে বৈরাম খানের কাছে ছুটে গেলেন। আকবরের নিকট উপস্থিত হলে বৈরাম খানকে আগের মতোই আকবরের ডানদিকে বসানো হলো।
বৈরাম খান আবারো আকবরের নিকট ক্ষমা চাইলেন। আকবর হাসিমুখেই বৈরাম খানকে ক্ষমা করে দিলেন। একই সাথে বৈরাম খানের সামনে তিনটি প্রস্তাব রাখলেন। এক, বৈরাম খান চাইলে হিন্দুস্তানে থেকে যেতে পারেন। এক্ষেত্রে তাকে কালপি ও চান্দেরীর শাসনক্ষমতা দেওয়া হবে। দুই, মুঘল দরবারে বৈরাম খান আকবরের ব্যক্তিগত পরামর্শক হিসেবে আকবরের সাথেই থাকতে পারবেন। তিন, দুই শর্তের কোনো শর্তই যদি তিনি না মানেন, তাহলে আকবর অনুরোধ করলেন বৈরাম খানকে মক্কায় হজ্ব করতে চলে যেতে। মক্কায় হজ্ব করতে পাঠানো মানে এক রকমের নির্বাসনেই পাঠানো।
বৈরাম খান একজন বিজ্ঞ ও আত্মমর্যাদাবান মানুষ ছিলেন। তিনি পূর্বেই মুঘল সাম্রাজ্যের মুকুটহীন সম্রাটে পরিণত হয়েছিলেন। তাই সেই তুলনায় নিতান্তই তুচ্ছ কোনো পদ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। বৈরাম খান এবার সত্যিই হজ্বে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
৩
বৈরাম খান মক্কার উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললেন। যাত্রা করলেন রাজপুতানার মধ্য দিয়ে। যাত্রাবিরতি করলেন গুজরাটের পাটানে। গুজরাটের গভর্নর মুসা খান ফুলদি তাকে পূর্ণ মর্যাদার সাথে অভ্যর্থনা জানালেন।
তিনি কিছুদিন গুজরাটে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিলেন। গুজরাটে অবস্থানকালে গুজরাটের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে সময় কাটাতেন। তার জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে যুদ্ধে যুদ্ধে। প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার সময় পেয়েছেন কম। হিন্দুস্তান ত্যাগের সময় অবসরের এই সময়ে তাই দু’চোখ ভরে ভালোবাসার হিন্দুস্তানকে হয়তো দেখে নিতে চাইছিলেন তিনি। কিন্তু, তিনি হয়তো জানতেন না যে তিনি কোনদিনই আর হিন্দুস্তান ত্যাগ করতে পারবেন না।
১৫৬১ সালের জানুয়ারী মাসের ৩১ তারিখ। বৈরাম খান এইদিন একটি মনোরম বাগান দেখতে ছোট একটি নদী পাড়ি দিয়ে অপর পাড়ে পৌঁছালেন। হঠাৎ মোবারক খান নামের এক আফগান যোদ্ধার নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন আফগান বৈরাম খানকে ঘিরে ধরে এলোপাথাড়ি ছুরিকাঘাত করে। প্রচুর রক্তক্ষরণে মুঘল সাম্রাজ্যে প্রতাপশালী এই লোকটি কিছুক্ষণের মাঝেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৬০ বছর।
সম্রাট হুমায়ুন যখন হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধার করতে এগিয়ে আসছিলেন, তখন তিনি মাছিওয়াড়ায় একটি যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই যুদ্ধে মোবারক খানের পিতা নিহত হয়েছিল। বৈরাম খানের এই দুর্দিনে সুযোগ বুঝে মোবারক খান পিতৃহত্যার শোধ নিয়ে নিল। তিনি সেই যুদ্ধে বীরের মতো লড়াই করে জয় তুলে নিয়েছিলেন, কিন্তু সেই বিজয়ের মূল্য শোধ করতে হলো এভাবে একদল কাপুরুষের হাতে জীবন দিয়ে।
ঘাতকরা বৈরাম খানকে হত্যা করে রাস্তাতেই ফেলে যায়। কয়েকজন লোক তার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে কবর দিয়ে দেয়। মোবারক খান আর তার উশৃঙ্খল আফগান সৈন্যরা তাকে হত্যা করলেও তার পরিবারের কোনো ক্ষতি করেনি। তার পরিবারকে পরবর্তীতে আকবরের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল।
৪
বৈরাম খানের মৃত্যুর খবর গুজরাটে জানার পর দ্রুতই সেই খবরটি আকবরের কাছে পাঠানো হলো। বৈরাম খান আর এই পৃথিবীতে নেই, এটা জেনেই আকবর শোকে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। বৈরাম খান প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন, মুঘল রাজদরবারে ছিল তার শত্রুতে ভরা, কিন্তু তাও বৈরাম খানের এ ধরনের পরিণতি মেনে নিতে কেউই প্রস্তুত ছিল না। গোটা প্রাসাদে শোকের ছায়া নেমে এলো।
বৈরাম খানের জন্য আকবরের অনুতাপ ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি ছিলেন আকবরের অভিভাবক, যাকে ছাড়া সম্ভবত আকবর মুঘল সাম্রাজ্যের মসনদে নিজেকে কখনোই প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন না। আর সেই তিনি কিনা গুপ্তঘাতকদের হাতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করলেন। বৈরাম খান আর আকবরের মাঝে ঘটে যাওয়া দুঃখজনক এই ঘটনাগুলোর জন্য আকবর পরবর্তীতে বেশ অনুতাপ করেছিলেন, কিন্তু যা হয়ে গেছে তা আর ফেরানো যায় না।
তার মৃত্যুর সংবাদ শোনার সাথে সাথেই আকবর বৈরাম খানের মৃতদেহ ফতেহপুর সিক্রিতে নিয়ে আসার জন্য সেনাবাহিনীর চৌকস একটি ইউনিটকে পাঠিয়ে দিলেন। এই গ্রুপটির উপর আরেকটি দায়িত্ব ছিল বৈরাম খানের পুরো পরিবারকে ফতেহপুর সিক্রিতে নিয়ে আসা। একই সাথে তার হত্যাকারী গ্রুপের প্রতিটি সদস্যকে খুঁজে আটক করা।
বৈরাম খানের মৃতদেহ ফতেহপুর সিক্রিতে আনা সম্ভব হলো না। কারণ, স্থানীয় মানুষজন বৈরাম খানকে শনাক্ত করতে না পেরে আগেই কবর দিয়ে ফেলেছিল। আর, মোবারক খান ও তার দলের কাউকেই আটক করা সম্ভব হলো না। তারা আগেই গা ঢাকা দিয়ে ফেলেছে। তবে বৈরাম খানের পরিবারকে ফতেহপুর সিক্তিতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো। আকবর নিজে ব্যক্তিগতভাবে বৈরাম খানের ৪ বছরের পুত্র আবদুর রহমানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আর, বৈরাম খানের স্ত্রী সেলিমা সুলতানা বেগমকে বিয়ে করে নিজের স্ত্রীর মর্যাদা দেন।
বৈরাম খানের স্ত্রী সেলিমা সুলতানা বেগম কিন্তু সম্পর্কের দিক দিয়ে আকবরেরই ফুফাতো বোন ছিলেন। সেলিমা সুলতানা বেগমে মা গুলরুখ বেগম ছিলেন আকবরের পিতা সম্রাট হুমায়ুনের বোন।
অন্যদিকে সম্পর্কের দিক দিয়ে আকবর ছিলেন আবদুর রহমানের মামা। তবে সেলিমা সুলতানা বেগমকে বিয়ে করার পর আবদুর রহমান আকবরের পুত্রস্নেহেই বড় হয়েছিলেন। তাকে পূর্ণ রাজকীয় সুযোগ সুবিধাদি দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে আবদুর রহমান আকবরের বিখ্যাত সেই নবরত্ন সভার একজন হয়েছিলেন। একই সাথে তিনি মুঘল সেনাবাহিনীর চৌকস একজন জেনারেলও ছিলেন। পরবর্তীতে তিনিও তার পিতার মতোই খান-ই-খানান উপাধী প্রাপ্ত হয়েছিলেন। দক্ষতা, বীরত্ব, আনুগত্য দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে তিনি বৈরাম খানের রক্তই নিজের ভেতরে ধারণ করছেন।
৫
সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুতে মুঘল সাম্রাজ্যের এক অস্থির সময়ে বৈরাম খান মুঘল সাম্রাজ্যের হাল ধরেছিলেন। তার দ্রুত পদক্ষেপ আর বিচক্ষণতার কারণেই আকবর সম্রাট হিসেবে মসনদ ধরে রাখতে পেরেছিলেন। আর এর ফলে গৃহযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল মুঘল সাম্রাজ্য।
সম্রাট আকবর ও বৈরাম খানের মধ্যে যা হয়েছে, তা বাস্তবিক অর্থেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ছিল। তবে বৈরাম খানও কিছু রাজনৈতিক ভুল করে ফেলেছিলেন। যেকোনো ক্ষমতাবানই তার পাশে উদীয়মান ক্ষমতাশালী কাউকে ভয় পাবেন। আর বৈরাম খান তো রীতিমতো নিজেকে মুঘল সাম্রাজ্যের মুকুটহীন সম্রাটে পরিণত করে ফেলেছিলেন। এর ফলে একপর্যায়ে আকবর ও তার মা হামিদা বানু নিজেদের নিরাপত্তাহীন ভাবতে শুরু করলেন।
আকবর একটা পর্যায়ে ষড়যন্ত্রকারীদের দ্বারা প্রাভাবিত হয়ে বৈরাম খানকে নিজের ক্ষমতার প্রতি হুমকি মনে করলেও কখনোই বৈরাম খানের এ পরিণতি চাননি। তবে তাতে কিছু যায় আসে না। যা হওয়ার, তা হয়ে গেছে। বৈরাম খান বলতে গেলে তার পুরোটা জীবনই মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য লড়াই করেছেন, সেই তুলনায় পেয়েছেন অনেক কম। তবে সত্যিকার মহান মানুষদের জন্য প্রাপ্তির হিসাবটা কোন খুব বড় কোন বিষয় না। তাদের কর্মই তাদের পরিচয়, তাদের কর্মই তাদের প্রাপ্তি।
৬
ক্ষমতাবানদের ক্ষমতা রক্ষার ক্ষেত্রে যুদ্ধ ভয়ংকর। আর প্রাসাদ ষড়যন্ত্র আরো ভয়ংকর। কারণ, যুদ্ধক্ষেত্রে অন্তত লড়াই করে জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু, সময়মতো টের না পেলে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র প্রচণ্ড ক্ষমতাধর ব্যক্তিকেও নিমেষেই বোকা বানিয়ে দিতে পারে। যেমনটি হয়েছিল খান-ই-খানান বৈরাম খানের ক্ষেত্রে। প্রচণ্ড শ্রদ্ধাবোধ থেকে সম্রাট আকবর বৈরাম খানকে ডাকতেন খান বাবা। কিন্তু, ভয়ংকর এক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে বৈরাম খান ও আকবর দুজনে কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখলেন সব শেষ।
বৈরাম খানের বিরুদ্ধে সংগঠিত এ প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের পেছনে ছিলেন মূলত আকবরের দুধ মা মাহাম আগা, শিহাবুদ্দিন আতাগা, কাশিম খান, মাহাম আগার পুত্র আদম খানসহ দরবারের বেশ কিছু মন্ত্রী। এছাড়া এই দলে ছিলেন স্বয়ং আকবরের মা হামিদা বানুও। মূলত বৈরাম খানের ক্ষমতা দখলের ভয় দেখিয়ে হামিদা বানুকে ষড়যন্ত্রকারীরা নিজেদের দলে ভিড়িয়ে নিয়েছিল।
ছেলের ভবিষ্যতে শঙ্কায় হামিদা বানুও তাদের সাথে একসাথে কাজ করে গিয়েছেন। তাদের সম্মিলিত পরিকল্পনাতে প্রতাপশালী বৈরাম খান মুহূর্তেই ভেঙ্গে পড়লেন, এবং একপর্যায়ে ঘাতকদের হাতে খুন হলেন।
ঘটনা এ পর্যন্ত এসে থামলেও হতো। কিন্তু তা আসলে হয়নি। মাহাম আগার নেতৃত্বাধীন প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারী এ গ্রুপটি একপর্যায়ে খোদ আকবরের উপরেই প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। বৈরাম খানের পতন এই গ্রুপটিকে বিশাল একটি বিজয় এনে দিয়েছিল। কারণ বৈরাম খান বিহীন আকবরকে নিয়ন্ত্রণ করা বেশ সহজ একটি কাজ। বৈরাম খানের মৃত্যুর পর কিছুদিনের জন্য হয়েছিল সেরকমই।
তবে আকবর শীঘ্রই সবকিছু অনুধাবন করতে পারলেন। তিনি এটাও বুঝতে পারলেন মাহাম আগাকে তিনি যতটা বিশ্বাস করেছিলেন, তিনি আসলে ততোটা বিশ্বাসের উপযুক্ত না।
সমসাময়িক মুঘল ঐতিহাসিকগণ মাহাম আগাকে প্রচণ্ড বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ ও উচ্চাকাঙ্খী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বাস্তবিক অর্থে মাহাম আগা সেরকমই ছিলেন। তবে তার সবচেয়ে বড় ভুলটি ছিল সন্তান-স্নেহের কাছে পরাভূত হয়ে যাওয়াটা। বৈরাম খানের পর সাম্রাজ্যের কর্তৃত্বের অনেকটাই চলে যায় মাহাম আগার কাছে। আর তিনি তার সেই ক্ষমতা ব্যবহার করছিলেন তার পুত্র আদম খানের জন্য রাস্তা পরিষ্কার করার কাজে। ঘটনার সূত্রপাত বৈরাম খানের মৃত্যুর কিছুদিন পর থেকেই।
১৫৬১ সালের শুরুর দিকে সম্রাট আকবর মালবে বাজবাহাদুরের বিরুদ্ধে একটি অভিযান প্রেরণ করেন। মাহাম আগার সুপারিশে এ অভিযানের নেতৃত্ব পান তার পুত্র আদম খান। পীর মুহাম্মদও ছিলেন এ সেনাবাহিনীতে। ২৯ মার্চ সংগঠিত যুদ্ধে বাজবাহাদুর পরাজিত হন ও পালিয়ে যান। মালবের কোষাগারের বিপুল সম্পদ আর হেরেম আদম খান বাজেয়াপ্ত করেন। নিয়ম অনুযায়ী এ সবই প্রথমে সম্রাটের কাছে পাঠানোর কথা ছিল।
কিন্তু, আদম খান তা না করে আকবরের কাছে মাত্র কয়েকটি হাতি প্রেরণ করে বিজয়ের সংবাদ দেন। কিন্তু, পরে সম্রাট জানতে পারেন যে, যুদ্ধের পরে আদম খান কোষাগার আত্মসাৎ তো করেছেনই, সেই সাথে মালবে অপ্রয়োজনীয় প্রচুর রক্তপাত ঘটিয়েছেন এবং লুটপাট করেছেন। এমনকি নারী ও শিশুদের সাথেও চরম বর্বর আচরণ করা হয়েছিল। সব জেনে আকবর বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
তবে মাহাম আগার হস্তক্ষেপে সে যাত্রায় আকবর আদম খানকে ক্ষমা করতে বাধ্য হন। এর কিছুদিন পরেই মালবের প্রশাসক হিসেবে আদম খানকে বরখাস্ত করে সে জায়গায় পীর মুহাম্মদকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
৭
এতকিছুর পরেও মাহাম আগা ও তার পুত্রের ঔদ্ধত্ব দিন দিন বাড়তে থাকলো। একপর্যায়ে আকবর সিদ্ধান্ত নিলেন এই গ্রুপটির হাত থেকে তাকে বের হতে হবে। তা না হলে স্বাধীনভাবে কখনোই তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। তাছাড়া তিনি নিজেও যে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কবলে পড়বেন না, সে ব্যপারে কে নিশ্চয়তা দিতে পারে?
ষড়যন্ত্রকারীদের ঘেড়া টোপ থেকে বের হওয়ার জন্য সে বছরের শেষের দিকে তিনি পাঞ্জাবের গভর্নর শামসুদ্দিন মুহাম্মদ আতাগা খানকে দরবারে ডেকে আনেন। সংক্ষেপে তিনি আতাগা খান হিসেবেই বেশি পরিচিত। আতাগা খান ছিলেন আকবরের আরেক দুধ মা জিজি আগার স্বামী। সে হিসেবে আকবর আতাগা খানকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস করতেন। পাঞ্জাব থেকে ডেকে এনে আকবর তাকে উজির-এ-আজম হিসেবে নিয়োগ দেন। তখন থেকে তার উপাধী হয় খান-ই-খানান।
একদিকে আদম খানকে মালবের গভর্নর পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে, অন্যদিকে শামসুদ্দিন মুহাম্মদ আতাগা খানকে প্রধান উজির নিয়োগ দেওয়ায় মাহাম আগা ও তার দলটি বেশ চাপে পড়ে যায়। বেশ কিছু ঘটনার প্রেক্ষিতে একপর্যায়ে ১৫৬২ সালের ১৬ মে আদম খান আতাগা খানকে হত্যা করে বসে।
মাহাম আগার দ্বিতীয় এই পুত্রটি ব্যক্তিগতভাবে প্রশাসন চালানোর জন্য অযোগ্য তো ছিল, সেই সাথে তিনি ছিলেন প্রচণ্ড উচ্চাকাঙ্খী কিন্তু অত্যাচারী, অবিবেচক ও অদূরদর্শী ছিলেন। শামসুদ্দিন আগাতা খানকে হত্যা করে তিনি যেন বার্তা দিতে চাইলেন যে, সম্রাট হয়তো আকবর, কিন্তু ক্ষমতা আসলে তার ও তার মায়ের কাছে। তবে অদূরদর্শী আদম খান বুঝতে পারলেন না যে তার সময় আসলে শেষ হয়ে এসেছে।
আতাগা খানকে হত্যার কিছুক্ষণ পরেই আদম খানকে গ্রেফতার করা হলো। এরপর হত্যাকাণ্ডের অপরাধে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে দুর্গের দ্বিতীয় তলার ছাদ থেকে নিচে ফেলে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হলো। আদম খানকে নিচে ফেলে দেয়া হলো। কিন্তু দেখা গেলো আদম খান তখনো অর্ধমৃত হয়ে বেঁচে রয়েছেন। আকবরের নির্দেশে আদম খানকে আবারো নিচ থেকে তুলে আনা হলো। এরপর দ্বিতীয়বারের মতো ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হলো। এবার আর আদম খানের বেঁচে থাকার কোনো সুযোগই ছিল না। সমাপ্তি ঘটলো আদম খান অধ্যায়ের।
আদম খানের মৃত্যুর খবর আকবরই মাহাম আগাকে দিয়েছিলেন। পুত্রশোকে মাহাম আগার সমস্ত দর্প চূর্ণ হয় এবং পুত্রের মৃত্যুর ৪০ দিন পরে তিনিও মৃত্যুবরণ করেন।
৮
মাহাম আগার মৃত্যুর পর পরই বৈরাম খানের পতনের পেছনে দায়ী প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারী গ্রুপটিও ভেঙ্গে যায়। এরপর যারা জীবিত ছিল, তারাও আকবরের আনুগত্য স্বীকার করে নেয়। আকবরও তাদের ক্ষমা করে দেন। আকবর নিজেকে একজন স্বাধীন সার্বভৌম শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার দিকে এক ধাপ এগিয়ে গেলেন।
বৈরাম খানের মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে ১৫৬২ সাল পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্য শাসিত হচ্ছিল আসলে হেরেম থেকে। আকবর যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে শাসক ছিলেন, তবে অল্প বয়সের সুযোগে তাকে প্রভাবিত করছিল তারই উচ্চাকাঙ্খী দুধ মা মাহাম আগা। এ কারণে পাশ্চাত্যের অনেক ঐতিহাসিকই এ সময়কার মুঘল প্রশাসনকে বলেছেন ‘পেটিকোট গভর্নমেন্ট’ (Petticoat Government)। তবে উপমা হিসেবে এই নামটি কতটা গ্রহণযোগ্য সে প্রশ্ন রয়েই যায়।
কারণ, যে অর্থে উপমাটি ব্যবহার করা হয়েছে, পরিস্থিতি আসলে ততটা সেরকম ছিল না। বৈরাম খানের মৃত্যুর পর কিছুদিন আকবরকে প্রভাবিত করা সম্ভব হলেও শীঘ্রই আকবর বুঝে যান কে তার বন্ধু আর কে তার শত্রু। অল্প সময়ের মাঝেই তিনি সমস্ত ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করে বের হয়ে যেতে সক্ষম হন।
বৈরাম খান হয়তো আকবরের ঘনিষ্ট লোকদের মনের কথা ঠিকমতো পড়তে পেরেছিলেন। আর এ কারণেই সম্ভবত তিনি তাদের আকবরের আশেপাশে ঘেষতে দিতে চাইতেন না। তবে সম্পূর্ণ একা অবস্থায় আকবর যেভাবে সবকিছু সামলে নিয়েছিলেন, তা দেখে যেতে পারলে বৈরাম খান নিশ্চয়ই গর্ববোধ করতেন।