নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে শনিবার দায়িত্ব নিয়েছেন ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। এরমধ্য দিয়ে ডিএসসিসিতে সমাপ্তি ঘটেছে সাঈদ খোকন অধ্যায়ের। তবে মেয়রের দায়িত্ব ছাড়লেও অভিযোগ পিছু ছাড়ছে না সাঈদ খোকনের। দায়িত্ব ছাড়ার পরই কাউন্সিলর ও ডিএসসিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে তার আমলের দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে শুরু হয়েছে নানা গুঞ্জন।
অভিযোগ আছে, ডিএসসিসির প্রতিটি কাজে ঠিকাদারদের থেকে ২০ শতাংশ হারে কমিশন নিতেন সাবেক এই মেয়র। এ কারণে অনেকে তাকে ‘মিস্টার টুয়েন্টি পার্সেন্ট’ মেয়র বলেও অভিহিত করেন। এ নিয়ে নগর ভবনে ছিল নানা আলোচনা-সমালোচনা। এছাড়া ক্যাসিনোকাণ্ডে সাঈদ খোকনের সম্পৃক্ততা ছিল বলেও অভিযোগ আছে। তবে এসব দুর্নীতি তিনি সরাসরি করতেন না। এই কাজে সাবেক এই মেয়রের ডানহাত ছিলেন তার একান্ত সচিব (এপিএস) কাজী আবুল কালাম আজাদ ও পিএস-২ শেখ কুদ্দুস।
চলতি বছরের শুরুর দিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মুখোমুখি হতে হয় আজাদ ও কুদ্দুসকে। দুদকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, ক্যাসিনো ব্যবসা ও অন্যান্য অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা অবৈধ প্রক্রিয়ায় বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। মূলত তাদের মাধ্যমে দুর্নীতির ভাগ পৌঁছুতো সাঈদ খোকনের পকেটে।
এ বছরের জানুয়ারিতে সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের ইঙ্গিত দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে চলমান দায়িত্বে থাকায় তার বিরুদ্ধে তখন পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়নি বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এবার সাঈদ খোকনকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তার বিরুদ্ধে তদন্তে আর কোনও বাধা রইলো না।
এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যানের ঘোষণা, ‘দুর্নীতি যেখানেই ঘটেছে, সেখানেই তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। আর ১০ শতাংশ বা ৫ শতাংশ- এসব বিষয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে দুর্নীতি হয়েছে কিনা- সেটা যদি ১ শতাংশও হয়, সেটাও দুর্নীতি।’
তিনি জানুয়ারিতে এক অনুষ্ঠানে আরও বলেন, ‘ওয়েট অ্যান্ড সি। দুর্নীতিটা কীভাবে ঘটেছে, সেটা যদি পিএস, এপিএসরা বলতে পারে, আমরা খুঁজে বের করবো। সুতরাং চিন্তা করার কোনো সুযোগ নেই যে আমরা পিএস, এপিএস দিয়ে শেষ করবো। পিএস, এপিএস ছাড়াও যারা যুক্ত ছিলেন, যুক্ত হয়েছেন বা যুক্ত আছেন, আমরা খুঁজে বের করে আইনে আওতায় আনবো।’
এর বাইরেও ডিএসসিসির সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- ঢাকাবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থতা, প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে না পারা, দলীয় কাউন্সিলরদের মূল্যায়ন না করা, করপোরেশনের ঠিকাদারি কাজ নিজের লোকদের দিয়ে করানো, হকার উচ্ছেদ নিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা ও ব্যর্থতা, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা না বাড়ানো এবং ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে অপ্রত্যাশিত বক্তব্য এবং তা আনতে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা। যদিও সাঈদ খোকন দাবি করেছেন, কর্তব্যে তিনি কখনও অবহেলা করেননি।
গত বছর রাজধানীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এ ব্যর্থতার দায়ভার মেয়র হিসেবে খোকনের ওপরই পড়ে। এরই মধ্যে ২৫ জুলাই এক অনুষ্ঠানে খোকন ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যাকে ‘গুজব’ বলে মন্তব্য করেন।
গত সিটি নির্বাচনের আগে সাঈদ খোকন নগরবাসীকে বেশকিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এগুলোর মধ্যে ছিল- নাগরিকদের জন্য ফুটপাত উন্মুক্ত করা, বুড়িগঙ্গা স্বরূপে ফিরিয়ে আনা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন করা, ডিজিটাল নগরী প্রতিস্থাপন, অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ, মাঠ ও পার্ক উদ্ধার, বস্তি উন্নয়ন ও যানজটমুক্ত ঢাকা গড়া।
কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতির কোনোটাই পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। সর্বশেষ ঢাকার প্রধান সড়ক থেকে রিকশা উঠিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েও তিনি বাস্তবায়ন করতে পারেননি।
এছাড়া মেয়র পদে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাঈদ খোকন শুরু থেকে নানা বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দেন। ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর আজিমপুরে আওয়ামী লীগের কর্মী সমাবেশের পাশে পাল্টা কর্মসূচি দেন খোকন। এমনকি ওই সমাবেশস্থলের সামনে ট্রাকে করে সিটি কর্পোরেশনের ময়লা ফেলা হয়।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বেশ কয়েক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠে, যা দলের ইমেজ নষ্ট করেছে। দলীয় রাজনীতিতেও কোন্দলে জড়িয়ে পড়েন তিনি। নগর আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ তার ওপর ক্ষুব্ধ।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আওয়ামী লীগের দলীয় কাউন্সিলরদেরও বড় একটা অংশকে তিনি কোণঠাসা করে রেখেছেন। ফলে অভ্যন্তরীণ গ্রুপিং ও দ্বন্দ্ব মিটিয়ে তার পক্ষে দলীয় নেতাকর্মীদের মাঠে নামানো কঠিন হয়ে পড়ত। দায়িত্বে অবহেলাসহ নানা অভিযোগ কাঁধে নিয়েই মেয়রের চেয়ার ছাড়তে হয়েছে সাঈদ খোকনকে।