চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃকেউ সাগর থেকে নৌকায় করে নিয়ে আসছে মাছ, কেউবা ঝুড়িতে করে মাছ নিয়ে আসছে মহালে বালুর চরে। আবার পলিথিন কিংবা তেরপালে ছিটিয়ে রোদে শুকাচ্ছে সেই মাছ। এভাবে চলছে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপকূলের গহিরার চরে গড়ে ওঠা বিষমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন শুটকি পল্লী। এ এভাবে উপকূলের তিন গ্রামের জেলেরা ব্যস্ত সময় পার করছেন।
সাধারণত বিভিন্ন সময় ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও বর্ষা মৌসুমে জোয়ার ভাটার ক্ষত এই গ্রামগুলোর এখনো মুছে যায়নি। এমনকি বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের আঘাতে বেড়িবাঁধ ভাসিয়ে বাড়িঘরও বিলীন হয়ে পড়ে। সর্বহারা উপকূলের এসব বাসিন্দারা আবার ও স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। চেষ্টা করছে জীবন পরিবর্তনের। এখন তারা মাছ শিকার করে, সেই মাছ শুকিয়ে ও বিক্রি করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন। চেষ্টা করছেন ঘুরে দাঁড়ানোর। নভেম্বরের শুরুতে মাছ শুকানোর কাজ শুরু হয়েছে আর তা চলবে আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত। এ কাজে জেলেদের পাশাপাশি উপকূলের শিশু ও মহিলারাও কাজ করে যাচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সাগরে পাতানো ভাসমান ও টং জালে আহরিত সামুদ্রিক বিভিন্ন প্রজাতির মাছ জেলেদের নৌকা থেকে উঠানো হচ্ছে। সেখানে জেলেদের কাছ থেকে পছন্দের মাছগুলো কিনে মহালে নিয়ে যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা। এসব মাছ প্রথমে মহালে সংরক্ষণ করা হয়। পরে পরিশুদ্ধ করার পর এসব কাঁচা মাছে আংশিক লবণ মেশানো হয়। তারপর গিট তৈরি করে এগুলো শুকানোর জন্য ওই মহালের একাধিক মাচায় টাঙানো হয়। চিংড়ি ও ফাইস্যা জাতীয় মাছগুলো বিছানো পলিথিনে ছিটিয়ে শুকানো হয়।
উৎপাদিত শুটকিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে লইট্যা, ছুরি, ফাইস্যা, চইক্যা, পোয়া ও চিংড়িসহ নানা প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ। রায়পুর ইউনিয়নের বাতিঘর এলাকা থেকে বার আউলিয়া পর্যন্ত তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চলছে শুটকি শুকানোর কাজ। এতে পুরুষের পাশাপাশি নারী ও শিশু শ্রমিকেরাও কাজ করছেন। জেলে ও ব্যবসায়ীরা জানান, তিন কিলোমিটার সমুদ্র সৈকতে ৩০ জনের বেশি ব্যবসায়ীর তত্ত্বাবধানে ৫০০ শ্রমিক কাজ করছেন। তবে সমুদ্র থেকে মাছ ধরাও শুটকি শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন ৫ শতাধিক পরিবারের লোকজন।গহিরা এলাকার জেলে মোহাম্মদ ইলিয়াছ বলেন, সমুদ্র থেকে মাছ ধরে মাঝারি আকারের নৌকায় করে উপকূলে নিয়ে আসি। তার মধ্যে চিংড়ি, লটিয়া, কাটামাছসহ বিভিন্ন জাতের মাছ এক সঙ্গে বিক্রয় করি। এসব মাছ শুকিয়ে ব্যবসায়ীরা কেজি প্রতি তিন থেকে চার শত টাকা লাভ করেন।
অন্যান্য বছর আনোয়ারার স্থানীয়রা একাজ করলেও গত দুই ধরে বছর কক্সবাজারের পেকুয়া ও চকরিয়া থেকেও জেলেরা এসে শুটকির কাজ করছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
পেকুয়া থেকে আসা জেলে ছৈয়দ নুর (৩১) জানান, তাঁর নিজস্ব অর্থায়নে গহিরার চরে শুটকি উৎপাদনের জন্য একটি মহাল তৈরি করেছেন। প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ কেজি সামুদ্রিক মাছের শুটকি উৎপাদিত হচ্ছে ওই মহালে। কোনো ধরনের কীটনাশক প্রয়োগ ছাড়াই প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদিত হচ্ছে।
একই এলাকার শ্রমিক কামাল (১৭) বলেন, এলাকায় আর কোন কাজ নেই, কোনো অবৈধ ব্যবসাও করিনা। তাই সংসারের খরচ চালাতে দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরিতে এখানে কাজ করি। সমুদ্র থেকে আনা মাছ শুকানোসহ অন্যান্য কাজে এলাকার বহু মানুষ জড়িয়ে পড়ায় এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে এলাকায় সচ্ছলতা এসেছে।
জানা যায়, এখানকার উৎপাদিত শুটকি স্বাদে ও মানে প্রসিদ্ধ হওয়ায় স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। স্থানীয় খুচরা বাজারে প্রতি কেজি লইট্যা ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা, ফাইস্যা ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা, ছুরি ৭০০ থেকে ৯৫০ টাকা, বড় চিংড়ি (চাগাইছা) ১৩০০ থেকে ১৫০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া শুটকি মহালের মাছের গুড়ি পোল্ট্রি ফার্ম ও ফিস ফিডের জন্য সরবরাহ হয়ে থাকে।
আনোয়ারা উপজেলার জৈষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা সৈয়দ হুমায়ন মোরশেদ বলেন, উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নে শুটকির ব্যবসায় স্থানীয় লোকজনের অভাব ঘোচাচ্ছে। আনোয়ারা উপকূলে প্রায় ৩০টি মহালে প্রচলিত নিয়মে শুটকি উৎপাদন করা হচ্ছে। বিষমুক্ত শুটকি উৎপাদনের ক্ষেত্রে জেলেদের সচেতনতামূলক পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ডিডিটি পাউডার বা কীটনাশক না মেশালে শুটকির প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায়।