ভূস্বর্গ খ্যাত কাশ্মির ফিরে পেতে চলেছে তার প্রাচীন গরিমা। ভারত সরকারের উপযোগী পদক্ষেপ আর কাশ্মীরের জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত ইচ্ছাশক্তি পাহাড়ের কোলে আবার ফিরিয়ে আনতে উদগ্রীব সেই চিরশান্তির ঠিকানা।
প্রকৃতির অপরূপ শোভায় শোভিত কাশ্মীর ভারতের বর্তমান সরকারের সদিচ্ছা আর সঠিক নেতৃত্বের গুণে আত্মঘাতী সর্বনাশা হিংসার পথ ছেড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়। বিভাজনের রাজনীতি ভুলে উপত্যকা এখন ফের ডানা মেলতে চায় নিজের চিরাচরিত সম্প্রীতির আবহাওয়ায়।
প্ররোচনা ছিল। আছেও। কিন্তু পাকিস্তানের শত প্ররোচনাতেও আজ আর কাজ হচ্ছে না কাশ্মীরে। সেখানকার মানুষ বুঝতে পেরেছে ভারত সরকার কতটা আন্তরিক তাদের সমস্যার সমাধান ঘটিয়ে প্রকৃত উন্নয়নে।
বিভেদের বদলে তাই ফের বাজতে শুরু করেছে মিলনের সুর। গোটা দেশের সঙ্গে কাশ্মীরও এখন উন্নয়নের মহাসড়কে সওয়ার। উপত্যকার উন্নয়নে প্রশংসিত হচ্ছে কেন্দ্রের এক গুচ্ছ কর্মসূচি।
মন ভোলানো কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়ে নয়, কাশ্মীরের বাস্তবসম্মত উন্নয়নকেই গুরুত্ব দিচ্ছে ভারত সরকার। দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপত্যকা কাশ্মীরে ব নার তো কোনো প্রশ্নই নেই।
উল্টো সবচেয়ে বেশি গুরুত্বই পাচ্ছে উপত্যকার মানুষ। সরকারের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ থাকলেও বোধহয় কাশ্মীর নিয়ে ধোঁয়াশাও বেশি রয়েছে দেশ-বিদেশে। অনেক কিছু আজও অজানা রয়ে গেছে কাশ্মীর সম্পর্কে।
সন্ত্রাসবাদীদের কার্যকলাপে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল কাশ্মীরের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। সময় এসেছে সে গৌরবময় অতীতের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপের। কাশ্মীরের মানুষ এখন সে ইতিহাসকেই তুলে ধরতে চায় সাধারণ মানুষের কাছে। কিন্তু পাকিস্তানি কুচক্রে চাপা পড়ে যাচ্ছে কাশ্মীরিদের আকাক্সক্ষা। আক্ষরিক অর্থেই বোধহয় কাশ্মীর ভূস্বর্গ।
প্রকৃতির সৌন্দর্যই শুধু নয়, কাশ্মীরের ইতিহাসও বেশ গৌরবময়। ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান কাশ্মীরে রয়েছে বিভেদের মাঝে মিলনের মহান ঐতিহ্য। অথচ সে ঐতিহ্যের কথা চাপা পড়ে গেছে আজ। ভারতের বর্তমান সরকার তাই স্বায়ত্তশাসনের মোড়কে কাশ্মীরি জনগণকে নিয়ে মানুষের ধোঁয়াশা কাটাতে বদ্ধপরিকর।
খুব কম লোকই জানে কাশ্মীরের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের ঐতিহাসিক সম্পর্কের কথা। মহামতি অশোকের আমলে বৌদ্ধধর্ম প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হয়ে ওঠে কাশ্মীর। বৌদ্ধধর্মের দুটি প্রধান সম্প্রদায় মহাযান ও হীনযান (গ্রেট হুইল ও লেসার হুইল)। রাজা কণিষ্কের সময় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এখান থেকেই মধ্য এশিয়ায় যাত্রা করেছিলেন।
কাশ্মীর থেকেই চীন, তিব্বত হয়ে বিভিন্ন দেশে প্রসার ঘটানো হয়েছে বৌদ্ধধর্মের। অহিংসার শাশ্বত বাণীর সঙ্গে প্রচারিত হলো ভারতের প্রাচীন সংস্কৃতি। এখানকার ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি সবকিছুই বিস্তৃত হলো গোটা বিশ্বে। আজ অনেকেই ভুলে গেছেন, একসময় কাশ্মীর ছিল বৌদ্ধদের অন্যতম বিচরণ ভূমি। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা সবার সঙ্গে মিলেমিশে শান্তিতে বসবাস করতেন কাশ্মীরে। এখান থেকেই তাঁরা চীন হয়ে দূরদূরান্তে বিস্তার ঘটান বৌদ্ধধর্মের।
পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত কাশ্মীর ছিল হিন্দুদের অন্যতম বিচরণ ভূমি। হিন্দুধর্মের শৈবদের কাছে এটি ছিল শিবের উপাসনাস্থল। বৌদ্ধ ও শিবভক্ত হিন্দুরা মিলেমিশে কাশ্মীরে তৈরি করেছিলেন এক নৈসর্গিক পরিবেশ। দুই ধর্মের মানুষই একে অন্যের সঙ্গে মিলেমিশে একসঙ্গে থাকতেন। তাদের উপাসনার ধরন আলাদা হলেও কোথাও কোনো বিভেদ ছিল না। কাশ্মীরের মানুষ সম্প্রীতিতে বিশ্বাস করতেন। পরে সুফিদের হাত ধরে মহান ইসলাম ধর্ম কাশ্মীর উপত্যকায় প্রবেশ করে। সুফিরা মানবকল্যাণের কথা বলে সম্প্রীতির আবহাওয়ায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে কাশ্মীরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইসলাম ধর্মকে। কোথাও কোনো বিরোধ ছিল না।
ধর্ম ও চিন্তার বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও অশান্তিকে কেউই ঢুকতে দেননি উপত্যকায়। অসহিষ্ণুতা ও ধর্মান্ধ উগ্রবাদের বিপরীতে হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে খুব শান্তিতেই বসবাস করতেন। একে অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়াতেন। হিন্দুদের শৈব সাধক লালদেদ ও মুসলিম ধর্মগুরু শেখ নুর-উদ-দীনের মধ্যে ছিল খুব সখ্য। এই যুগল একসঙ্গে হিন্দুধর্মের সঙ্গে সঙ্গে ইসলামেরও প্রচার করেন। কাশ্মীরিদের চেতনায় তারা ফুটিয়ে তোলেন নৈতিকতা ও সামাজিকতার নতুন অধ্যায়। বিকশিত হতে থাকে কাশ্মীরি সভ্যতা। লালিত হয় তাঁদের ঐতিহ্যপূর্ণ লোকসংস্কৃতি।
কাশ্মীরের পঞ্চদশ শতাব্দীর মহান রাজা সুলতান জয়ন-উল-আবিদীনের শাসনকালে সে ঐতিহ্য আরও বিকশিত হয়। প্রজাদের কাছে তিনি ছিলেন বুদ শাহ বা মহান রাজা নামে পরিচিত। হিন্দু পন্ডিরাও তাঁকে ভট্ট শাহ বা পন্ডিতদের রাজা বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। ধর্ম নয়, কাশ্মীরের নিজস্ব ঘরানাকেই তাঁরা বেশি শুরুত্ব দিয়েছিলেন। সেই সংস্কৃতিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় ধর্মীয় সহনশীলতা। কাশ্মীরে ধর্মীয় সহনশীলতা ও সুশাসনের এক অভূতপূর্ব যুগের সূচনা করেছিলেন তিনি।
মুসলিম রাজা হয়েও তিনি হিন্দু মন্দির পুনর্গঠন করেছিলেন। হিন্দু উৎসবেরও আয়োজন করা হয়েছিল তার আমলে। মুঘল সম্রাট আকবরের সময়ও সেই পরম্পরা বজায় ছিল। জিজিয়ার মতো বৈষম্যমূলক কর তুলে দিয়েছিলেন তিনি। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা করব্যবস্থা বাতিল করা হয় আকবরের আমলে। সকল প্রজার ধর্মবিশ্বাসের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছিলেন আকবর। এই একই যুগ ছিল যখন ইউরোপে ধর্মবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে পুরুষ ও মহিলাদের হত্যা করা অস্বাভাবিক ছিল না।
সে সময় পাশ্চাত্যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অনেককেই শিকার হতে হয়েছে বর্বরতার। মানুষের রক্তে হোলি খেলেছে তথাকথিত সভ্য দেশের মানুষ। কিন্তু মুঘল আমলেও কাশ্মীর ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসীদের বিচরণ ভূমি। মানুষের বিশ্বাসের ওপর কেউই আঘাত করতে চাননি।
কাশ্মীরকে নিজেদের কব্জায় আনার চেষ্টা করেছে অনেকেই। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনকাল থেকেই কাশ্মীরিদের ওপর নেমে আসতে শুরু করে অত্যাচার। শিখরাও দখল করতে চেয়েছে কাশ্মীরের শাসনক্ষমতা। কিন্তু তখনো পরিস্থিতি ছিল শান্ত। ভারতে ব্রিটিশ যুগের অবসান এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র গঠনের পরই শুরু হয় কাশ্মীরকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। শুরু থেকেই কাশ্মীরকে অস্থির করে তোলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত পাকিস্তান। কাশ্মীরিদের আবেগকে নিয়ে তারা শুরু করে ছিনমিনি খেলা।
সম্প্রীতির বাতাবরণ ধ্বংস করতে সব ধরনের চেষ্টা করে পাকিস্তান। নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে নাগরিকদের দৃষ্টি এড়াতে কাশ্মীর নিয়ে অপপ্রচারকেই হাতিয়ার করে তারা। অসম্ভব জেনেও কাশ্মীরের যুবকদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে পাকিস্তান। কাশ্মীরকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখিয়ে বহু যুবককে আত্মঘাতী পথে ঠেলে দেয় ইসলামাবাদ। অশান্তির আগুনে থমকে দাঁড়ায় ভূস্বর্গের উন্নয়ন। ভারতকে টুকরো টুকরো করার অবাস্তব চিন্তাধারা থেকে কাশ্মীরের মাটিতে ধ্বংসাত্মক রাজনীতিতে পাকিস্তানকে মদদ দিতেও কার্পণ্য করেনি দু-একটি দেশ। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সেখানকার উন্নয়ন। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে মার খায় কাশ্মীরের চিরাচরিত শান্তির পরিবেশ। সুফির সুর থমকে দাঁড়ায় বন্দুকের নলের সামনে। বহু মেধা হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। সবই পাকিস্তানের ধ্বংসাত্মক রাজনীতির কুফল।
আশার কথা, পাকিস্তানের সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কাশ্মীরিদের বড় অংশ এ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়নি। ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীও চেয়েছিলেন কাশ্মীর হয়ে উঠুক হিন্দু-মুসলিমের মিলনভূমি। বিভাজন নয়, বৈচিত্র্যের মধ্যে মিলনই ভারতের সংস্কৃতি। কাশ্মীরও তার ব্যতিক্রম নয়। ধর্ম নয়, নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি দিয়েই তো প্রতিটি কাশ্মীরি একসূত্রে বাঁধা। ধর্মাচরণ আলাদা হতেই পারে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে বিভেদ বা অশান্তি কাশ্মীরের ঐতিহ্য বা পরম্পরাবিরোধী। বহুত্ববাদ উপত্যকার ঐতিহ্য। বহুকাল ধরেই তো সেটাই হয়ে এসেছে।
কাশ্মীরিরা সেটা ভালোই বুঝেছেন। ভাষা ও সংস্কৃতিকেই তারা আগলে ধরতে চান সম্প্রীতি পুনরুদ্ধারে। কাশ্মীরকে দূরে সরিয়ে রেখে নয়, কেন্দ্রশাসিত অ লের মর্যাদা দিয়ে ভারতীয় মূল ভূখন্ডের সঙ্গে আরও শক্তপোক্তভাবে আগলে রাখতে চায় ভারত। ভারতের গর্ব কাশ্মীরে তাই নতুন করে শুরু হয়েছে হাজারো কর্মকাণ্ড। স্থানীয় স্তর থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে দেশের সবচেয়ে সুন্দর জনপদকে। কাশ্মীরিদের উন্নয়নে ভারত সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
অতীতের মিশ্র সংস্কৃতি, বহুত্ববাদ, সৌভ্রাতৃত্ব কাশ্মীরিদের অহংকার। তাই সেই কাশ্মীরকে আরও সুন্দর করে সাজিয়ে তুলতে বদ্ধপরিকর ভারত সরকার। সেখানকার মানুষের কল্যাণকে দেওয়া হচ্ছে অগ্রাধিকার। বন্দুকের নল দিয়ে নয়, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দিয়েই আবার সুফির সুরে ভাসতে চলেছে উপত্যকা। ভারত সরকার সে চেষ্টাই চালাচ্ছে আন্তরিকতার সঙ্গে। বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও গঠনমূলক কর্মসূচির হাত ধরে কাশ্মীর ফের ভুস্বর্গের মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে এখন সকলে বদ্ধপরিকর।
যেখানে একটি ভাষা এবং একটি সংস্কৃতি সব কাশ্মীরিকে এক করে দেয়। আজ স্থানীয় রাজনৈতিক কান্ড এবং শক্তিশালী ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ জাতীয় নেতৃত্বের সঙ্গে কাশ্মীরিদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে যা কিছু করার জন্য প্রস্তুত, সেখানে প্রতিশ্রুতি রয়েছে যে বহুত্ববাদ, সহিষ্ণুতা ও কাশ্মীরিয়তের উত্তরাধিকার-কাশ্মীরের বৈশিষ্ট্য, যা খুব সুন্দরভাবে তৈরি করা হয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। তাই, চেনা ছন্দে ফিরবেই অতীতের কাশ্মীর। এটাই অঙ্গীকার ভারত সরকারের। সেই অঙ্গীকার পালনে চেষ্টা চলছে পুরোদমে। চলছে কর্মযজ্ঞও।