সাবেক মার্কিন অভিনেত্রী ও ডাচেস অব সাসেক্স মেগান মার্কেল বলেছেন, ব্রিটিশ রাজপরিবারে তার জীবন এতো বেশি কঠিন হয়ে পড়েছিল যে এক সময় ‘তিনি আর বেঁচে থাকতে চাননি।’ মার্কিন টিভিব্যক্তিত্ব অপরাহ্ উইনফ্রেকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে মেগান বলেন, তিনি যখন সাহায্য চেয়েছেন তখন তিনি সেটি পাননি। ব্রিটিশ সম্প্রচারমাধ্যম বিবিসি সোমবারের অনলাইন প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে।
ব্রিটিশ রাজপরিবারের জৌলুশপূর্ণ জীবনে থেকেও যে ভালো ছিলেন না এবং রাজপরিবারের ভেতরেও বর্ণবাদের বিষয়টি জানিয়ে প্রিন্স হ্যারির স্ত্রী বলেন, সবচেয়ে খারাপ সময়টি ছিল যখন রাজপরিবারের এক সদস্য হ্যারিকে তাদের ছেলের গায়ের রং নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল যে সে ‘কতটা কালো’ হতে পারে।
প্রিন্স হ্যারিও বলেছেন, তিনি যখন সরে আসতে চেয়েছিলেন, তখন তার বাবা প্রিন্স চার্লসও তার ফোন ধরাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র সময় রোববার (৭ মার্চ) রাতে বহুল-প্রতীক্ষিত এই সাক্ষাৎকার সিবিএস টিভিতে সম্প্রচার করা হয়।
সিবিএস-এর দুই ঘণ্টার এই বিশেষ অনুষ্ঠানটিতে— যেটি যুক্তরাজ্যে সোমবার আইটিভিতে সম্প্রচারিত হবে— এই দম্পতি বিভিন্ন বিষয়; যেমন বর্ণবাদ, মানসিক স্বাস্থ্য, গণমাধ্যমের সাথে তাদের সম্পর্ক এবং রাজপরিবারের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন।
তারা জানান যে, আসছে গ্রীষ্মে তারা আবার বাবা-মা হতে যাচ্ছেন এবং এই সন্তানটি একটি মেয়ে।
২০২০ সালের মার্চে রাজ পরিবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগের পর এই দম্পতি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন। গত মাসেই তারা ঘোষণা দেন যে রাজপরিবারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য হিসেবে তারা আর ফিরবেন না।
Meghan
‘আমাকে সুরক্ষা দেওয়া হয়নি’
মেগান বলেন, একসময় তিনি একাকী বোধ করতে থাকেন যখন তাকে বলা হয় যে, তিনি কী করতে পারবেন আর কী করতে পারবেন না। এমন এক সময় দাঁড়ায় যখন তিনি মাসের পর মাস বাড়ি থেকে বের হননি।
অপরাহ্কে তিনি বলেন, তিনি এক সময় ভাবতে শুরু করেন ‘এর চেয়ে বেশি একা হওয়া সম্ভব নয়।’
অপরাহ্ তাকে জিজ্ঞেস করেন যে, এক পর্যায়ে গিয়ে তিনি নিজের ক্ষতি করার বা আত্মহত্যার চিন্তা করেছিলেন কিনা? উত্তরে মেগান বলেন, ‘হ্যাঁ। এটা খুব বেশি স্পষ্ট ছিল। খুব স্পষ্ট এবং ভয়ংকর। সে সময় বুঝতে পারছিলাম না যে কার কাছে যাবো।’
মেগান বলেন, গর্ভবতী থাকা অবস্থায় হ্যারির সাথে রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে এক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সময়কার এক ছবির কারণে ‘আতঙ্কবোধ’ করেছিলেন তিনি। ‘কারণ ওই অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে আগে সকালে হ্যারির সাথে এ নিয়ে আলাপ হয়েছিল আমার।’
অপরাহ্ জিজ্ঞেস করেন, ‘যে আপনি আর বেঁচে থাকতে চান না।’ হ্যাঁ বলে মেগান তা নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন যে, ওই রাতে তিনি ওই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন কারণ তিনি অনুভব করছিলেন যে, তিনি আর ‘একাকী’ বোধ করতে চান না। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, অ্যালবার্ট হলে অনুষ্ঠানের সময় হ্যারি তার হাত শক্ত করে ধরে ছিলেন।
Meghan
অপরাহ্ মেগানকে জিজ্ঞেস করেন যে, রাজপরিবার কেন তার ছেলে আর্চিকে প্রিন্স ঘোষণা করেনি।
প্রসঙ্গত, ১৯১৭ সালের একটি আইনের কারণে ডিউক এবং ডাচেস অব সাসেক্সের সন্তানরা স্বাভাবিকভাবেই প্রিন্স কিংবা প্রিন্সেস হবেন না, যদি না রানি কোন পদক্ষেপ নেন।
মেগান বলেন, ‘আমার গর্ভবতী থাকার মাসগুলোতে আলোচনা চলছিল যে তাকে সুরক্ষা দেওয়া হবে না, তাকে হয়তো কোন পদবী দেওয়া হবে না এবং জন্মের পর তার ত্বক কতটা কালো হবে তা নিয়েও উদ্বেগ এবং আলোচনা চলেছে।’
তিনি বলেন যে, এসব কথা হ্যারিকে বলা হয়েছিল এবং তার কাছ থেকেই তিনি এসব বিষয় জেনেছেন।
অপরাহ্ জিজ্ঞেস করেন যে তার সন্তান যদি ‘বেশি বাদামি বর্ণের’ হয় এবং তা নিয়ে কোন সমস্যা হবে কিনা— এ নিয়ে কোনো উদ্বেগ তাদের ছিল কিনা। মেগান বলেন, ‘এটা যদি আপনার অনুমান হয়ে থাকে, তাহলে সেটি বেশ নিরাপদ অনুমানই মনে হচ্ছে।’
এ ধরণের মন্তব্য কে করেছিলেন সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি তা জানাননি। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় এটা তাদের জন্য খুব ক্ষতিকর হবে।
হ্যারিও সে বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরতে অসম্মতি জানিয়ে বলেন, ‘ওই আলোচনা আমি কখনোই কাউকে বলবো না। সে সময়ে এটা বেমানান ছিল এবং আমি বিস্মিত হয়েছিলাম।’
তিনি বলেন যে, গণমাধ্যমের কাছ থেকে মেগান যে ধরনের বর্ণবাদের শিকার হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে কোন স্বজনই মেগানের পক্ষে কথা বলতে এগিয়ে আসেননি। হ্যারি বলেন, ‘ওই তিন বছরে আমার পরিবারের কেউই কোন কথা বলেনি। এটা কষ্টকর।’
Megjan
প্রথম সন্তান আর্কির সঙ্গে হ্যারি-মেগান দম্পতি
সাক্ষাৎকারের সময় রাজপরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয় যে, তারা ডিউক এবং ডাচেসকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। মেগান ওই পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে বলেন, ২০১৮ সালের মে মাসে বিয়ের পর ‘সেটি আরও খারাপ হতে থাকে’।
মেগান বলেন, ‘আমি বুঝতে পারি যে শুধু আমাকেই সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে না তা নয় বরং পরিবারের অন্য সদস্যদের সুরক্ষা দিতে তারা মিথ্যা বলতেও প্রস্তুত ছিল। কিন্তু আমি আর আমার স্বামীকে সুরক্ষা দিতে তারা সত্যিটা বলতেও ইচ্ছুক ছিল না।’
তিনি একটি গুজবের উদাহরণ টেনে বলেন যে, ফ্লাওয়ার গার্লসদের পোশাক কেমন হবে সে বিষয়টি নিয়ে মতামত দেওয়ার সময় ডাচেস অব কেমব্রিজকে কাঁদিয়েছিলেন তিনি। এই গল্পটি ট্যাবলয়েড পত্রিকায় মুখরোচক গল্প হয়ে উঠেছিল বলে জানান তিনি।
মেগান বলেন যে, আসলে ঘটনাটি পুরো উল্টো ছিল। তিনি বলেন যে, ওই ঘটনার জন্য পরে ক্যাথরিন ক্ষমা চেয়েছিলেন। সাথে কিছু ফুল আর ছোট চিরকুট পাঠিয়েছিলেন সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য।
সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্বে অপরাহ্ আর স্ত্রীর সাথে যোগ দেওয়ার পর হ্যারি পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে তার সম্পর্কের বিষয়গুলো তুলে ধরেন। তিনি বলেন, তার দাদি অর্থাৎ রানির সাথে তার সম্পর্ক খুবই ভাল। তারা দুজন প্রায়ই কথা বলেন। তবে তার বাবা প্রিন্স অব ওয়েলসের সাথে তার সম্পর্ক তেমন ভাল নেই।
Oporah
হ্যারি বলেন যে, তিনি তার বাবার বিষয়ে ‘আসলেই হতাশ’ বোধ করেন। তিনি বলেন, তিনি তার বাবাকে সবসময়ই ভালবাসবেন কিন্তু ‘তিনি অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছেন।’ প্রিন্স উইলিয়াম সম্পর্কে তিনি বলেন যে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ‘আসলেই ভিন্ন।’
তিনি আরও বলেন, তার পরিবার তাকে আর্থিকভাবেও সহায়তা করা বন্ধ করে দিয়েছে। হ্যারি তার ভাই আর বাবাকে রাজপরিবারের ব্যবস্থার ‘ফাঁদে আটকে পড়া’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘তারা সেখান থেকে বের হতে পারবে না।’
প্রিন্স উইলিয়ামের বিষয়ে তিনি বলেন, তারা দুজন ‘ভিন্ন পথে’ রয়েছেন।
সাক্ষাৎকারটি এমন সময়ে প্রচার হলো যখন হ্যারির দাদা, ডিউক অব এডিনবরা হৃৎপিণ্ডে অস্ত্রোপচার শেষে এখন হাসপাতালে সেরে উঠছেন। যদিও সাক্ষাৎকারটি আগেই ধারণ করা হয়েছে।
বিবিসির রাজপরিবার বিষয়ক সংবাদদাতা জনি ডায়মন্ড বলছেন, এটা এখনো স্পষ্ট নয় যে, এর প্রতিক্রিয়ায় রাজপ্রাসাদ থেকে কী বলবে। কিছু কিছু অভিযোগ এতো বেশি ব্যক্তিগত যে ধারণা করা হচ্ছে সেগুলো নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাবে না। তবে এই দম্পতি যে এখনো স্নেহধন্য সেটি রানি বারবারই স্পষ্ট করেছেন।
Megan
২০১৮ সালের মে মাসে উইন্ডসর ক্যাসলে বিয়ে করেন এই দম্পতি
সময়কাল
২০১৬ সালের গ্রীষ্ম: পরস্পরের পরিচিত বন্ধুর মাধ্যমে আয়োজিত ব্লাইন্ড ডেট-এ গিয়ে দেখা হয় হ্যারি এবং মেগানের।
২০১৮ সালের মে: উইন্ডসর ক্যাসলে বিয়ে করেন এই দম্পতি।
২০১৯ সালের এপ্রিল: উইন্ডসর ক্যাসলের প্রাঙ্গণেই ফ্রগমোর কটেজে বসবাস শুরু করেন তারা।
২০১৯ সালের ৬ই মে: তাদের সন্তান আর্চি জন্ম নেন।
২০২০ সালের ৩১শে মার্চ: কানাডায় স্থানান্তরিত হওয়ার পর রাজ পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্য হিসেবে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। ওই বছরেই ক্যালিফোর্নিয়ায় যান তারা।
২০২১ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি: এই দম্পতি ঘোষণা দেয় যে তারা দ্বিতীয় সন্তানের বাবা-মা হতে যাচ্ছেন।
২০২১ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি: বাকিংহাম প্যালেস ঘোষণা দেয় যে, তারা রাজ পরিবারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য হিসেবে ফিরে আসবেন না এবং তাদের অভিভাবকত্ব বাতিল করা হয়েছে।