উদ্বোধনের অপেক্ষায় বহুল প্রত্যাশিত খুলনা শিল্পকলা একাডেমি কমপ্লেক্স। একদিকে ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা দূর করার দাবি, অন্যদিকে দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর একাডেমি ভবন ব্যবহারের জন্য অধির আগ্রহে রয়েছে এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষ। উদ্বোধনের পরে অসম্পূর্ণ থাকা কাজ গুলো দ্রুত সমাধানের দাবি তাদের।
খুলনা জেলা শিল্পকলা একাডেমি ও সংস্কৃতি কর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, খুলনাবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ও প্রাণের দাবি খুলনায় একটি নান্দনিক শিল্পকলা একাডেমি কমপ্লেক্স স্থাপনের। এ জন্য দীর্ঘদিন স্থানীয় বিভিন্ন সংষ্কৃতি কর্মীসহ খুলনাবাসি দাবি ও আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছিল। এক পর্যায়ে ২০১১ সালের ৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুলনার খালিশপুরে জনসভায় খুলনা জেলা শিল্পকলা একাডেমির আধুনিক ভবন এবং অডিটোরিয়াম নির্মাণের ঘোষণা দেন।
প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে সাংষ্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা প্রদান করে। পরে সংষ্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার ভিত্তিক এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে নগরীর শেরেবাংলা রোডের পুরাতন নার্সিং ইনস্টিটিউটের জায়গায় ৮০ শতক জমিতে বিভাগীয় ও জেলা শিল্পকলা একাডেমি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ব্যয় ধরা হয় ২২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিসিটিএই ইলোরা জেভি এই প্রকল্পটির কাজ পায়। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নকশা পরিবর্তনসহ নানা জটিলতায় নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি কাজ। পরে প্রকল্প ব্যয় ৭ কোটি টাকা বাড়িয়ে মেয়াদ ২০২০ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।
প্রকল্পটির মূল অবকাঠামোর নির্মাণ কাজ গত ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে সম্পন্ন হলেও নির্মাণে ছিল বেশ কিছু ত্রুটি ও অস্পূর্ণতা। ইতিমধ্যে নিরাপত্তা সিস্টেম, লাইটিং ও সাউন্ড সিস্টেমসহ কিছ ত্রুুটি সমাধানের দিকে অগ্রসর হলেও কিছু অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে এখনও। একদিকে ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা দূর করার দাবি, অন্যদিকে দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর একাডেমি ভবন ব্যবহারের জন্য অধির আগ্রহে সংস্কৃতি কর্মীরা।
সংস্কৃতি কর্মীরা জানান, কমপ্লেক্সে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, লিফট ও আর্ট গ্যালারিতে শীতাতপ যন্ত্র নেই। এছাড়া নাটক করার জন্য যথার্থভাবে ইন্টেরিয়র ডিজাইন হয়নি। ত্রুটি রয়েছে আধুনিক লাইটিং ও সাউন্ড সিস্টেমেও । তাছাড়া সি সি ক্যামেরাসহ কমপ্লেক্স রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিতেরও দাবি তাদের।
উদ্বোধনের জন্য ৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়সহ মন্ত্রণালয়ে অফিসিয়াল চিঠি পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি পেলেই উদ্বোধনের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান জেলা কালচারাল কর্মকর্তা সুজিত সাহা। তিনি আরও বলেন, নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সীমানা প্রাচীরে নতুন করে কাটা তার সংযোজনের কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া আর্ট গ্যালারিতে শীতাতপ যন্ত্র স্থাপনসহ লাইটিং ও সাইন্ড সিস্টেম যুক্ত করা হয়েছে। তবে উন্নতমানের কিছু লাইটিং ও সাউন্ড সিস্টেম স্থাপনের চাহিদাপত্র, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ও ২৩ জন জনবলের চাহিদাপত্র মহাপরিচালক বরাবর পাঠানো হযেছে।
সূত্র জানায়, তাছাড়া নতুন করে যুক্ত হচ্ছে ১৫-২৪ ফুট (৩৬০ বর্গ ফুট) এলইডি মাল্টিমিডিয়া স্ক্রিণ ও ৫টি স্মার্ট টিভি। কমপ্লেক্সে ব্যবহৃত যাবতীয় আসবাবপত্র এক সপ্তাহের মধ্যে টেন্ডার হবে বলে তিনি আশাবাদী। প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে যতদ্রুত সম্ভব এটা উদ্বোধন হয়ে অত্র অঞ্চলের শিল্পীদের দীর্ঘদিনের মনের আশা পূরণ হোক এই প্রত্যাশা করেন তিনি। তিনি আরও আশাবাদী দ্রুত উদ্বোধনের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের প্রতিক্ষার ক্ষণ শেষ হবে খুলনাবাসির এবং এটি খুলনার সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা হবে।
এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই কমপ্লেক্সটির উদ্বোধন করবেন এই প্রত্যাশায় ও দাবিতে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বরাবর চিঠি দিয়েছেন খুলনা সাংষ্কৃতিক উন্নয়ন কমিটির নেতৃবৃন্দ। প্রধানমন্ত্রী সরাসরি অথবা ভার্চূয়ালি উপস্থিত থেকে উদ্বোধন অনুষ্ঠানকে জাতীয় মর্যাদায় আসীন করবেন এটি তাদের প্রাণের দাবি। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবার জন্যে চিঠিতে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর কাছে দাবি জানানো হয়।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ গত ২১ অক্টোবর নির্মাণাধীন খুলনা শিল্পকলা একাডেমি পরিদর্শন শেষে স্থানীয় সাংস্কৃতিককর্মী ও গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে মতবিনিময় করেন। এ সময় তিনি বলেন, নির্মাণাধীন খুলনা শিল্পকলা একাডেমির নিরাপত্তা নিশ্চিত, ভবনে লিফট ও সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা, অডিটোরিয়ামে অধিক সংখ্যক মাইক্রোফোন ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা যুক্ত করা হবে। এছাড়া যে কোনো ধরনের অসঙ্গতি দূর করার আশ্বাসও দিয়েছিলেন তিনি।
খুলনা সাংস্কৃতিক উন্নয়ন কমিটির আহ্বায়ক স্বপন কুমার গুহ বলেন, মূল ভবনের প্রবেশ পথের সামনেই রয়েছে গণপূর্ত বিভাগের একটি সরকারি ভবন। এই ভবনের জন্যই ঢাকা পড়ে গেছে দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাটি। এটি অপসরণ করে গাড়ি পার্কিং এর ব্যবস্থা করার কথা রয়েছে কিন্তু এখনও কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তবে পিডব্লিউডি’র কর্মকর্তাদের সদ্বিচ্ছা থাকলে দ্রুততম সময়ে এটা অপসরণ সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরও বলেন, কমপ্লেক্সটি চালু হলে এ এলাকার শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা আরও গতিশীল হবে। কমপ্লেক্সটি যেভাবে রয়েছে সেভাবেই দ্রুত চালু করার ব্যবস্থা করতে জোর দাবি জানান তিনি।
উদীচী খুলনার সাবেক সভাপতি ও আহবায়ক কমিটির সদস্য সাংস্কৃতিক কর্মী সূখেন রায় বলেন, সকল সাংস্কৃতিক সংগঠনকে নিয়ে সুন্দর পরিবেশে দ্রুত উদ্বোধনের ব্যবস্থা করা গেলে এ এলাকার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড আরও বেগবান হবে। এছাড়া উদ্বোধনের পর অডিটরিয়ামের ভাড়া সংগঠনগুলোর সক্ষমতার মধ্যে রাখারও দাবি জানান তিনি।
প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। এখানে স্থাপন করা হয়েছে মুক্তমঞ্চ এবং চার তলা প্রশাসনিক ভবন, ৫০০ আসনের মিলনায়তন, আর্ট গ্যালারি, লিংক করিডোর ও সীমানা প্রাচীর। এছাড়া রয়েছে একটি ক্যাফেটেরিয়া ও ডরমেটরি। এসব স্থাপনায় সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য কোথাও মাটির টালি, কোথাও মার্বেল, কোথাও গ্রানাইট বসানো রয়েছে।