>> শুভাঢ্যা খাল উন্নয়ন ও সুরক্ষায় পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব
>> প্রস্তাবটি উপস্থাপন করে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও বাপাউবো
>> প্রতি মিটার মাটির বাঁধ নির্মাণে খরচ ধরা হয় ৬৬ হাজার টাকা
>> মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে পরিকল্পনা কমিশন
চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃ ‘ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ উপজেলাধীন শুভাঢ্যা খাল পুনঃখনন এবং খালের উভয় পাড়ের উন্নয়ন ও সুরক্ষা’ নামের প্রকল্পটি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো)। তারা খালটি পুনঃখনন ও উভয়পাড় উন্নয়ন-সুরক্ষার নামে খরচ করতে চেয়েছিল এক হাজার ২৯০ কোটি ৯৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। এটি অনুমোদনের জন্য কয়েক মাস আগে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠায় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও বাপাউবো।
পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পটি যাচাই করতে গিয়ে দেখে, প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) উল্লেখ আছে, এটি বাস্তবায়নের জন্য তাদের কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবল রয়েছে। এরপরও পরামর্শক খাতে ১৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা খরচের প্রস্তাব দেয় তারা! কিন্তু তাদের এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে পরিকল্পনা কমিশন।
১৪ কিলোমিটারের কম দৈর্ঘ্যের খালটির অভ্যন্তরীণ ভ্রমণের জন্য তিন কোটি টাকা চাওয়া হয়। অথচ পরিকল্পনা কমিশন বলছে, এ খাতে ১০ লাখই যথেষ্ট।
খাল পুনঃখনন এবং এর উভয়পাড় উন্নয়ন-সুরক্ষার এ প্রকল্পে চেয়ারম্যানবাড়ী মাঠ উন্নয়নে ১৫ কোটি ৬৫ লাখ ৩৪ হাজার এবং মোল্লার হাট সংস্কার ও সম্প্রসারণে ১৭ কোটি ৫৩ লাখ ৫৬ হাজার টাকা খরচের প্রস্তাব দেয় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও বাপাউবো। তাদের এ প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যাত হয়।
প্রকল্পের প্রস্তাবে ১৩ হাজার ৮৮৪ মিটার খাল থেকে স্লাজ (কাদা বা বর্জ্য) অপসারণের জন্য ২৩৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা চাওয়া হয়। অর্থাৎ প্রতি মিটার স্লাজ অপসারণের জন্য খরচ ধরা হয় এক লাখ ৬৯ হাজার টাকা। সাত হাজার ৭২১ মিটার ভাসমান পায়ে চলার পথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ১৩৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এতে প্রতি মিটারে খরচ পড়ে এক লাখ ৪২ হাজার টাকা। ২৬০০ মিটার মাটির বাঁধ নির্মাণের জন্য খরচ ধরা হয় ১৭ কোটি ৩১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি মিটার মাটির বাঁধ নির্মাণে খরচ পড়ে ৬৬ হাজার টাকা। ৩৪৫৫.৭৮ বর্গমিটার ঘাট নির্মাণে খরচ ধরা হয় ২৩ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি বর্গমিটারে খরচ ধরা হয় ৬৬ হাজার টাকা।
খালের স্লাজ অপসারণ, ভাসমান চলার পথ, মাটির বাঁধ, ঘাট নির্মাণে বাপাউবোর এত টাকা ব্যয়ের প্রস্তাবে সায় না দিয়ে পরিকল্পনা কমিশন এসব কাজের যৌক্তিকতা ও খরচের ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
শুধু ওপরের খাতগুলো নয়, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও বাপাউবো এ প্রকল্পের আওতায় মোট ৫৫টি খাতে ব্যয় দেখায়। কয়েকটি খাত বাদ দিয়ে অধিকাংশ খাতের ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে পরিকল্পনা কমিশন। খাতভিত্তিক ব্যয়সহ প্রকল্পটির ৩৫টি বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। কয়েক মাস নানা পর্যালোচনার পরও অস্বাভাবিকতা থাকায় গত বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় পুরো প্রকল্পটি বাতিল করে পুনরায় ডিপিপি করে আনার জন্য ফেরত পাঠানো হয়। অর্থাৎ সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই বাপাউবোর খাল খননের নামে জনগণের অর্থ অবচয়ের এ প্রস্তাব অনুমোদন আপাতত ভেস্তে যায়।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) মো. জাকির হোসেন আকন্দ জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পটি বেশ কয়েক মাস আগে এসেছিল। মনে রাখতে হবে, প্রকল্প মানেই হলো সমস্যা। এ সমস্যা একটা কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাধান করা হয়। এর ভেতর অনেক ইস্যু আছে। ইস্যুগুলো নিয়ে আমরা সভা করে ফেলেছি। সভায় আমরা বলেছি, একটা স্টাডি (সমীক্ষা) হবে। স্টাডি রিপোর্টে তারা যে যে কাজ করতে বলবে, সেই কাজ করা হবে। আমরা এখানে বসে সেগুলো ঠিক করতে পারব না। সেজন্য আমরা ওই মন্ত্রণালয়কে (পানি সম্পদ) বলেছি, ৫ বা ১০ কোটি টাকা যাই লাগুক, সেই বাজেটের ওপর একটি স্বাধীন সংস্থা দিয়ে, তাদের মাধ্যমে এ স্টাডি করতে হবে। সেই স্টাডি প্রতিবেদনে যেসব বিষয় সুপারিশ করা হবে, সেই সুপারিশের আলোকে ডিপিপি আবার নতুন করে তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আসতে হবে। এ সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। গত বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর ওপর পিইসি সভা হয়ে গেছে।’
ভেস্তে গেল আরও যত প্রস্তাব
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও বাপাউবোর প্রকল্প ফিরিয়ে দেয়ায় আলোচিত কোটি কোটি টাকার প্রস্তাব ছাড়াও আরও কোটি টাকার ‘অযৌক্তিত’ প্রস্তাব ভেস্তে যায়।
মন্ত্রণালয় ও বাপাউবো এ প্রকল্পের আওতায় শুভাঢ্যা খালের পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার জন্য দুই কোটি ৫৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা অনুমোদন চায়। পিইসি সভার আগেই এ খাতে এত ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে পরিকল্পনা কমিশন।
ওয়াকওয়ে, সেতু লাইটিং ও বৈদ্যুতিক কাজবাবদ ৩৮ কোটি ২৯ লাখ, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক প্রশিক্ষণবাবদ এক কোটি টাকা খরচের প্রস্তাব করে মন্ত্রণালয় ও বাপাউবো। এসব খাতে এত টাকা খরচের প্রয়োজন নেই বলে জানিয়ে দেয় পরিকল্পনা কমিশন।
নকশা, স্থান, পরিমাপ ও পৃথক ব্যয় প্রাক্কলন ছাড়াই আরসিসি পাইপ ড্রেন নির্মাণবাবদ ২৭ কোটি ১৯ লাখ টাকা প্রস্তাব করে তারা। এছাড়া তাদের প্রস্তাবিত ছয়টি প্লাজা নির্মাণবাবদ নয় কোটি ছয় লাখ, ছয়টি টয়লেট নির্মাণবাবদ ৪০ লাখ ৬৫ হাজার এবং ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে পরিকল্পনা কমিশন।
অর্থ বিভাগের সুপারিশ ছাড়াই জনবল নিয়োগবাবদ দুই কোটি ৮৩ লাখ টাকা সংস্থান রাখা হয় প্রকল্পে। পরিকল্পনা কমিশন বলছে, প্রকল্পে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত কাজ (খাল থেকে স্লাজ অপসারণ, মাটির বাঁধ নির্মাণ, খালপাড় সংরক্ষণ) যতসামান্য, এ মন্ত্রণালয় বহির্ভূত কাজের (পায়ে চলার পথ নির্মাণ, ভিউয়িং ডেক নির্মাণ, পাইপ ডেক নির্মাণ, সেতু লাইটিং ও বৈদ্যুতিক কাজ, মাঠ উন্নয়ন, ডাস্টবিন নির্মাণ ইত্যাদি) পরিমাণই বেশি।
প্রকল্পে অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণবাবদ ৩০ লাখ এবং বিদেশে প্রশিক্ষণবাবদ ৭০ লাখ টাকা চাওয়া হয়। পরিকল্পনা কমিশন এসব খরচ বাদ দিতে বলে।
প্রকল্পের আওতায় অধিকাল ভাতাবাবদ ৩০ লাখ, অফিস ভবন ভাড়াবাবদ ৭২ লাখ, ডাকবাবদ এক লাখ আট হাজার, টেলিফোনবাবদ পাঁচ লাখ ৪০ হাজার, নিবন্ধন ফি-বাবদ ১৩ লাখ ৫০ হাজার, বিদ্যুৎবাবদ পাঁচ লাখ ৬৭ হাজার, পেট্রল ওয়েল লুব্রিকেন্টবাবদ ৫৭ লাখ ৬০ হাজার, মুদ্রণ ও বাঁধাইবাবদ নয় লাখ, সিল ও স্ট্যাম্পবাবদ তিন লাখ, মনিহারিবাবদ নয় লাখ, বইপত্র ও সাময়িকীবাবদ দেড় লাখ, অডিও/ভিডিওবাবদ ১৫ লাখ, প্রচার ও বিজ্ঞাপনবাবদ পাঁচ লাখ, সেমিনার ও কনফারেন্সবাবদ ৩০ লাখ, আপ্যায়নবাবদ ১০ লাখ ৮০ হাজার, ভাড়া ও পরিবহনবাবদ আট লাখ, সম্মানিবাবদ ২৫ লাখ, টেস্টিং ফি-বাবদ ৩৫ লাখ ১৮ হাজার, সাধারণ সরবরাহবাবদ ৭৫ লাখ, মোটরযান মেরামতবাবদ ৫০ লাখ, আসবাবপত্র মেরামতবাবদ ৩০ লাখ, কম্পিউটার মেরামতবাবদ ১৪ লাখ ৪০ হাজার এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি মেরামতবাবদ ৭৫ হাজার টাকা অনুমোদনের প্রস্তাব করা হয়।এর বিপরীতে পরিকল্পনা কমিশন প্রস্তাব করে, ডাকবাবদ এক লাখ ৮০ হাজার, টেলিফোনে দেড় লাখ, নিবন্ধন ফি-তে সাড়ে তিন লাখ, বিদ্যুৎ বিলে দুই লাখ, পেট্রল ওয়েল লুব্রিকেন্টে ১০ লাখ, মুদ্রণ ও বাঁধাইয়ে দুই লাখ, সিল ও স্ট্যাম্পে এক লাখ, অন্যান্য মনিহারিতে তিন লাখ, বইপত্র ও সাময়িকীতে দেড় লাখ, অডিও/ভিডিওতে দুই লাখ, প্রচার ও বিজ্ঞাপনে তিন লাখ, সম্মানিতে পাঁচ লাখ, কম্পিউটার মেরামতে তিন লাখ টাকা।
যা বলছে বাপাউবো
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে বাপাউবোর মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. মাহফুজুর রহমানকে দুদিনে একাধিকবার ফোন দেয়া হয়। তবে তিনি রিসিভ করেননি।
তবে বিষয়টি বিস্তারিত শোনানো হয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্লানিং) এ এম আমিনুল হককে। তিনি বলেন, যারা এটা তৈরি করছে, তাদের সঙ্গে আলাপ করতে হবে।
আপনি তো অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে এখানে পরিকল্পনার দায়িত্বে আছেন- এর জবাবে আমিনুল হক বলেন, ‘প্লানিংয়ে আছি মানে যে ওইটা তৈরি করছি, তা নয়। যে লেভেল থেকে করা হয়েছে, ওই লেভেলে আলাপ করতে হবে। মানে, এ প্রজেক্ট যারা তৈরি করেছে, তাদের সঙ্গে আলাপ করতে হবে।’
বাপাউবোর সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার (সিভিল) মো. আব্দুল মতিন সরকার প্রকল্পটি তৈরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দুদিন তাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
প্রকল্প থেকে জানা যায়, শুভাঢ্যা কেরানীগঞ্জ উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ খালগুলোর অন্যতম। কারণ এটি বুড়িগঙ্গা নদী থেকে যাত্রা শুরু করে কেরানীগঞ্জের ভেতর দিয়ে ধলেশ্বরী নদীতে গিয়ে মিশেছে। এ খালে কঠিন ও তরল বর্জ্য নিক্ষেপসহ খালের পাড়ে অবৈধভাবে বাড়িঘর, দোকানপাট, কলকারখানা ও মসজিদ গড়ে উঠেছে। ফলে শুভাঢ্যা খালের প্রস্থতা ও গভীরতা কমে গেছে। নিষ্কাশিত বর্জ্যের কারণে খালের পানি দূষিত হয়ে পড়েছে ও দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে প্রকল্পটি নেয়া হয়।