দেশ স্বাধীনের ৩৯ বছর পর খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার দেয়াড়া গ্রামে পাকবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাতে নির্মমভাবে নিহতদের গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেলেও গত এক দশকে সেখানে নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতিস্তম্ভ। এমনকি সরকারিভাবে পালিত হয় না গণহত্যার দিনটিও।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকবাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসররা সারাদেশে যে নৃশংসতা এবং গণহত্যা সংঘটিত করেছিল, তার মধ্যে খুলনা জেলার দিঘলিয়া উপজেলার দেয়াড়া গণহত্যা অন্যতম। ২০১০ সালে এখানে গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। ৭১ এর ২৭ আগস্ট রাজাকার বাহিনী ঐ গ্রামের ৬০ জন নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে নৃশংসভাবে গলা কেটে এবং গুলি করে হত্যা করে। সরকারীভাবে দিবসটি পালিত না হলেও শহীদ পরিবারের সদস্যরা প্রতিবছর দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালন করে থাকেন।
এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা যায়, ঘটনার দিন দিঘলিয়া উপজেলার দেয়াড়া গ্রামের ডাক্তার শেখ মতিয়ার রহমানের পুত্র মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবদার রহমান তাঁর সহযোগীদের নিয়ে দেয়াড়া গ্রামে সংগঠিত হচ্ছেন, এমন সংবাদের ভিত্তিতে পাকবাহিনীর এ দেশীয় দোসর কয়েক’শ রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবদার হোসেন এবং বর্তমান দিঘলিয়া সদর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি শেখ আবজাল হোসেনের পিতা ডাক্তার শেখ মতিয়ার রহমান, তাঁর চাচাত ভাই শেখ রহমত আলী পিরু, মোঃ আলী শেখ, ভাগ্নে শেখ ইসমাইল হোসেন ছোট খোকা, জামাই আব্দুল জলিল, তাঁর ভাই আব্দুল বারেক, হোসেন সরদার, মোঃ আজিম হোসেন, সাত্তার শেখসহ উক্ত গ্রামের ৬১ জনকে ধরে নিয়ে যায়। আটককৃতদের কাছে এ সময় পাকবাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা ও তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ আবদার হোসেনের সন্ধান চায়। তারা সন্ধান দিতে অস্বীকৃতি জানালে ঘটনার দিন সকাল অনুমানিক ৯ টার দিকে প্রকাশ্য দিবালোকে উক্ত গ্রামের পৃথক ৩ টি স্থানে এদেরকে গুলি ও গলা কেটে হত্যা করে ২২ জনের লাশ পৃথক ৩ টি স্থানে গণকবর দেয় এবং বাকী লাশগুলো পাশ্ববর্তী ভৈরব নদে ভাঁসিয়ে দেয়। সৌভাগ্যক্রমে সৈয়দ আবুল বাশার নামে এক ব্যক্তি একাধিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়েও প্রাণে বেঁচে যান।
২০১০ সালে সব গণকবেরর সন্ধান আবিষ্কৃত হলে ঐ বছরের ৬ জানুয়ারী স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কামরুজ্জামান বাচ্চু, গাজী আজগর আলী, শহীদ ডাক্তার শেখ মতিয়ার রহমানের পুত্র ও দিঘলিয়া সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আবজাল হোসেন ও আওয়ামীলীগ নেতা মোঃ মকবুল হোসেনসহ স্থানীয়দের সহযোগীতায় উল্লেখিত গণকবর থেকে শহীদের দেহাবশেষ সংগ্রহ করে একত্রিত করে দেয়াড়া মুক্তিযোদ্ধা শাহানেওয়াজ গোডাউনের পাশে তাঁর দান করা জমির উপর ভৈরব নদের পাশ্ববর্তী একটি স্থান চিহ্নিত করে গণকবরের স্থান নির্ধারণ করা হয় এবং দেহাবশেষগুলি সেখানে সমাহিত করা হয়। উক্ত গণকবরে ২২ জন শহীদ সমাহিত আছেন। দেয়াড়া গণহত্যার অনেক স্মৃতি চিহ্ন খুলনার ‘গণহত্যা জাদুঘরে’ সংরক্ষিত রয়েছে।
দেয়াড়া গণহত্যা থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া একমাত্র ব্যক্তি সৈয়দ আবুল বাশার বর্তমানে অনাহারে অর্ধাহারে জীবন কাটাচ্ছেন। ৮৮ বছর বয়সী ৮ সন্তানের জনক সৈয়দ আবুল বাশার তাঁর পিঠে রাজাকারদের ১৯ টি ধারালো অস্ত্রের কোঁপ এবং বোগলের নীচে একটি গুলির ক্ষত চিহ্ন তিনি আজও বহন করে চলেছেন।
৩ ডিসেম্বর বুধবার দুপুরে এ প্রতিনিধির সাথে আলাপকালে সৈয়দ আবুল বাশার অশ্রুসজল চোখে ৪৯ বছর আগের সেই ভয়ঙ্কর এবং নৃশংস ঘটনার কিছুটা বর্ননা দেন। বয়েসের ভারে তিনি সব স্মৃতি স্মরণও করতে পারছিলেন না। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “এ পর্যন্ত অনেক সাংবাদিক এসে আমার সাক্ষাতকার নিয়েছেন। কিন্ত দুঃখের বিষয় আমার ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হলো না, কিংবা দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৯ বছর পরও একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সরকারি স্বীকৃতি পেলাম না।” তিনি বলেন, “আমার জীবনে আর চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই, তবে সরকারের কাছে আমার দাবি, মৃত্যুর আগে আমি যেন একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সরকারি স্বীকৃতির খবর নিজ কানে শুনে মরতে পারি।”
অন্যদিকে দেয়াড়া গ্রামের ঐ গণকবরে যে ২২ জনকে সমাহিত করা হয় তাদের মধ্যে ১৬ জনের পরিবার এখনো উক্ত এলাকায় বসবাস করেন। পরিবারের সদস্যরা পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে নির্মমভাবে নিহতদের শহীদ হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জাানিয়েছেন।
দিঘলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মাহাবুবুল আলম মুঠোফোনে এ প্রতিনিধিকে বলেন, সরকার সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষণ এবং গণকবরগুলি চিহ্নিত করে সেখানে স্মৃতিস Íম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সে লক্ষে আমরা উক্ত গণকবরটি স্মৃতিস্তম্ভ¢ হিসাবে নির্মাণের জন্য ইতিমধ্যে ৬ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করে প্রস্তাব মন্ত্রনালয়ে পাঠিয়েছি।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবদার হোসেন বাদী হয়ে উক্ত রাজাকারদের বিরুদ্ধে তৎকালীন দৌলতপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। রাজনৈতিক কারণে মামলাটি আর আলোর মুখে দেখেনি। এরপর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবদার হোসেনের মৃত্যুর পর ২০১০ সালে পাক হানাদার বাহিনীর দোসর রাজাকারদের হাতে নিহত মোঃ ইসমাইল হোসেন ছোট খোকার স্ত্রী রোকেয়া বেগম বাদী হয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইবুনালে ২২ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করেন। অভিযুক্ত ২২ জনের মধ্যে ইতিমধ্যে ২১ জন মারা গেছে। সর্বশেষ রাজাকার মারা যান গোয়ারপাড়া গ্রামের শেখ শওকত হোসেন। জীবিতদের মধ্যে একজন হলেন দিঘলিয়া উপজেলার ব্রক্ষগাতী গ্রামের মৃত গফুর শেখের পুত্র জাফর শেখ এখনও এলাকায় দাপটের সাথে চলাফেরা করছেন।