চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃ গণমানুষের অধিকার নিয়ে সোচ্চার থাকা মানুষগুলো নিজেদের অধিকারের কথা বলার কেউ নেই! হুম আমি সাংবাদিকদের কথাই বলছি। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিন-রাত একাকার করে কাজ করেও মহান এই পেশাটির সাথে জুড়ে গেছে ‘থ্যাংকসলেস’ শব্দটি।
বিশ্ব যখন মহামারি ভরসার করোনার কবলে, জনমনে যখন আকণ্ঠ শঙ্কা, ঠিক তখনো হাজারো সংবাদকর্মী নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে অবিরাম সংগ্রহ করে চলেছেন করোনার সংবাদ।
ন্যূনতম সতর্কতা ছাড়াই ছুটছেন এয়ারপোর্টে নিচ্ছেন প্রবাস ফেরতদের ইন্টারভিউ তারপর ছুটে চলা হাসপাতালে করোনা রোগীর খোঁজে, সেখানে কথা হচ্ছে করোনার চিকিৎসা করা চিকিৎসকের সাথে। তারপর আবার জন জটলার প্রেস বিফ্রিং। কখনো কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে, কখনো তাকে ঘিরে জনগণের প্রতিবাদ মিছিলে! ভাবতে পারেন, আমরা যখন মাসের বাজার মজুদ করে বাড়িতে আছি করোনার সতকর্তায় তখন যেই মানুষটি আমাদের জানাচ্ছেন দেশে করোনার প্রকোপ কতটুকু, বিশ্বে কোথায় কি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে থেকে শুরু করে করোনার সব খবরাখবর সেই মানুষটিই ঘুরে ফিরছেন কি করোনার চারিদিকে কোনোরকম সুরক্ষা ছাড়াই।
মনে পরে যায় হেফাজতের কথা, বিডিআর বিদ্রোহ গুলি হচ্ছে, ককটেল ফুটছে, গ্রেনেড ফুটছে আর আমরা তখন পাগলের মতো সংবাদ সংগ্রহে ব্যস্ত! নিতান্তই সৌভাগ্যবানরা পেয়েছিলাম কিছু বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট আর হেলমেট আর বাকিরা আয়রনের ভাজে ঘর্মাক্ত শার্ট নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছিলেন পুরো সংকটের সময়গুলো। সংবাদকর্মীরা কি তবে মানুষ নয়! তাদের কি নূন্যতম সুরক্ষার কিটগুলো পাওয়ার কোনোই অধিকার নেই?
এইতো সেদিন চিকিৎসক ফাউন্ডেশনের অনুষ্ঠানে জনপ্রিয় উপস্থাপক ডা. আব্দন নূর তুষার তাদের (চিকিৎসকদের) অধিকারের কথা বলতে গিয়ে বারবার আবেগ-আপ্লুত হয়ে যাচ্ছিলেন। তখন আমার শুধুই মনে হচ্ছিল কতোটা অসহায় আমরা সংবাদকর্মীরা। চিকিৎসক তার চিকিৎসা করবেন এই শপথ নিয়েই তিনি এসেছেন এই মহান সেবার পেশায়। তাকে ন্যূনতম সুরক্ষা দিতেও আমরা পারছি না। তার কি পরিবার নেই, নেই কোনো স্বপ্ন! আর সুরক্ষা ছাড়া চিকিৎসা দিতে গিয়ে মারা পড়লে ক্ষতিটা কি শুধুই তার পরিবারের? এ জাতির কি কোনোই ক্ষতি নেই?
ঠিক তেমনি সাংবাদিকদের কি পরিবার নেই, তার মৃত্যুতে কি এই জাতির কোনোই ক্ষতি হবে না? যখন এই কথাগুলো বলছি, তখন আমার সাংবাদিক সহযাত্রী ভাইরা ভুগছেন শিল্পের দৈন্যদশার মধ্য দিয়ে। চলছে ছাঁটাই, বেতন-ভাতার নাই ঠিক, বছর শেষে ইনক্রিমেন্ট তো পূর্ণিমার চাঁদ, চাকরিটা টিকে থাকলেই যেন পরম পাওয়া! কি অপরাধ আমাদের! বলতে পারেন!
থাক সে কথা, আসুন ফিরে আসি করোনায়। যেখানে জন জমায়েতকে দেখা হচ্ছে আত্মহত্যা হিসেবে সেখানে কি দরকার একটা প্রেস বিফ্রিং এ সবগুলো গণমাধ্যমের যাওয়ার? নিয়ম করে একটা হাউজ গিয়ে সবাই ফুটেজ আর তথ্যগুলো ভাগ করে নিলেই কি হয় না! কিংবা ধরুন, যেই প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা প্রেস ব্রিফিং করছেন তারাই না হয় ডিজিটালি ব্রিফিং করলো সেখান থেকে তথ্য আর ফুটেজ নিয়ে হলো সংবাদ। বিশেষ কিছু দরকার পরলে না হয় আলাদাভাবে হাতে সংবাদকর্মীরা নিলেন মুঠোফোন।
প্রতিঘণ্টায় নিউজগুলোকে কি তিন ঘণ্টা পর পর নেয়া যায় না? কিছু মানুষ রোটা করে না হয় থাকলো ঘরে! কিছু সংবাদ হলো রিপিট। টক শোগুলো কি হতে পারে না ডিজিটাল কানেকটিভিটির মাধ্যমে। স্কাইপ, হোয়াটসঅ্যাপসহ আরো কতো কি সুবিধাই তো এখন আছে আমাদের।
বাইরে কাজ করার সময় চিকিৎসকদের মতোন না হোক বাড়তি সুরক্ষায় গাউন, ক্যাপ, শু-কভার, মাস্ক এবং হ্যান্ড গ্লাভস কি একটা প্রতিষ্ঠান তার সংবাদকর্মীদের দিতে পারেন না! প্রতিটি গণমাধ্যমে এই কয়েকটা মাসের জন্য কি পর্যাপ্ত সাবান, লিকুয়িড সোপ কিংবা সেনিটাইজার রাখার মতো স্বচ্ছলতা তাদের নেই? সারাবছর যারা বিজ্ঞাপন দেন সাবানের এই দূর্যোগে কি তারাও পাশে দাড়াতে পারেন না সংবাদকর্মীদের?
এই দুইটা সপ্তাহ বাংলাদেশের জন্য খুবই কঠিন সময়। এই দুটি সপ্তাহ আমরা যদি আমাদের স্বাভাবিক চলাচলকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারি তবেই আমরা করোনার প্রকোপ থেকে মুক্তি পাবো অন্তত অনেকাংশে সেই প্রকোপের মাত্রা কমিয়ে আনতে সক্ষম হবো বলেই আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি।
সাবেক সংবাদকর্মী হিসেবে দেশের সকল গণমাধ্যমের কর্তাব্যক্তিদের প্রতি আমার করজোরে সবিনয় আকুতি থাকবে অন্তত এই সংকটে আমাদের পাশে দাঁড়ান। এই আমরাই তো আপানার পাশে দাঁড়িয়েছি সব সময়। নিজেকে নিজের পরিবারকে তুচ্ছজ্ঞান করে দিন-রাত কাজ করেছি সংবাদ সংগ্রহে, এই আমরাই তো দেশের সব মানুষের অধিকার বাস্তবায়নে কাজ করেছি অহর্নিশ। জাতীয় এই দুর্যোগেও তো আমরা পিছপা হয়নি, আমৃত্যু সংবাদ সংগ্রহ করে তা পৌছে দেব জনগণের দ্বারপ্রান্তে- এই তো ব্রত আমাদের।
এই একটিবারের জন্য না হয় আমাদের সুরক্ষায় আগ্রহী হন আপনারা। আমি বিশ্বাস করি, তুচ্ছ নগণ্য ছিটকে পরা এই সংবাদকর্মীর আকুতি অগ্রজরা শুনবেন। নতুন করে সাজাবেন করোনার কভারেজ পরিকল্পনাগুলো। আমরা একজনও সংবাদকর্মীকে হারাতে চাই না এই করোনায়। করোনা ঝুঁকিতে সংবাদকর্মীরা আর তাদের সুরক্ষায় পাশে নেই কেউ! মধ্যম আয়ের দ্বারপ্রান্তে থাকা দেশে এই লজ্জা ঢাকবো আমরা কি দিয়ে?
আসুন আমরা নিজেদের জন্য খানিকটা সময় বের করে ভাবি নিজের সুরক্ষা নিয়ে, সচেতন থাকি, সতর্ক থাকি, সচেতন রাখি, সতর্ক রাখি পুরো দেশ, পুরো জনপদ।
সবার সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।
লেখক: রাফে সাদনান আদেল, সংবাদ ও উন্নয়নকর্মী।