আন্তর্জাতিক ডেস্কঃকাশ্মীরি নাগরিক ও পুলিশের রাতভর সংঘর্ষের পর ভারতীয় প্রশাসন কাশ্মীরের বৃহত্তম শহর শ্রীনগরের প্রধান প্রধান স্থানে চলাচলের ওপর ফের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ভারতের সংবিধানে জম্মু-কাশ্মীরকে স্বায়ত্তশাসন দেয়া ৩৭০ অনুচ্ছেদ তুলে নেয়াকে কেন্দ্র করে দুই সপ্তাহের বেশি সময় অবরুদ্ধ থাকে কাশ্মীর। শনিবার (১৭ আগস্ট) নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল হলেই সংঘর্ষ বাধে, যাতে কয়েক ডজন মানুষ আহত হয় বলে দুইজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে জানায় রয়টার্স।
গত ২৪ ঘণ্টায় কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়ার নয়াদিল্লীর পদক্ষেপের বিরুদ্ধে একের পর এক বিক্ষোভ চলে ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে। শনিবার সকালে চলাচলের নিয়ন্ত্রণ সহজ হলেই এই সংঘর্ষ শুরু হয়। গত ৫ই আগস্ট মোদীর কট্টরপন্থি হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার দেশটির একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু-কাশ্মীরকে অচল করে ৭ দশকের বিশেষ অধিকার কেড়ে নেয়।
কাশ্মীরের কার্যত কারফিউ অবস্থা বিরাজ করলেও প্রাদেশিক সরকার গত দুই সপ্তাহ ধরে কারফিউ চাপিয়ে দেয়নি বলে জানায়। তবে, রবিবার গত কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নগরীতে স্থাপন করা একাধিক সড়ক অবরোধগুলোকে সরিয়ে ফেলেছিল কাশ্মীরিরা। অবরুদ্ধ কয়েকটি সড়কের বাসিন্দাদের সুরক্ষা বাহিনী জানিয়েছে যে, সেখানে কারফিউ রয়েছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের কাছে দুজন সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তা বলেন, শনিবার রাতে পুরানো শহরে সহিংস সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পরে কমপক্ষে দুই ডজন লোক পেল্লেট গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। শ্রীনগরে অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীর সরকারের প্রতিনিধিরা এবং নয়াদিল্লিতে ফেডারেল সরকার তাত্ক্ষণিকভাবে হতাহত এবং সংঘর্ষের ঘটনা সম্পর্কে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
একটি সরকারি সূত্র জানিয়েছে যে, শ্রীনগরজুড়ে প্রায় দুই ডজন জায়গায় লোকেরা নিরাপত্তা বাহিনীকে লক্ষ্য করে পাথর ছোড়ে। গত কয়েক দিন ধরে পাথর ছুড়ে প্রতিবাদ করার তীব্রতা বেড়েছে।
মরিচ গ্রেনেড
শ্রীনগরের পুরানো শহরের রাতভর ভারী সংঘর্ষের ব্যাপারে প্রত্যক্ষদর্শী এবং কর্মকর্তারা জানায়, পুরান শহরের রায়নাওয়ারি, নওহেট্টা এবং গোজওয়ারা অঞ্চলে সহিংস সংঘর্ষ ঘটেছিল, যেখানে ভারতীয় সেনারা বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাস, মরিচ গ্রেনেড এবং পেল্লেট গুলি ছোড়ে।
তীব্র মরিচের গুঁড়া বহনকারী মরিচ গ্রেনেডগুলো ধারণ করে যা ছাড়ানো অবস্থায় চোখ এবং ত্বকে তীব্র জ্বালা তৈরি করে। গত দুই সপ্তাহ ধরে বিক্ষোভের কেন্দ্রস্থল সৌরাসহ শ্রীনগরের আরও অনেক স্থানে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কর্মকর্তারা রয়টার্সকে জানায়। কর্মকর্তাদের গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা নিষিদ্ধ।
শ্রীনগরের প্রধান হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ এবং একজন সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে, কমপক্ষে ১৭ জন মানুষ সেখানে পেল্লেট গুলিবিদ্ধ হয়ে যান। সেখান থেকে ১২ জনকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে এবং বাকি পাঁচজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছে।
হাসপাতালের কর্মকর্তারা ও একজন পুলিশ কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, শনিবার বিকালে পুরান নগরীর অঞ্চলে টিয়ার গ্যাস ও মরিচ গ্রেনেড ছোড়াছুড়ি করার সময় গুরুতর শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে ৬৫ বছর বয়সী ব্রারিপোরার বাসিন্দা মোহাম্মদ আইয়ুবকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। শনিবার রাতে তিনি হাসপাতালে মারা যান এবং ইতোমধ্যে তাকে কবর দেয়া হয়েছে।
পেল্লেট গুলি
শ্রীনগরের ধনাঢ্য রাজবাগ এলাকা থেকে আগত জাভেদ আহমদ (৩৫) রবিবার সকালে পুরাতন শহরে যেতে চাইলে কেন্দ্রের নিকটে একটি ব্যারিকেডে আধাসামরিক পুলিশের কাছে বাধাপ্রাপ্ত হন। তিনি বলেন, ‘আমি আমার বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলাম। সৈন্যরা কাঁটাতারের সাহায্যে রাস্তা অবরোধ করে রেখেছিল। সেখানে কারফিউ থাকায় আমাকে ফিরে যেতে বলেছিল তারা।’
এ দিকে, কাশ্মীরের কয়েকটি অংশে টেলিফোন ল্যান্ডলাইন পুনঃস্থাপন করা হয়েছে এবং প্রাদেশিক সরকার জানিয়েছে যে, রবিবার সন্ধ্যা নাগাদ অঞ্চলের বেশিরভাগ টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কাজ শুরু করবে। ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে ইন্টারনেট এবং সেলফোন নেটওয়ার্ক বন্ধ ছিল।
জম্মু-কাশ্মীরের ৫ শতাধিক রাজনৈতিক বা সাম্প্রদায়িক নেতাকর্মীরা আটক রয়েছেন এবং অনেককে রাজ্যের বাইরের কারাগারেও পাঠানো হয়েছে। গৃহবন্দি আছেন জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক দুই মুখ্যমন্ত্রীও।
ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে গত ৩০ বছর ধরে এক বিদ্রোহের সঙ্গে লড়াই করে আসছে সরকার। যাতে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৫০,০০০ মানুষ নিহত হয়েছে। সমালোচকদের মতে, কাশ্মীরিদের স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তটি বিশ্বের সবচেয়ে সহিংস এই এলাকাটির বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহ আরও উত্তপ্ত করবে এবং সশস্ত্র প্রতিরোধ বাড়িয়ে তুলবে।
কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার পরিবর্তনটি ভারতের অন্যান্য রাজ্যের অধিবাসীকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের সম্পত্তি কিনতে সুযোগ তৈরি করবে। এতদিন স্থানীয় বাসিন্দারা প্রাদেশিক সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে যে অগ্রাধিকার পেত তারও সমাপ্তি হবে। তবে, হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার অধিকৃত কাশ্মীরকে পুরোপুরি ভারতে সংহত করতে এবং এর উন্নয়নের গতি বাড়ানোর জন্য এই ব্যবস্থা প্রয়োজনীয় বলে দাবি করেছেন।