কিস্তির টাকা ফেরত না পেয়ে ঋণগ্রহীতার ১২৫ বস্তা ধান ও গবাদিপশু ও ছাগল নিয়ে গেছে অভিযোগ উঠেছে ঋণদাতা সমিতির লোকজনের বিরুদ্ধে। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার রামকৃষ্ণপুর গ্রামের অর্ধেন্দু রায় এ ঘটনার শিকার হয়েছেন। তার জমিতে মাড়াই করে রাখা ধান ও গৃহপালিত শুকর, ছাগল ছিনিয়ে নিয়ে গেছে নবরূপ সমবায় সমিতি ও পূর্বাশা সমবায় সমিতির লোকজন।
অর্ধেন্দু রায়ের অভিযোগ, এ ঘটনায় তিনি কোনো আইনি ব্যবস্থা নিলে বা কাউকে বললে তাকে ডুমুরিয়া ছাড়া করা হবে বলে হুমকি দিয়েছে সমিতির লোকজন।
স্থানীয়রা জানান, ভুক্তভোগী অর্ধেন্দু রায় জীবিকার তাগিদে ডুমুরিয়া উপজেলার রামকৃষ্ণপুর বিলে জমি বর্গা নিয়ে মাছ ও ধান চাষ করেন। সংকটে পড়ে নবরূপ সমবায় সমিতি ও পূর্বাশা সমবায় সমিতি থেকে ঋণ নেন তিনি। কিস্তির টাকা ঠিকমতোই পরিশোধ করে আসছিলেন। তবে, করোনা প্রভাবের কারণে এনজিও থেকে নেয়া ঋণের কিস্তি আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত আদায় না করার সরকারের নির্দেশনা থাকায় তিনি কিস্তি পরিশোধ করেননি। কিন্তু গত ১ জুন থেকে সাধারণ ছুটি উঠিয়ে নেয়ার পর নবরূপ সমবায় সমিতি ও পূর্বাশা সমবায় সমিতির লোকজন ২ জুন তার ঘেরে হানা দেয়। সেখানে মাড়াই করে রাখা ১২৫ বস্তা ধান (প্রায় দেড়শ মণ), শুকর ও ছাগল নিয়ে যায়। নবরূপ সমিতির লোকজন শুকর দু’টি জবাই করে গোশত বিক্রি করে দিয়েছে এবং ছাগল ও ৪৫ বস্তা ধান পূর্বাশা সমিতির লোকেরা অন্য একজনের জিম্মায় রেখেছে।
নবরূপ সমবায় সমিতির কোষাধ্যক্ষ পিন্টু কবিরাজ জানান, অর্ধেন্দুর কাছে সুদ ও আসলসহ অনেক টাকা পাওনা রয়েছে। সে টাকা না দিয়ে চলে যেতে পারে। তাই সমিতি যে টাকা পাবে সে অনুযায়ি ধান ও শুকর আনা হয়েছে।
ডুমুরিয়া উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা মো. সেলিম আক্তার নবরূপ সমিতির এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, সরকারের নির্দেশ অমান্য করেছে তারা। এটি সম্পদ লুট করার সামিল। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত অর্ধেন্দু রায়কে সবরকমের আইনি সহায়তা দেয়া হবে।
অপরদিকে খুলনা মহানগরীর দৌলতপুর থানাধীন এলাকায় বেশ কয়েকটি এনজিও শাখা রয়েছে। এর মধ্যে ব্র্যাক, আশা, ব্যুরো বাংলাদেশ, এডামস্, ঠ্যংগামারীসহ কয়েকটি সংস্থা। এ সকল সংস্থাগুলো হতে থেকে এলাকার কয়েকশ মানুষ ঋণ নিয়েছে। দেশের চলমান করোনা সংকট পরিস্থিতিতে সরকার মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির এনজিওগুলোকে ঋণ আদায় হতে বিরত থাকতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এদিকে, নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করেও থেমে নেই দৌলতপুরে এনজিওর ঋণ আদায় কার্যক্রম। ফলে চরম বিপাকে পড়ছে নিন্মআয়ের ঋণগ্রহীতারা।
ইস্পানী কোলনী (কুলিবাগান) আশা এনজিওর সদস্য লিপি বেগম বলেন, আমি সমিতি হতে ৪০ হাজার টাকা উত্তোলন করি, যার প্রতি সপ্তাহের কিস্তি ৮০০ টাকা। আমার স্বামী একজন রিক্সাচালক, সংসারে রয়েছে ছেলে-মেয়ে। ইঞ্জিন রিক্সা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে আমার স্বামীর ইনকাম কম। পুরা পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছি। ৮ জুন সকালে সমিতির অফিসার ঋণ আদায়ের জন্য আসে এবং টাকা আদায়ের জন্য চাপ প্রয়োগ করে। বলে, ‘ঋণ নেয়ার সময় মনে ছিল না, কোথা থেকে কিস্তি দেবেন জানি না।’
শুধু তিনি নন এরকম ঋণগ্রহীতা লাকি, শিল্পী, তাহমিনাসহ অনেকেই একই ধরনের পরিস্থিতির কথা বলেন।
দেয়ানা উত্তরপাড়ার হোসেনশাহ্ রোডের আছিয়া বেগমের (৬০) স্বামী ২৪ ডিসেম্বর মারা যান। ব্র্যাক এনজিও হতে তার ঋণ নেয়া আছে। সম্প্রতি ব্র্যাক অফিস হতে তাকে ফোনে বলা হয় কিস্তি আদায়ে আপনার বাড়িতে লোক যাবে, আপনাকে অবশ্যই কিস্তি দিতে হবে। ‘আমার কোনো আয়ের পথ নেই, কোথা হতে কিস্তি দেব,’ বলেন তিনি।
দেয়ানা হোসেনশাহ্ রোডের বাসিন্দা আশা এনজিওর ঋণগ্রহীতা তানিয়া বেগম (৩৩) বলেন, তার স্বামী পানি কোম্পানিতে অল্প বেতনের চাকরি করেন। দেশের চলমান লকডাউন ও পরিবহন বন্ধ থাকার কারণে স্বামীর তেমন ইনকাম নেই। তানিয়াসহ এ সমিতির কয়েকজন সদস্য একই কথা বলেন।
তাদের ভাষ্য, শুনেছি সরকার করোনা মুহূর্তে নাকি ঋণ আদায় করবে না। তারপরও সমিতির স্যাররা আসছে ঋণ আদায়ের জন্য। চাপ প্রয়োগ করছে।
তবে এনজিওর কর্মকর্তারা চাপ প্রয়োগের বিষয়টি অস্বীকার করেন। তারা বলেন, কোনো চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে না কেউ স্বেচ্ছায় দিতে চাইলেই কেবল জমা নেয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে এনজিও আশার রিজিনিওয়াল ম্যানেজার আব্দুল হাইকে বিষয়টি অবগত করা হলে তিনি বলেন, ৩১ মে হতে সরকার ঘোষণা দেয়ার পর আমার সংস্থা সীমিত আকারে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে আদায়কারী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে কারও উপর জোর না করতে। যদি কেউ স্বেচ্ছায় ঋণ প্রদান করে তবে তা আদায় করতে। যেহেতু ঋণ আদায়ের বিষয়ে জোর প্রয়োগের অভিযোগ এসেছে। সেহেতু আমি আমার আদায়কারী কর্মীদের ডেকে বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেব।
অপরদিকে, এনজিও ব্র্যাক দৌলতপুর ব্রাঞ্চ ম্যানেজার সিমা পারভীন বলেন, আমার সংস্থা ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ করছে না। যদি কেউ স্বেচ্ছায় ঋণ পরিশোধ করতে চায় আমরা তা বিকাশের মাধ্যমে গ্রহণ করছি।