অনলাইন ডেস্কঃঅবকাঠামো নির্মাণে ইটের বিকল্প নেই। কিন্তু মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরির কারণে দেশে কৃষিজমির যেমন ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি পরিবেশের ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। ইদানীং ইটের বিকল্প হিসেবে সিমেন্টের ব্লক ব্যবহারে মানুষের মধ্যে আগ্রহ বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিমেন্টের ব্লক ব্যবহারে নির্মাণ খরচ প্রায় ৩০ ভাগ কম হয়। ভবন অনেকটা হালকা ও ভূমিকম্প সহনীয় হয়। ভবনের গাঁথুনি হয় অনেক মজবুত ও হাল্কা। ইটের বিকল্প এবং ব্যয়সাশ্রয়ী এই নির্মাণ উপকরণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছে বাংলাদেশ হাউসিং এ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট। তারা বলছে ব্লক নির্মাণে মাটি ব্যবহার করতে হয় না। সিমেন্ট এবং নুড়িপাথর দিয়েই কংক্রিটের ব্লক তৈরি করা যায়। তারা জানান ইতোমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান এখন নির্মাণ কাজে ব্লক ব্যবহার করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে যত ইট ব্যবহার করা হয়, তার সবই কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি পুড়িয়ে তৈরি করতে হয়। এতে প্রতিবছর ১ শতাংশ হারে কৃষিজমি কমছে। হাউসিং এবং বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসাব মতে, দেড় হাজার কোটি ইট তৈরিতে ১২৭ কোটি ঘনফুট মাটির প্রয়োজন হয়। যার সবই কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি কেটে সংগ্রহ করতে হয়। অথচ ইট পোড়ানো আইন ১৯৮৯ অনুসারে (২০১৩ সালে সংশোধিত) দুই ফসলি কৃষিজমিতে ইটভাঁটি স্থাপন নিষিদ্ধ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনের সীমাবদ্ধতার জন্য এক ফসলি জমিতে ইটভাঁটি স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষিজমির উপরিভাগের মাটির পরিবর্তে নদী বা খাল পুনর্খনন করা মাটি ইটভাঁটিতে ব্যবহার নিশ্চিত করা হলে এবং পোড়া ইটের বিকল্প হিসেবে কংক্রিটের ব্লকের স্থাপনা নির্মাণ পর্যায়ে ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হলে পরিবেশ ও কৃষি জমির অবক্ষয় রোধে তা ভূমিকা রাখতে পারবে। হাউসিং এন্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআর-আইয়ের) মহাপরিচালক শামিম আক্তার বলেন, পোড়ানো ইটের অনেক নেতিবাচক দিক আছে। সরকার ’২০ সালের মধ্যে মাটিতে পোড়া ইটের ব্যবহার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে বলেছে। এটি মাথায় রেখেই ইটের বিকল্প ব্লক তৈরি করা হচ্ছে। এসব ব্লক ব্যবহারে বাড়ির নির্মাণ খরচ অনেকটাই কমে আসে। ইটের বিকল্প ব্যবহারে ইতোমধ্যে সরকার টেন্ডার সিডিউলে বিকল্প ইটের কথা অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে কাজ করছে। সরকারী বিভিন্ন ভবন নির্মাণে ইটের বিকল্প এই কংক্রিটের ব্লক ব্যবহার করলে মানুষের মধ্যে এর ব্যবহারের প্রবণতা বাড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আধুনিক বিশ্বে বহুতল ভবনের নির্মাণ উপকরণ হিসেবে কংক্রিট, এ্যালুমিনিয়াম শিট, প্লাস্টিক, কাঁচ ফাইবার, স্টিল ও ধাতব বস্তুর ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। এর বিপরীতে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত বিশ্বে প্রধানত ইটের ব্যবহার বেশি হচ্ছে। দেশেও সাধারণত অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ইট তৈরির জন্য ভাঁটি মালিকরা উপযুক্ত সময় হিসেবে বিবেচনা করেন। তারা কৃষকদের লোভ দেখিয়ে এককালীন অল্পকিছু টাকা দিয়ে চাষাবাদের জন্য জমির উপরিভাগের উর্বর মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে ইট তৈরির কাজে ব্যবহারের জন্য। এক হিসাবে দেখা গেছে আড়াইশ’ বর্গমিটার ফ্লোরের একটি পাঁচতলা ভবন নির্মাণের জন্য ৫ লাখ ইটের প্রয়োজন হয়। অথচ কংক্রিটের একটি ব্লক সাড়ে পাঁচটি ইটের সমান। এ কারণে ব্লক ব্যবহারের নির্মাণ সামগ্রিক ব্যবহার অনেক কম। হাউসিং এ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে ব্লকের জনপ্রিয়তা বাড়াতে প্রতিষ্ঠানটি থেকে ইতোমধ্যে বেশি কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি থানার বালিগাঁয়ে নির্মাণ করা হয়েছে কংক্রিটের ব্লক তৈরি মেশিন। এই মেশিন দিয়ে খুব সহজেই যে কেউ দিনে একশ’ ব্লক বানাতে পারেন। প্রতি ব্লক তৈরিতে খরচ পড়ে ৩০ টাকা। একটি ব্লক যেহেতু সাড়ে ৫টি ইটের সমান, সেহেতু একটি কংক্রিটের ব্লকের দাম পড়ে ৫৫ টাকা। সাধারণ মানুষের জন্য এটি পরিবেশবান্ধব এবং সাশ্রয়ী উদ্যোগ। শুধু মুন্সীগঞ্জের বালিগাঁওয়ে নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় এখন ইটের বদলে ব্লকের ব্যবহার হচ্ছে। বিশেষ করে যশোর পঞ্চগড় এলাকায় নির্মাণ করা হচ্ছে ব্লক তৈরির মেশিন। ফলে সাধারণ জনগণের মধ্যে ইটের পরিবর্তে ব্লক ব্যবহারের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। পরিবেশ অধিদফতর জানিয়েছে, এবারের এই বর্ষায় ঢাকার বাতাস স্বাস্থ্যকর নয়। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, গত ১৯ জুন পরিবেশ অধিদফতরের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে ঢাকার বাতাসে বিষাক্ত উপাদান রয়েছে। অথচ অন্য বছর বর্ষায় ঢাকার বাতাসে ক্ষতিকর উপাদান কম থাকে। কিন্তু এবার চিত্র বিপরীত। একারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাবে কারণে বর্ষায় বৃষ্টিপাত কমে আসছে। বৃষ্টি না থাকায় বাতাসে ক্ষতিকর উপাদান থেকেই যাচ্ছে। তারা জানান ঢাকার বাতাস দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ঢাকার আশ পাশে গড়ে তোলা মান্ধাতা পদ্ধতির ইটভাঁটিগুলো। পরিবেশ অধিদফতর বলছে সারাদেশে বর্তমানে ইটভাঁটির সংখ্যা রয়েছে ৭ হাজার ৯৩৩। গতানুগতিক পদ্ধতির এসব ইটভাঁটি শুধু বায়ুদূষণই করছে না, বাতাস থেকে বিভিন্ন বায়ুমন্ডলীয় প্রভাবে এসব দূষণ মাটিতে স্থানান্তর করছে। ফলে মাটির তুষণ ত্বরান্বিত করছে। নষ্ট করছে মাটির প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান। আমরা মনে করি, ইটের কারণে কেবল কৃষি জমি কমে যাচ্ছে তা নয়, পরিবেশ দূষণ, উর্বর টপ সয়েল বা ভূমির উপরিভাগ নষ্ট ছাড়াও বহুবিধ ক্ষতি হয়। বাতাসে কার্বনের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং সবুজ বৃক্ষরাজির ক্লোরোফিল নষ্ট হয়ে বিবর্ণ হচ্ছে, গাছ বাঁচতে পারছে না। এমতাবস্থায় ইটের পরিবর্তে ব্লক ব্যবহার প্রয়োজনে আগামী ৫ বছরের মধ্যে বাধ্যতামূলক আদেশ জারি করে দেশের সমস্ত ইটভাটা বন্ধ করে ব্লক ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হোক।