চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃ কোভিড-১৯ (করোনা ভাইরাস) আসলে তেমন অচেনা নয়। এটা একটা বড় ভাইরাস দলের সদস্য, যার নাম “করোনা”। ২০০৩ সালে এর প্রথম প্রাদুর্ভাব সেই চায়নাতেই ঘটে। তখন তাকে আমরা জেনেছি সার্স ভাইরাস নামে। চায়না যখন প্রথম এর কথা হু-কে জানায়, তখন এর নাম রাখে সার্স-কভ-২। বিজ্ঞান জগতে এখনও সেই নাম চলে। সম্প্রতি ‘নেচার’ পত্রিকা এই ভাইরাস মানুষের তৈরি সে বিষয়ে সন্দেহ একেবারে উড়িয়ে দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের ভাষ্যমতে, প্রোটিনের যে আঁকশি দিয়ে কোভিড-১৯ মানুষের দেহকোষের গ্রাহক স্থানে (রিসেপ্টর এসিই-২) অতি সুচারুভাবে নিজেকে আবদ্ধ করে, সেই প্রোটিন আঁকশি গবেষণাগারে চটজলদি তৈরি করা সম্ভব নয়। একমাত্র প্রাকৃতিক নির্বাচনেই এই সূক্ষ্ম বিবর্তন সম্ভব। তা ছাড়া, কোভিড-১৯ এর মৌলিক জিনটি করোনা সম্প্রদায়ভুক্ত হলেও তার বিন্যাস অন্যান্য মানব করোনাভাইরাসের বদলে বাদুড়ের করোনাভাইরাসের সঙ্গে বেশি মিল খুঁজে পাওয়া যায়। চিনের নাঙ্কাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রুয়ান জোশু এবং তার সহ-গবেষকরা কোভিড ১৯ এর ক্ষেত্রে একটা সাংঘাতিক বিষয় লক্ষ করেন, মিউটেশনে রূপান্তরিত ভাইরাসটির প্রায় ৮০ শতাংশ সার্স ভাইরাসের সঙ্গে মেলে। কিন্তু এই ভাইরাসের আর একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে। এটা রিসেপ্টার এসিই২ ছাড়াও ফিউরান নামে মানব কোষের আর একটি প্রোটিনকে পরিবর্তিত করে সংক্রমণ জারি রাখতে পারে। এইডস ভাইরাসটি ও এধরণের সংক্রমণ ছড়িয়ে দেয় এবং এতেই এদের মারণশক্তি আরও হাজার গুণ বেড়ে যায়। এই জন্যই ওষুধ তৈরি নিয়ে যত সমস্যা।
ভাইরাস আসলে একটা নির্জীব রাসায়নিক বস্তু, কিন্তু জীব কোষে থাকাকালীন সে কোষের বিপাক প্রক্রিয়া বা মেটাবলিজ়ম ধার নিয়ে দ্রুত প্রজনন করার ক্ষমতা রাখে। করোনাভাইরাসের প্রাণভোমরা হচ্ছে একটা জিন বা আরএনএ, যা তার বংশগতি রক্ষা করে বা বংশবৃদ্ধির জন্য দায়ী। এই জিনে জৈব রাসায়নিক ভাষায় ভাইরাসের চরিত্র লেখা থাকে মাত্র চারটি অক্ষর ব্যবহার করে, এবং এই জিনটার দৈর্ঘ্য ৩০,০০০ শব্দের। এই দ্রুত প্রজননের সময় সে তার ৩০,০০০ শব্দের লেখাটাকে কপি করতে গিয়ে প্রচুর বানান ভুল করে বসে, কেননা সজীব প্রাণীর মতো তার সেই লেখার কোনও প্রুফ রিডিং হয় না। এই ভুল বানানের ফলে নিয়ত তার চরিত্র পাল্টায়। একেই আমরা বিজ্ঞানের ভাষায় পরিব্যক্তি বা মিউটেশন হিসাবে চিনি বা জানি। কিছুদিন আগে সুইজ়ারল্যান্ডের বাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানী অধ্যাপক রিচার্ড নেহের ‘দ্য সায়েন্টিস্ট’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, কোভিড-১৯ ভাইরাসটি বিগত চার মাসে প্রায় আট বার নিজেকে পাল্টেছে। সে যদি ১৫ দিনেরও কম সময় এ ভাবে নিজেকে পাল্টায়, তা হলে এই অসুখ মহামারির রূপ নেবেই। বংশগতি-বিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী, যদি এই অক্ষর এবং শব্দাবলি (জেনেটিক কোড) কোনও ক্রমে বদলে যায়, তা হলে ভাইরাসের চরিত্রও পাল্টে যাবে। ভাইরাসের মারণশক্তি নির্ভর করে তার প্রাণভোমরার ওপর। সেটাই ভাইরাসের অবয়বের প্রোটিন বর্ম এবং যা মানব কোষের গায়ে তাকে আটকে রাখার আঁকশি তৈরি করে দেয়, যাকে বলা হয় আরবিডি প্রোটিন। আজ সত্যিই আমরা আতঙ্কের দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু এই নিয়ত পরিবর্তনশীল ভাইরাসটির প্রাণভোমরা যে প্রতিটা পরিবর্তনেই আরও ভয়াবহ বা প্রাণঘাতী-ই হয়ে উঠবে, সে কথা কিন্তু বিজ্ঞান বলছে না। সে বরং খারাপ না হয়ে উল্টো আরও ভালমানুষও হয়ে উঠতে পারে এবং সেই সম্ভাবনার হারও বলা যেতে পারে ৫০ শতাংশ। কাজেই, ভয় পেয়ে লাভ নেই। এ কথাও অবশ্য সত্যি যে আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউনিটি যদি এই পরিবর্তিত ভাইরাসটা চিনতে না পারে, তা হলেও আর এক বিপদ আছে। ভাইরাসটা তখন নতুন করে ভয়ংকর হয়ে উঠতে আরম্ভ করে দেবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু-এর মতে, প্রতিটি সংক্রমণ ৫-৬ দিনের মাথায় আরও ২.৬ জন লোককে সংক্রমিত করে এবং এই সূত্র ধরে চললে দশটা সংক্রমণ চক্রে, অর্থাৎ ৫০ দিনের মাথায় প্রায় ৩,৫০০ জন ব্যক্তি সংক্রমিত হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা চেষ্টা করলে এই সংক্রমণ চক্রটিকেই ভেঙে দিতে পারি।
বর্তমানে আমেরিকা ও বিশ্ববাসীর কাছে খুবই পরিচিত মুখ, “অ্যান্টনি ফাউচি”। ন্যাশনাল ইন্সটিটিউ অব এলার্জী এন্ড ইনফেকষনস ডিজিসেস এর ডিরেক্টর এবং হোয়াইট হাউজ করোনাভাইরাস টাস্কফোর্স এর একজন প্রভাবশালী সদস্য। তার ভাষায়, “গবেষণায় উঠে এসেছে মূলত শীতের সময়েই এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা যেটা দেখছি আফ্রিকার দক্ষিণ অংশে এবং দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলিতে শীতের সময়েই এই ভাইরাস ছড়িয়েছে। শীতের মওশুমেই ছড়াচ্ছে, এটার ভিত্তি যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে আগামী শীতের মওশুমের আগে আমাদের প্রস্তুত থাকতেই হবে। এই কারণেই আমরা একটা ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করছি। দ্রুত পরীক্ষা করে সেটাকে যাতে আগামী শীতের আগেই চূড়ান্ত করে ফেলা যায়, তার চেষ্টা চালাচ্ছি”। বর্তমানে দু’টি টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চলছে— একটি আমেরিকায় এবং একটি চিনে। কিন্তু সেটা চূড়ান্ত হতে এক থেকে দেড় বছর লাগবে। চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কারের তোড়জোড়ও চলছে। অ্যান্টি-ম্যালেরিয়া ড্রাগ ক্লোরোকুইন এবং হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের সাফল্যও নজরে রয়েছে। ওষুধ বা প্রতিষেধক যা-ই হোক না কেন, তাকে এই দু’টো আক্রমণ পদ্ধতিই নিষ্ক্রিয় করতে হবে। আমরা এখন এই সংক্রমণ (করোনাভাইরাস) কমাতে সফল হবই। কিন্তু আগামী বছরের এই সময়ের জন্যও আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।” ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতেই হবে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন চায়না মোটামুটি ২ মাসের মধ্যেই ভাইরাসটির আক্রমন প্রতিহত করতে পেরেছে এবং ইতালি, আমেরিকা বা অন্যান্য দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে?
চায়না একটি একদলীয় শাসনাধীন সরকার ব্যবস্থায় পরিচালিত দেশ। অর্থাৎ ডিক্টেটরশীপ চলছে ওখানে। চাইনিজরা বৌদ্ধ নয়; তারা কোন ধর্মই মানে না। চায়নাতে ‘উচ্চস্বরে কথা বলা’ বা ‘সাউট’ করাও একটা ফৌজদারী অপরাধ। রাষ্ট্রে যে-কোন নির্দেশনা বিনাবাক্যবায়ে পালন করা ‘ফরজ’। চাইনিজরা রাষ্ট্রের নির্দেশের বাইরে কোন কিছু বলা বা করার কথা চিন্তাও করতে পারে না। সেদেশে আইন ও তার বাস্তবায়ন হয় অক্ষরে অক্ষরে।
সেই দেশে যখন করোনাভাইরাসটি মহামারীরুপে ছড়িয়ে পড়লো এবং সরকারও বুজতে পারলো এটা বড় মহামারী; সংগে সংগে সরকার কার্যকারী ব্যবস্থা গ্রহন করলোঃ
১) ১৫০ কোটি মানুষ এবং বিদেশীরাও যে-যেখানে যেস্থানে যে অবস্থায় রয়েছে সেখান থেকে কেউ মুভ করতে পারবে না। মুল ভবন থেকেই বাইরে বের হতে পারবে না। প্রয়োজনে মেইন গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হলো।
২) ঘোষনা দেয়া হলো এবং বাস্তবায়নও করা হলো, কার বাসায় কি কি খাবার প্রয়োজন তার লিষ্ট দিতে এবং প্রতিটি বাড়ীতে যার যা দরকার তা সরকারীভাবে পৌছে দেয়া শুরু হলো। অর্থাৎ জনগনের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান নিরাপদ করা হলো; বিদেশীদেরও। অর্থাৎ প্রতিটি মানুষ নির্ধারিত স্থানে ‘অবরুদ্ধ’ হয়ে গেল। ইতিমধ্যে লাখ লাখ ফ্যাক্টরী, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবকিছুই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
৩) অসংখ্য অস্থায়ী হসপিটাল তৈরী হয়ে গেল সপ্তাহান্তে। বাড়তি ডাক্তার, নার্স নিয়োগ দেয়া হলো। পুলিশের সংগে সেনা বাহিনী নামানো হলো। আর চাইনিজরা যেহেতু সরকারি নির্দেশের বাইরে যায় না এবং সরকার জনগনের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই করছে; সেহেতু মানুষও সরকারকে সহায়তা করলো সর্বাত্মকভাবে।
৪) অসুস্থ্যদের হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে এবং বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হলো। মৃতদের পুড়িয়ে দেয়া হলো। ওদেশে পুড়িয়ে দেয়ায় বা কবর দেয়ায় কিছুই যায় আসে না- ধর্মহীন মানুষের আবেগ কম থাকে।
করোনা ভাইরাসকে নির্মুল করতে- এই কাজগুলিই করতে হয় যা চায়না প্রথম মাসেই করে ফেলেছে। কাজেই আক্রান্তের সংখ্যাটি কমতে শুরু করলো। ৮২ হাজারের মধ্যেই আক্রান্তের সংখ্যা সীমিত হয়ে গেল। ৩ হাজারের বেশী লোক মারা গেল এবং বাকীরা সুস্থ্য হয়ে বাড়ী ফিরতে লাগলো। যখন নতুন করে আর আক্রান্ত হবার সুযোগ থাকলো না- তখন তারা নিশ্চিত করলো যে বিদেশ থেকে কেউ চায়নাতে ঢুকলে তাকে এয়ারপোর্টেই প্রথমে করোনা টেষ্ট করা হবে।
ক) যদি টেষ্টে পজেটিভ হয় তাহলে সংগে সংগে ওখান থেকেই হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হবে।
খ) যদি নেগেটিভ হয়; তাহলে তাকে হয় সরকারী ব্যবস্থাপনায় অথবা ব্যক্তিগত উপায় থাকলে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ১৪-দিনের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে আবদ্ধ থাকতে হবে; তার ঘরে তালা মেরে দেয়া হলো- যেন সে বাইরে যেতে না পারে এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের ব্যবস্থা করা হলো সরকারী পর্যায় থেকে।
চায়না করোনা ভাইরাস নিমুর্ল করলো।
ইতালি, আমেরিকা বা ইউরোপীয় অন্যান্য দেশ গুলো কেন পারলো না?
কারণ হচ্ছে, এসব দেশগুলোতে গণতন্ত্র, পূর্ণ নাগরিক অধিকার এবং মানবাধিকার অত্যন্ত বেশী মাত্রায় ভোগ করা যায়। সরকার চাইলেই জনগনের উপর কোন কিছু চাপিয়ে দিতে পারে না। সরকারী নির্দেশ কেউ অমান্য করলে তাকে ‘জরিমানা’ করা হয়; কিন্তু গ্রেফতার করা যায় না, গায়ে হাত তোলার কোন নিয়ম নেই- এতে পুলিশেরই চাকুরী যাবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে প্রথমে বিভিন্ন কারণে এ ভাইরাসটিকে কম গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়েছিলো। আর আশার বাণী হলো, এন্টনি ফাউচির গবেষণায় এটা খানিকটা নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে যে, “মূলত শীতের সময়েই এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। আফ্রিকার দক্ষিণ অংশে এবং দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলিতে শীতের সময়েই এই ভাইরাস ছড়িয়েছে”। অর্থাৎ শীত প্রধান দেশেই এর প্রকোপ খুব বেশি পরিমাণে দেখা গেছে। সে দিক থেকে ভাবলে, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে বেশ গরম পড়ে গেছে। আবার অন্যদিকে যেহেতু এই ভাইরাসটি চারমাসে আটবার তার জিন পরিবর্তন করেছে, সুতরাং সেক্ষেত্রে আগামী ৭ এপ্রিল পর্যন্ত যদি এই লক ডাউন কার্যকর ভাবে পালন করা যায়, তাহলে আমরা হয়তো এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পারি। তবে এই সময়ে নিশ্চিত হতে হবে, কারা কারা আক্রান্ত হয়েছে এবং তাদেরকে আইসোলেটেড চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং আক্রান্ত ব্যাক্তির পরিবারকেই শুধুমাত্র কোয়ারেন্টাইন করা। তাহলেই আমরা স্বস্তির হাসি হাসতে পারবো। আরও একটি বিষয় বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, সর্বোচ্চ এক মিটারের বেশি এটি বাতাস ছড়ায় না। অতেব মাঝে মধ্যে সময়ের প্রয়োজনে চায়নার মতো একটিভ হতে হবে; স্বৈরতন্ত্র চালাতে হবে দুই সপ্তাহের জন্য হলেও। সবাই মিলে ভালো থাকি আমরা এই কামনা করি।
তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত।
লেখকঃ শাহ মামুনুর রহমান তুহিন, আহবায়ক, গ্লোবাল খুলনা।