ফকির শহিদুল ইসলামঃ ১১ দফা দাবিতে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী লাগাতার কর্মবিরতি শুরু করেছে বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন। শুক্রবার মধ্যরাত থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য এই ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে নদীবন্দর ও লঞ্চ টার্মিনালগুলো নৌযান শূন্য দেখা গেছে। দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরা। অনেকে ঘাটে এসে ফিরে যাচ্ছেন।
গতকাল শনিবার ভোর থেকে খুলনা নদী বন্দর থেকে কোনও গন্তব্যে ছেড়ে যায়নি স্থানীয় রুটের যাত্রীবাহী কোনও নৌযান। এসব নৌযান পন্টুন থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ কারণে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য নদী বন্দরে এসেও যেতে পারেননি যাত্রীরা। কয়েকদিন আগে বাস ধর্মঘট এবং আজ থেকে ১৫ দফা দাবিতে খুলনাসহ রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে জ্বালানী ব্যবসায়ীদের অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু হচ্ছে। এ ধর্মঘট চলাকালে জ্বালানী তেল উত্তোলন, বিপনন ও পরিবহন বন্ধ থাকবে। এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে খুলনা বিভাগীয় ট্যাংকলরী ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ সাজ্জাদুল করীম কাবুল। তিনি জানান, পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী আজ রবিবার থেকে জ্বালানী তেল ব্যবসায়ীদের এ ধর্মঘট পরবর্তী ঘোষণা না আসা পর্যন্ত চলবে। পরিবহন ধর্মঘট শেষ হতে না হতেই সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আবার নৌ ধর্মঘটে ফলে সাধারন যাত্রীরা অতিষ্ঠ। অপরদিকে দাবি না মানা পর্যন্ত কর্মবিরতি এবং জ্বালানী তেল উত্তোলন, বিপনন ও পরিবহন বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। নৌযান শ্রমিকদের অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের কারণে শনিবার সকাল থেকেই খুলনা অঞ্চলের যাত্রীরা দুর্ভোগে পরেছেন। নৌযান শ্রমিকরা বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা করে, আড্ডা দিয়ে অলস সময় পার করছেন।
জানাগেছে, বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন নৌপথে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি বন্ধ, নৌযান শ্রমিকদের খাদ্য ভাতা প্রদান, সরকার ঘোষিত গেজেট মোতাবেক বেতন প্রদান, ভারতগামী শ্রমিকদের ল্যান্ডিং পাস প্রদান, নৌযান শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত ও মৃত্যুকালীন ১০ লাখ টাকা ভাতা নির্ধারণসহ ১১দফা দাবিতে এই আন্দোলন শুরু করছেন নৌ শ্রমিকরা।
বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের আঞ্চলিক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক একিন আলী জানিয়েছেন, সাধারন শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন,নিরাপত্তা নিশ্চিতের এ দাবি না মানা পর্যন্ত নৌযান শ্রমিকরা কর্মবিরতি অব্যাহত থাকবে। তিনি আরো জানান,এর আগে ২০১০, ২০১২, ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে এই ১১দফা দাবিতে কর্মবিরতিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে । শ্রমিকরা যখনই আন্দোলন শুরু করে তখন আন্দোলনকারীদের লঞ্চ মালিকরা তাদের দাবি পূরণের আশ্বাস দিলেও তারা তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করায় বারবার কর্মবিরতির এ আন্দোলন
করতে হচ্ছে।
নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘট শুরু হওয়ায় শিল্প নগরী খুলনা ও মোংলা বন্দরে অবস্থানরত সব ধরনের দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজের পণ্য বোঝাই-খালাস ও পরিবহন কাজ বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া খুলনা ও মোংলা বন্দরের সঙ্গে সারা দেশের নৌ-যোগাযোগও বন্ধ হয়ে গেছে।
অনির্দিষ্টকালের এ ধর্মঘটের ফলে খুলনার বিআইডব্লিউটিএর ৪, ৫, ৬ ও ৭ নম্বর ঘাট ও জেটিতে অবস্থানরত কোনো জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করা হয়নি। এছাড়া খুলনালঞ্চলের কোন ঘাট থেকে কোনো নৌযান ছেড়ে যায়নি বা আসেনি। এমনকি মোংলা বন্দর থেকে যশোরের নওয়াপাড়া পর্যন্ত কোথাও কোনো নৌযান চলছে না। ফলে এসব ঘাটে ছোট-বড় প্রায় ৮ শতাধিক নৌযান নোঙ্গর ফেলে অবস্থান করছে পণ্য ওঠানামার জন্য। ১১ দফা দাবি আদায়ের ল্েয খুলনা ঘাট এলাকায় মিছিল করেছেন সাধারন শ্রমিকরা। তাদের ন্যায্য দাবি না মানা পর্যন্ত এ ধর্মঘট চলবে বলে শ্রমিকরা জানান।
মোংলা বন্দর কর্তৃপরে হারবার মাস্টার কমান্ডার শেখ ফখর উদ্দিন জানান, শনিবার সকাল ৮টার পর থেকে বন্দরের সব প্রকার নৌ শ্রমিকরা কাজ বন্ধ রেখেছেন। লাইটারেজ, কার্গো, বার্জ, অয়েল ট্যাঙ্কার, কোস্টার থেকে শুরু করে সব ধরনের জাহাজি নৌযানের শ্রমিকরা একযোগে এই ধর্মঘট পালন করছেন। ফলে বন্দরে জাহাজ থেকে পণ্য ওঠা-নামাসহ দেশের বিভিন্ন গন্তব্যের নৌপথে চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে।
অপরদিকে রোববার থেকে জ্বালানী ব্যাবসায়ীদের অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট সফল করতে শনিবার বেলা ১১টায় খুলনা বিভাগীয় ট্যাংকলরী ওনার্স এসোসিয়েশন ভবনে অনুষ্ঠিত জরুরি সভায় কর্মসূচি সফলের আহ্বান জানানো হয়। সংগঠনের পক্ষ থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
সভায় বক্তারা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে জ্বালানী ব্যবসায়ীদের যৌক্তিক অমীমাংসিত দাবি সমূহ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা তালবাহানা করছে। বার-বার প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ করেছে। ফিলিং স্টেশন তথা জ্বালানী ব্যবসায়ীদের উপর অযথা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন দপ্তর থেকে বিভিন্ন ধরনের বিধান। যা মেনে নিয়ে জ্বালানী ব্যবসা করা আদৌ সম্ভব নয়। কোন রকম জনজীবনে জটিলতা সৃষ্টি করা কাম্য নয়।
বক্তারা আরও বলেন, সমাধানের কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। তাই বাধ্য হয়ে জ্বালানী ব্যবসায়ীরা অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি ঘোষণা দিয়েছে। এই ব্যবসাটিকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে জ্বালানী তেল উত্তোলন, পরিবহন ও বিক্রয় বন্ধ রেখে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি পালনের আহ্বান জানানো হয়।
খুলনা বিভাগীয় ট্যাংকলরী ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ সজ্জিাদুল করিম কাবুলের সভাপতিত্বে সভায় বক্তৃতা করেন জ্বালানী তেল পরিবেশক সমিতির সভাপতি আঃ গফ্ফার বিশ্বাস, মাড়ল আঃ সোবাহান, ট্যাংকলরী ওনার্স এসোসিয়েশনের সহ সভাপতি এম, মাহবুব আলম, তেল পরিবেশক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ মুরাদ হোসেন, পদ্মা মেঘনা যমুনা ট্যাংকলরী শ্রমিক কল্যান সমিতির সভাপতি সুলতান মাহমুদ পিন্টু, খুলনা বিভাগীয় ট্যাংকলরী শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি শেখ নুর ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক আলী আজিম, শেখ মিরাউল ইসলাম, সৈয়দ এনামুল করিম, আব্দুল মান্নান খান, মোঃ রবিউল ইসলাম, মোঃ শরিফুল ইসলাম, কাজী রফিকুল ইসলাম নান্টু, শেখ জামিরুল ইসলাম, মোঃ মিজানুর রহমান মিজু, একেএম সামছুল কাদের মিন্টু, মোঃ রফিকুল হক টোটন, মনোজিত বিশ্বাস, মোঃ জহির হাসান, মোঃ শাহিন, শেখ সাদী হোসেন, মোঃ ফারুক হোসেন, শেখ হাসান মাহুমদ, মোঃ মাসুম শেখ শেখ শওকত হোসেন ও শেখ জাহাঙ্গীর হোসেন প্রমুখ।
সভায় নেতৃবৃন্দ জানায়, ১৫ দফার মধ্যে জ্বালানি তেল বিক্রয়ের কমিশন বৃদ্ধি করে ৭.৫ উন্নতি করা, পেট্রোল পাম্প নির্মানে কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের লাইসেন্স গ্রহণ বাতিল, জ্বালানী তেল ব্যবসায়ীরা কমিশন এজেন্ট বিষয়টি নির্দিষ্ট করা, নতুন করে পেট্রোল পাম্প নির্মাণে বিভাগীয় জ্বালানী মালিক সমিতির ছাড়পত্র বিধান চালু, খুলনা, মোংলা, নড়াইল, বেনাপোলসহ বিভিন্ন জেলায় ট্যাংকলরী থেকে জোরপূর্বক পৌরসভা চাঁদা গ্রহণ বন্ধ ও ট্যাংকলরী শ্রমিকদের ৫ লক্ষ টাকা দুর্ঘটনা বীমা প্রণয়ন করা, ট্যাংকলরী ভাড়া বৃদ্ধি করনসহ একাধিক দফা উল্লেখ্য। তাদের দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন অব্যাহত রাখবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।