খুলনা মহানগরের নিরালা আবাসিকের বাসিন্দা পিন্টু সিকদার গড়ে তুলেছেন প্রতারণার সাম্রাজ্য। আর এই সাম্রাজ্যের মহারাজা তিনি নিজেই। তিনি ব্যবসায় সহযোগিতাসহ নানা কাজের প্রলোভন দেখিয়ে এসব প্রতারণা করে বেড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে হাতিয়ে নিয়েছেন একাধিক জমি-খাল আর লাখ লাখ টাকা। প্রতারনার চেষ্টা চালিয়েছেন মসজিদের মুয়াজ্জিনের সাথেও। বছরের পর বছর ঘুরে ভুক্তভোগীরা এর সমাধান পাচ্ছেন না কোন দপ্তরে। এমনকি ফিরে পাচ্ছেন না তাদের আর্থিক ক্ষতি ও সম্পদ।
সারাদেশে ডেভিল হান্ট অভিযান চললেও এমন অস্ত্রধারী প্রতারক এখনো চলাফেরা করছে জনসম্মুখে। যেনো, কোন কিছুই তিনি পরোয়া করেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুলনা সোনাডাঙ্গা থানার নিরালা আবাসিকের বাসিন্দা পিন্টু সিকদার। এক সময়কার ত্রাস খুলনা পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য লিটু সরদারের ডান হাত। সদ্য পলাতক ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের খুলনা মহানগর যুব লীগের সদস্য হাফিজুর রহমান হাফিজের বন্ধু। যাদের প্রভাব প্রতিপত্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষের সাথে করেছেন নানা প্রতারণা। এই পিন্টুর কথামত না চললে অস্ত্র ঠেকিয়ে দিয়েছেন প্রাণ নাশের হুমকি ধামকি। এমন নানা অভিযোগ রয়েছে এই পিন্টু শিকদারে বিরুদ্ধে। ভুক্তোভোগীরা ভয়ে মুখ পর্যন্ত খুলতে পারেনি। তবে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় এখন অনেকেই মুখ খুলতে শুরু করেছে।
একাধিক ভুক্তোভোগির কাছ থেকে জানা যায়, বটিয়াঘাটা উপজেলার নিজখামার এলাকার বাসিন্দা চুন্নু মিয়া। তার সাথে পিন্টু শিকদার ২০১৪ সালের দিক আপন ভাই এর মতো সম্পর্ক গড়ে তোলেন। সেই সম্পর্কের জেরে চুন্নু মিয়ার কাছ থেকে জমি জমার ব্যাবসার কথা বলে ২৮ লক্ষ টাকা ধার নেয়। সেই টাকা আদায় নিয়ে আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। শেষ পর্যন্ত পিন্টু শিকদার অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে এ মামলা তুলতে বাধ্য করেন।
এছাড়া বটিয়াঘাটা উপজেলার কৃষ্ণনগর এলাকা বাসিন্দা মো. আল আমিন ও তার ছোট ভাই ইমামুল খুলনা জিরোপয়েন্টে পিন্টু শিকদারের প্রতিষ্ঠান তালহা ইলেকট্রনিকস এ ২০২০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কর্মচারী হিসাবে কাজ করেন। কর্মরত থাকা কালীন আল আমিন ও ইমামুল এর সাথে পিন্টু শিকদার চাচা ভাইপো হিসেবে খুব ভালো সখ্যতা গড়ে তোলেন। এক পর্যায়ে আল-আমিন কে ব্যাবসা বড় করার লক্ষ্যে ব্যাংক লোন নেওয়ার কথা বলে অনেকগুলো ষ্ট্যাম্পে সাক্ষর করিয়ে নেয় পিন্টু শিকদার। আল আমিন এর নামে ব্যাংক এ্যাকাউন্ট পর্যন্ত খোলা হয়। আর লোনের সংক্রান্ত প্রয়োজনের কথা বলে সকল চেকের পাতায় সাক্ষর করে নেন। এভাবে চলার কয়েকে বছর পর আলামিন ও ইমামুলকে দোকান থেকে বের করে দেন। আল আমিন তার চলতি মাস এর বেতন সহ ব্যাংকের চেকের পাতা ষ্ট্যাম্প ফেরত চাইলে তাকে হামলা-মানলার ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়।
ভুক্তোভোগী চুন্নু মিয়া বলেন, জমি জমার ব্যাবসার কথা বলে পিন্টু শিকদার আমার কাছ থেকে ২৮ লক্ষ টাকা ধার নেয়। কিন্তু আজ অবদি তা ফেরত দেয়নি। বরং টাকা আদায়ে মামলা করেও তার অস্ত্রের মুখে সেই মামলা উঠাতে বাধ্য হই। পিন্টু একাধিক ষ্ট্যাম্প ও ওকালত নামায় আমার সাক্ষর করিয়ে নেয়। আমি ও আমার পরিবার এখনো প্রান ভয়ে আতংকিত।
ভুক্তোভোগী আল আমিন বলেন, পিন্টু শিকদারের প্রতারণায় আজ আমি ও আমার পরিবার নিস্ব। আমাকে তিনি ব্যবসার প্রলভোন দেখিয়ে লোন করার কথা বলে ফাঁকা স্ট্যাম্প ও পুরো চেক বই স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। বেশ কিছুদিন পর লোন না হওয়ায় স্ট্যাম্প ও চেকবই চাইলে পিন্টু শিকদার বলে তাহলে মনে হয় হারিয়ে গেছে সমস্যা নাই কোনো এক সময় পাবি। পরবর্তীতে তার দোকান থেকে আমাকে বের করে দেয়। এবং চলতি মাস এর বেতন সহ চেক ষ্ট্যাম্প ফেরত চাইলে আমাকে হামলা-মামলার ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়। তার এমন বিচক্ষন ফাঁদে পরে আজ আমি চিন্তিত। দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমি ও আমার পরিবার আতংকিত।
খোঁজ নিয়ে আরো জানা যায়, বটিয়াঘাটা উপজেলায় সৈয়দপুর ট্রাষ্ট স্টেট’র জয়খালী খাল ইজারা পেয়ে মাছ চাষ শুরু করে ভোগ করে আসছেন মো. আবদুল খালেক পাইক। কয়েকবছর পর পিন্টু শিকদার খালটি জবর দখল করেন। খালেক পাইক এই খালটি বেদখলের অভিযোগবিভিন্ন দপ্তরে করেও কোন প্রতিকার পাননি। পিন্টু শিকদার বিভিন্ন সময় খালেক পাইকের উপর সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে হামলা চালায়। খালেক পাইক জীবন এর নিরাপত্তার জন্য স্থানীয় থানা ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় সহ ১৯টি দপ্তরে পিন্টু শিকদার এর নামে অভিযোগ দায়ের করেন।
ভুক্তোভোগী মো. আবদুল খালেক পাইক বলেন, আমি ২০০৮ সালে সৈয়দপুর ট্রাষ্ট স্টেট এর সাড়ে ৫ একর জয়খালী খাল ওপেন টেন্ডার এ ইজারা পেয়ে মাছ চাষ করে আসছি। সন্ত্রাসী বাহিনি নিয়ে ২০২১ সালে পিন্টু শিকদার খালটি দখল করেন। ২০-২৫ জনের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে আমার উপর হামলা চালায়। প্রান নাশের হুমকিও দেয়। তিনি বলেন, আমার নিরাপত্তার জন্য স্থানীয় থানা ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় সহ সরকারি বহু দফতরে পিন্টু শিকদারের নামে অভিযোগ দেই। পিন্টু ক্ষমতাধর হওয়ায় কোন প্রতিকার পাই নাই।
আরো অভিযোগ পাওয়া যায়, পিন্টু শিকদার এক মসজিদ’র মুয়াজ্জিনের সাথেও প্রতারনার চেষ্টা চালিয়েছেন।
পিন্টু শিকদার’র প্রতারণার জাল থেকে বেচে যাওয়া ভুক্তোভোগী মসজিদ’র মুয়াজ্জিন আবদুর রহমান বলেন, আমি দারোগা ভিটা শান্তি নগর জামে মসজিদ ও মাদ্রাসায় কর্মরত ছিলাম। পিন্টু শিকদার আমাকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে অনত্র মল্লিক এর মোড়ে মসজিদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর পিন্টু শিকদার আমাকে তার ইজি বাইক চার্জিং পয়েন্টর দায়িত্ব দেন। ও আমকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখান।
তিনি আরো বলেন, কিছুদিন পর পিন্টু শিকদার চার্জিং পয়েন্ট এর ব্যাবসা আরো বড় করার কথা বলে ব্যাংকে এ্যাকাউন্ট খোলা লোনের করানোর জন্য কিছু ষ্ট্যাম্পে সাক্ষর করে দিতে বলে। আমি অস্বীকৃতি জানালে আমাকে শেষ মাসের বেতন না দিয়েই তাড়িয়ে দেয়।
এ সকল অভিযোগের ব্যাপারে পিন্টু শিকদার প্রতিবেদকের সব কথা শোনেন এবং ধমকের স্বরে বলেন আপনার বলা হলে ফোন রাখেন। আর কখনো আমাকে কল দিবেন না।
যদিও প্রতিবেদক ফোন রাখার কিছু সময় পর পিন্টু শিকদারের হয়ে একজন ফোন করে বিষয়টি জানতে চান। সব জেনে তিনি কোন মন্তব্য না করেই রেখে দেন।