চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃখুলনার শিল্পাঞ্চল। যেখানে প্রতিদিন পাটকলের হুইসেল বাজতো। আর দিন রাত লেগেই থাকতো শ্রমিকদের আনাগোনা। ব্যস্ত সময় পার করতেন পাটকলের কর্মকর্তা-কর্মচারিরাও। কিন্তু সেই কোলাহল এখন আর নেই। শিল্পাঞ্চলজুড়ে এখন শুধুই সুনসান নীরবতা।
সরকারি আদেশে পাটকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় থমকে গেছে সব কার্যক্রম। অবস্থা দৃস্টে মনে হচ্ছে- এ যেন এক অচেনা শিল্পাঞ্চল।
এদিকে, রাস্ট্রায়ত্ব পাটকল বন্ধে শ্রমিক পরিবারে চলছে বোবা কান্না। এক ধরণের নীরব আহাজারিতে শিল্পাঞ্চলের পরিবেশ যেন ভারি হয়ে উঠেছে। একদিকে মিল বন্ধ, অন্যদিকে ১২ থেকে ১৫ সপ্তাহের মজুরী বকেয়া থাকায় শ্রমিক পরিবারে বিরাজ করছে চরম হতাশা ।
এর আগে বৃহসপতিবার (২ জুলাই) রাতে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রনালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বিজেএমসি’র নিয়ন্ত্রনাধীন খুলনাঞ্চলের ৯টিসহ দেশের রাষ্ট্রায়ত্ব ২৫টি পাটকল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে শ্রমিকদের অবসায়ন (অব্যাহতি) করা হয়। এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন মিলের নোটিশ বোর্ডে টানানোর ২/৩ দিন আগে থেকেই খুলনা শিল্পাঞ্চল এলাকায় ব্যাপক পুলিশ মোতায়ন করা হয়।
এদিকে, কোন তারিখের মধ্যে শ্রমিকদের পাওনা প্রদান কারা হবে তার কোন কিছুই প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়নি। ফলে শ্রমিকদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে ।
মিল বন্ধ ঘোষণার পর দু’দিন শিল্পাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিনই ভোর ৬টার শিপ্ট থেকেই যেখানে শ্রমিকদের পদচারণায় মুখরিত থাকতো, সেখানে নেই কোন কোলাহল। থেমে গেছে সব উচ্ছ¡াস। পাটকলগুলোর হুইসেলের শব্দও আর শোনা যাচ্ছে না। শ্রমিকদের আনাগোনা না থাকায় সেখানে গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। এমনকি কুকুর-বিড়ালেরও দেখা নেই। যেন বিরাজ করছে এক ধরণের ভুতুড়ে পরিবেশ। তবে, মিলগুলোর পাহারায় নিরাপত্তা কর্মীরা দায়িত্ব পালন করছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ জুন রাষ্ট্রায়ত্ব ২৫টি পাটকল বন্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। মিল বন্ধের প্রতিবাদে শ্রমিদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল রক্ষা সিবিএ নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদ ২৮ জুন সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যেমে ২ দিনের আল্টিমেটাম দিয়ে অনশন কর্মসূচী ঘোষণা করেন। অবস্থান, বিক্ষোভ, সমাবেশ সহ শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনে শ্রমিক পরিবারের সন্তানরাও অংশ নেয় । শ্রমিকদের বুক ফাটা শ্লোগানে গোটা শিল্পাঞ্চল এলাকা ভারী হয়ে ওঠে। কিন্তু ৩০ জুন মিল বন্ধের নোটিশ না দেয়ায় শ্রমিক নেতারা কর্মসূচী স্থগিত ঘোষণা করেন।
এরই মধ্যে খালিশপুর পিপলস গোল চত্বর, দৌলতপুর জুট মিল গেট, আটরা ইস্টার্ণ মিল গেট ও নওয়াপাড়া শিল্প এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়ন করা হয়। পাটকল বন্ধসহ গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের আওতায় শ্রমিকদের অবসায়নের প্রজ্ঞাপন বৃহস্পতিবার রাতে একে একে প্লাটিনাম, ক্রিসেন্ট, খালিশপুর, দৌলতপুর, ষ্টার, ইস্টার্ণ, কার্পেটিং ও জেজেআই জুট মিলের নোটিশ বোর্ডে টানিয়ে দেয়া হয়।
মিল বন্ধর খবর দ্রæত ছড়িয়ে পড়লে মুহুর্তের মধ্যে হাজার হাজার শ্রমিক স্ব স্ব মিল গেটে সমবেত হন। প্রজ্ঞাপন পড়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। শ্রমিকদের আহাজারীতে ভারি হয়ে ওঠে শিল্পাঞ্চলের পরিবেশ। রাত ১০টায় মিলের শেষ হুইসেল শুনে শ্রমিকরা গেট ত্যাগ করেন।
শ্রমিকরা জানান, ১২ থেকে ১৫ সপ্তাহ পর্যন্ত মজুরী ও কর্মকর্তা- কর্মচরীদের ২ মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। বকেয়া মজুরী না পেলে পরিবার পরিজন নিয়ে অনাহারে থাকতে হবে। এখন কিভাবে চলবো, ছেলে-মেয়েদের মুখে কিভাবে খাবার তুলে দেব। এখন মৃত্যু ছাড়া কোন উপায় নেই।
অস্থায়ী শ্রমিকরা বলেন, মিল বন্ধ হওয়ায় চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। কোন সুবিধাই পাবোনা। সন্তানদের লেখা পড়া বন্ধ হয়ে যাবে। বাড়ী ফিরতে হবে শুন্য হাতে।
এদিকে, হঠাৎ করে মিলটির উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করায় অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে শ্রমিকরা। বন্ধের পর থেকেই অনেকে মিল এলাকা ত্যাগ করে গ্রামের বাড়ী যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল রক্ষা সিবিএ নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক আঃ হামিদ সরদার বলেন, আমরা এখন অসহায়। এই পরিস্থিতিতে এককালীন শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ ও পুনরায় মিলগুলো চালানোর জন্য দাবি জানান তিনি ।
বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের বিজেএমসি’র খুলনা আঞ্চলিক সমন্বয়কারী বনিজ উদ্দীন মিয়া জানান, সরকারি নির্দেশ অনুযায়ি ১ জুলাই থেকে রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলের শ্রমিকদের অবসানসহ মিলে উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরবর্তী সিদ্ধান্ত না পাওয়া পর্যন্ত মিল বন্ধ থাকবে।
পাটকল শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করা হবে :
খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক বলেছেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী খুলনার সাতটি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করা হবে। সরকার দেশের শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। পঞ্চাশ শতাংশ নগদ এবং বাকি অর্ধেক মুনাফাভিত্তিক সঞ্চপত্রের মাধ্যমে পরিশোধ করা হবে। তিনি শনিবার দুপুরে নগর ভবন সম্মেলনকক্ষে খুলনার সাতটি পাটকলের সিবিএ ও ননসিবিএ শ্রমিক নেতৃবৃন্দদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন।
মেয়র আরও বলেন, সরকার এবং প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপ (পিপিপি) এর মাধ্যমে মিলগুলো চালু থাকবে। পিপিপি’র আওতায় আধুনিকায়ন করে এসকল পাটকলগুলোকে উৎপাদনমূখী করা হবে। যারা দক্ষ শ্রমিক তাদের দিয়েই মিলগুলো চালানো হবে। শ্রমিকদের গ্র্যাচুইটি ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ চাকুরিবিধি অনুযায়ী পরিশোধ করা হবে। পাশাপাশি নিধারিত হারে গোল্ডেল হ্যান্ডশেকের সুবিধাও পাবেন।