চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃদুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) খুলনা অঞ্চলে ব্যাংকের অর্থ লুটসহ বিভিন্ন পর্যায়ের দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছে।,তবে খুলনার ওজোপাডিকো, ওয়াসা,কেডিএ,পানি উন্নয়ন বোর্ড,সওজ,স্থানীয় সরকার,স্বাস্থ দপ্তর,শিক্ষা প্রকৌশল.কর ও কাষ্টমস এবং পুলিশের দুর্নীতিসহ অনেক সরকারী চিহৃিত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এবং কর্মচারী ও রাঘববোয়াল এখনও দুদকের ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সম্প্রতি খুলনা অঞ্চলে ‘ঝটিকা অভিযানে’ অনেকটা সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে দুদক। এ ধরনের ‘ঝটিকা অভিযান’ দুর্নীতি রোধে তেমন একটা কার্যকর ভুমিকা পালন করতে পারেনি বা সফল হচ্ছে তা নিয়ে রয়েছে এক ধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
দুদক ইতিমধ্যে খুলনার সিভিল সার্জন অফিস, জেলা কারাগার, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি-বিআরটিএ, বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিস, ফুলতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, খুলনা সিটি করপোরেশন-কেসিসি, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-কেডিএ, ভুমি অফিস,ইউনিয়ন তহসীল অফিস,খানজাহান আলী (রহ.) সেতু, ড্রাগ সুপারের কার্যালয়, খুলনা রেলওয়ে এবং খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে ‘ঝটিকা অভিযান’ চালিয়েছে দুদক। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সূত্র মতে, দুদক-এর ‘ঝটিকা অভিযানে’ তাৎক্ষণিকভাবে একধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়। তবে, এ ধরনের অভিযানে কোন চিহৃত সরকারী দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা বা গ্রেফতার করতের সক্ষম হয়নি । এ অভিযান শুধু লোক দেখানো বলে মনে করেন অনেকেই । দুদক স্থায়ীভাবে দুর্নীতি রোধে সহায়ক ভূমিকা রাখে না। যদিও দুদক কোন সরকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুর্নিষ্ঠ অভিযোগে মামলা হলেও কয়েক বছর মামলা ঝুলে থাকার পর এক পর্যায় সংশ্লিষ্ঠ দুর্নীতিবাজকে দেয়া হয় অব্যাহতি । এমন নজিরও রয়েছে দুদকের । বরং কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তাকে আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যাবস্থা করা হলে দুর্নীতি প্রতিরোধে অধিক কার্যকর হবে বলে মনে করেন দুর্নীতি বিরোধী সংগঠন ও মানবাধিকার কর্মীরা। অপরদিকে দুদক সূত্র বলছে, মূলত দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক তৈরির উদ্দেশ্যেই ‘ঝটিকা অভিযান’ পরিচালনা করা হয়। এ ক্ষেত্রে অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা এবং তদন্তপূর্বক মামলা দায়ের করা হয়।
সূত্র মতে, স্বাস্থ্য সনদ বাবদ অতিরিক্ত অর্থগ্রহণের অভিযোগে গেল ১৯ নভেম্বর খুলনার সিভিল সার্জন অফিসে ‘ঝটিকা অভিযান’ চালায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাৎক্ষণিক অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণের প্রমাণ না মিললেও সনদ প্রদান রেজিস্ট্রার এবং সনদ প্রার্থীদের নাম, ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর না থাকায় অসন্তোষ প্রকাশ করে দুদুক টিম।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ১৬ এপ্রিল খুলনা জেলা কারাগারে অভিযান চালায়। দুদকের খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক নীলকমল পাল বলেন, ‘দর্শনার্থীদের কাছ থেকে ১০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা আদায়, কয়েদি বা হাজতিদের নিম্নমানের খাবার সরবরাহ ও অসুস্থদের তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে মেডিকেল ওয়ার্ডে রাখার অভিযোগের ভিত্তিতে জেলা কারাগারে অভিযান চালানো হয়। অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় সে বিষয়ে কারারক্ষী মো. শামীম হাসান, হুমায়ুন কবির ও মাহাবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়।’ তবে এ বিষয়ে কারাগারের জেলার জান্নাতুল ফরহাদ বলেন, দুদক অভিযানকালে কোনো অনিয়ম পায়নি।
খুলনা নগরের টুটপাড়া এলাকায় একটি ভবন নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ পেয়ে ১৯ আগস্ট খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কেডিএ) কার্যালয়ে দুদক অভিযান চালায়। দুদক বলছে, কেডিএ ভবনের নকশা অনুমোদন ও ভবন নির্মাণে নকশা অনুসরণ করছে না। অভিযানের সময় কেডিএর উপসহকারী প্রকৌশলী মাহমুদ হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ ছাড়া ভবনের অনুমোদিত নকশা নিয়ে নির্মাণাধীন ভবনে গিয়েও এর সঙ্গে মিল খুঁজে পাননি দুদক কর্মকর্তারা।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের আওতাধীন খুলনায় ড্রাগ সুপারের কার্যালয়ে ২ সেপ্টেম্বর অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ সময় ফার্মেসির লাইসেন্স দেওয়া ও নবায়নে অনিয়মের প্রমাণ পান দুদক কর্মকর্তারা। দুদক টিমের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, এ কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ না দিলে ফার্মেসির কোনো নতুন লাইসেন্স দেওয়া ও নবায়ন করা হয় না। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনায় আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সুপারিশ করা হবে বলে জানান অভিযানে থাকা সংস্থাটির কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটিÑ বিআরটিএ’র খুলনা সার্কেল অফিসে গেল ২৭ জানুয়ারি অভিযান চালায় দুদক। যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণসহ দালাল চক্রের দৌরাত্মের অভিযোগের ভিত্তিতে এ অভিযান পরিচালিত হয়। বিশেষ করে নতুন যানবাহনের রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে শো-রুমের পক্ষ থেকে গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ ছাড়া বিআরটিএ’র প্রতিটি ধাপে দালালদের অতিরিক্ত অর্থ নিয়ে রেজিস্ট্রেশন প্রদান, অন্য কাগজপত্র প্রদান, ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করা হয়Ñ এমন অভিযোগ ছিল দুদক টিমের কাছে।
খুলনা বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে ২০১৭ সালের ১৯ মে ঝটিকা অভিযান চালায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযানকালে সঠিকভাবে ফরম পূরণ করে জমা দিতে গেলে আর্থিক লাভের আশায় হয়রানি অভিযোগটির সত্যতা পায় সংস্থাটি। ফুলতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অর্ধ কোটি টাকার কাজে দুর্নীতি ও অনিয়ম তদন্তে ৩ সেপ্টেম্বর অভিযান চালায় দুদক। তাদের প্রাথমিক তদন্তে ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অনুকূলে বরাদ্দকৃত অর্ধ কোটি টাকার কাজে ব্যাপক অনিয়ম ধরা পড়ে। এ সময় দুদক টিম ওষুধ স্টোরে অভিযান ও রোগীদের সঙ্গে কথা বলা ছাড়াও এইচইডি কাজ পরিদর্শন করেন। সূত্র জানায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তিন ধাপে মোট ২৬ লাখ ৯৩ হাজার ২৭৪ টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দুই ধাপে মোট ২৪ লাখ ৭৯ হাজার ৫০০ টাকা, অর্থাৎ দুই অর্থবছরে প্রায় ৫১ লাখ ৭২ হাজার ৭৭৪ টাকা খুলনার ফুলতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া হয়। খুলনা স্বাস্থ্য প্রকৌশলের পক্ষ থেকে বরাদ্দকৃত অর্থের দ্বারা ঠিকাদারের মাধ্যমে হাসপাতাল ভবন সংস্কার, পেইন্ট, দরজা, জানালায় ও গ্রিলে রং, গামারি কাঠের দরজা স্থাপন, ৫৪টি জানালায় থাই গ্লাস ও গ্রিল স্থাপন, ছাদে আরসিসি প্যাড ঢালাইসহ বিভিন্ন কাজের কথা উল্লেখ করা হয়।
দুদক খুলনার উপ-সহকারী পরিচালক নীলকমল পাল বলেন, প্রাথমিক তদন্তে বেশ কিছু অনিয়ম ও অসংগতি পাওয়া গেছে। পূর্ণ অনুসন্ধানের মাধ্যমে সরকারি অর্থের সঠিক ক্ষতি ও আত্মসাতের পরিমাণ জানা যাবে। ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি বন্ধে খুলনা রেলস্টেশনে ৮ আগস্ট অভিযান চালায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ঈদ সামনে রেখে টিকিট বিক্রিতে অনিয়ম হচ্ছেÑ এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে এ অভিযান চালানো হয়। এ সময় তারা কালোবাজারে বিক্রির জন্য ঈদের ফিরতি ট্রেনের টিকিট ব্লক করে রাখার প্রমাণ পান। এ ছাড়া স্টেশন মাস্টারের বিরুদ্ধে পেনশন গ্রহণকারী প্রত্যেকের কাছ থেকে ১০০ টাকা করে উৎকোচ নেওয়ার প্রমাণও মেলে। দুদক খুলনার উপ-পরিচালক নাজমুল হাসান বলেন, অভিযানে বুকিং সহকারী মেহেদীকে শোকজ এবং বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সেই সঙ্গে স্টেশন মাস্টার মানিক লাল সরকারের বিরুদ্ধেও রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত স্টাফদের কাছ থেকে ১০০ টাকা করে উৎকোচ নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ কারণে তার বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে ঢাকায় সুপারিশ করা হয়। বর্তমানে তার সম্পদের হিসাবের তদন্ত চলছে বলেও জানান তিনি।
খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) লাইসেন্স শাখায় গেল ১১ এপ্রিল ঝটিকা অভিযান চালায় দুদক। এ সময় লাইসেন্স শাখায় দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা পায় সংস্থাটি। দুর্নীতির সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার অপরাধে ৫ কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করা হয়। নিম্নমান সহকারী ফারুক তালুকদার সিনিয়র লাইসেন্স অফিসারের দায়িত্বে থাকা এবং তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের বিষয়েও তদন্ত করছে সংস্থাটি। অভিযোগ ছিল, কেসিসির ট্রেড লাইসেন্স ফি থেকে গ্রাহকের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি নেওয়া এবং লাইসেন্স বইয়ের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার। দুদক ২০১৭ সালের ৪ জুলাই খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অভিযান চালায়। এ সময় দালাল চক্র ও নানা অনিয়মের ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করা হয়।
এদিকে, যানবাহনের শ্রেণি পরিবর্তন করে সেতুর টোলের টাকা অবৈধভাবে আত্মসাতের অভিযোগে ১৬ জুলাই রূপসা নদীর ওপর খানজাহান আলী সেতুতে অভিযান চালায় দুদক। সেতুর টোলপ্লাজায় সরকার নির্ধারিত হারে টোল আদায় না করে সরকারের রাজস্বের ক্ষতি করা হচ্ছেÑ এমন অভিযোগে অভিযানে দুদক টিম জানতে পারে, টোলগ্রহণে শ্রেণি অনুযায়ী হার নির্ধারণ করা থাকলেও ওই সেতুর ইজারাদার প্রতিষ্ঠান ‘ইউডিসি জিআইইটিসি জেভি’র নিয়োগ করা আদায়কারীরা যানবাহনের শ্রেণি পরিবর্তন করে অর্থ আত্মসাৎ করছেন। এ বিষয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য কমিশনে প্রতিবেদন পেশ করা হয়।
এ বিষয়ে দুদক খুলনা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক নাজমুল হাসান বলেন, দুদক’র ১০৬ নং হট লাইনে অভিযোগের কল পেয়ে প্রধান কার্যালয় থেকেই ‘ঝটিকা অভিযানের’ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। সে নির্দেশনা মোতাবেকই তারা অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, মূলত দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক তৈরির উদ্দেশ্যেই ‘ঝটিকা অভিযান’ পরিচালনা করা হয়। এ ক্ষেত্রে অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে ছোটখাটো দুর্নীতি হলে তাৎক্ষণিক তা চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুদক প্রধান কার্যালয়ে সুপারিশ প্রেরণ করা হয়। কিন্তু বড় ধরনের আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয় হলে সেটি তদন্তপূর্বক মামলা দায়েরের জন্য প্রধান কার্যালয়ে সুপারিশ করা হয়।
এফ এস ইসলাম
সম্পাদনা