কাজী মোতাহার রহমান :: মানুষের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সচেতনার পাশাপাশি চিত্তবিনোদনের জন্য সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের গুরুত্ব অপরিসীম। দক্ষিণ জনপদে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিকাশ, সুস্থ জীবন যাপনের পাশাপাশি শাসকদের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে খুলনার সরকারী গণমাধ্যমের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড প্রচার, চিত্তবিনোদনের জন্য সংস্কৃতির বিকাশ এবং লুকায়িত প্রতিভাকে আলোকিত করার লক্ষে ১৯৬১ সালে খুলনায় রেডিও সেন্টার স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কের উত্তর পাশে গল্লামারী ব্রীজের পশ্চিমে ও ময়ূর নদের পাড়ে পছন্দ করা হয় রেডিও সেন্টারের জন্য নির্ধারিত স্থান। প্রেসিডেন্ট জেঃ মোঃ আইয়ুব খানের শাসনামলে ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর কৃষ্ণনগর মৌজায় ৯৬ দশমিক ৯০ একর জমি হুকুম দখল করা হয় (প্রফেসর মোঃ বজলুল করিম রচিত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস)।
রেডিও সেন্টারের জন্য যে সব এলাকা হুকুম দখল করা হয় সেগুলো হচ্ছে কৃষ্ণনগর মৌজার জে.এল নং- ৮৪, সি এস দাগ নং- পূর্ণ ১৫৬, ১৫৭, ১৫৮, ১৫৯, ১৬০, ১৬১, ১৬২, ১৬৩, ১৬৫, ১৬৬, ১৬৭, ১৬৮, ১৬৯, ১৭০, ১৭১, ১৭২, ১৭৪, ১৭৫, ১৭৬, ১৭৭, ১৭৮, ১৭৯, ১৮০, ১৮১, ১৮৩, ১৮৪, ১৯৫, ১৯৬, ১৯৭, ১৯৮, ১৯৯, ২০০, ২২৩, ২২৪, ২২৫, ২২৬, ২২৭, ২২৮, ২২৯ এবং ১৫৬/৩২১ সিএস দাগ নং- আংশিক ১৮৫, ১৮৬, ১৮৭, ১৯১, ১৯২, ১৯৩, ১৯৪ এবং ২২০। পূর্ব পাকিস্তানের শেষ দিকে ১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট জেঃ আগা ইয়াহিয়া খানের আমলে সীমানা নির্ধারণে কাঁটা তাঁরের বেড়া ও অবকাঠামো নিমার্ণ কাজ শুরু হয়। দ্রুত সময়ের মধ্যে রেডিও সেন্টার ভবন ও ট্রান্সমিটার স্থাপন করা হয়। গল্লামারী তখন নির্জন এলাকা। নিরালা থেকে গল্লামারী রেডিও স্টেশন পর্যন্ত সড়কের আশে পাশে জনবসতি গড়ে ওঠেনি। সন্ধ্যার পর শিয়ালের ডাক শোনা যেত। তখনকার দিনে ওই সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল ছিল না।
ময়লাপোতা থেকে নিরালা পর্যন্ত পিচের রাস্তা, নিরালা থেকে গল্লামারী পর্যন্ত ইট বিছানো। ব্রীজের পশ্চিম পাশে রেডিও স্টেশনের প্রধান ফটক পর্যন্ত কাঁচা রাস্তা। রেডিও সেন্টারে প্রবেশের রাস্তাটি ছিল প্রশস্ত। সম্প্রচার ভবনের চারিপাশের ছিল ধান ক্ষেত ও নলখাগড়া বন। নলখাগড়া বনে পদ্ম গোখরা, কেউটে, কাল কেউটে ও ডোরা সাপের বাসস্থান। রেডিও সেন্টার সীমানার মধ্যে দু’চারটি খাল ছিল। মাঘ মাসের পর পানি শুকিয়ে গেলে এই খাল থেকে শিং, মাগুর, শৈল, কৈ, খোলসে ও রানা মাছ পাওয়া যেত। সম্প্রচার ভবনের পেছনে নারিকেল গাছের সারি। মনমুগ্ধকর পরিবেশ ছিল সেখানে।
খুলনা বিভাগের ১৬ জেলা (বরিশাল বিভাগ খুলনার মধ্যে অর্ন্তভুক্ত) গোপালগঞ্জ মহাকুমা নিয়ে গড়ে ওঠে খুলনা বেতার অঞ্চল। খুলনা রেডিও সেন্টার স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হলে এ অঞ্চলের শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবী, নাট্য সংগঠক, ক্রীড়াবিদ, শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়।
১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে রেডিও সেন্টার উদ্বোধনের প্রস্তুতি নেয়া হয়। ১২ নভেম্বর প্রলয়ংকরী ঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে দক্ষিণ জনপদ লন্ডভন্ড হয়ে যায়। এ সময় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের প্রচারাভিযান চলছিল। পরবর্তীতে ৪ ডিসেম্বর উদ্বোধনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করা হয়। ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসে কর্মকর্তা ও কর্মচারী যোগদান করতে শুরু করে। দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। শুরুতেই চেয়ার টেবিল ছিল না। দৈনন্দিন কার্যক্রম চালানোর জন্য নিউজপ্রিন্ট মিলের কর্মচারীরা কাগজ সরবরাহ করত। সম্প্রচার শুরু হওয়ার আগে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ নিয়োগ করা হয়।
আঞ্চলিক পরিচালক (সেন্টারের প্রধান) হিসেবে এম ইব্রাহীম আকন্দ, সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে আব্দুল মালেক খান ও আঞ্চলিক প্রকৌশলী হিসেবে বজলুল হালিম চৌধুরী যোগদান করেন। প্রকৌশল বিভাগের অন্যান্য কর্মকর্তারা হলেন আলাউদ্দিন আহমেদ, মাহবুবুর রহমান ও সাদাত হোসেন। অনুষ্ঠান প্রযোজক সামছুর আলী বিশ্বাস, মুন্সী আহসান কবীর, শেখ ওয়ালিউর রহমান, আব্দুস সাত্তার শেখ, অনুষ্ঠান সংগঠক কাজী মাহমুদুর রহমান ও গোলাম কবীর যোগদান করেন। ৬০ বছর বয়সী আব্দুর রহমান নামে একজন দারোয়ান ছিলেন। পাঞ্জাবী জোয়ানদের মত উঁচু লম্বা তার দেহের গঠন (মিউজিশিয়ান শেখ আলী আহমেদ রচিত খুলনা বেতারের জন্ম নামক প্রবন্ধ)।
শিল্পীদের সম্মানী মাসিক দুইশ’ পঁচিশ টাকা এবং কর্মকর্তাদের বেতন তিনশ’ পঁচিশ টাকা থেকে সাড়ে চারশ’ টাকার মধ্যে। প্রথম থেকেই বার্তা বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। এ আর শরীফ বার্তা সম্পাদক এবং এম আনিসুর রহমান সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। সাবেক উপ-বার্তা নিয়ন্ত্রক আহমেদ রেজা রচিত খুলনা বার্তা বিভাগের ক্রম বিকাশ ও উন্নয়ন কর্মকান্ডের ভূমিকা শিরোনামের প্রবন্ধে (বার্তা বন্ধন-দুই, ২০১৬) উল্লেখ করেন সংবাদ পাঠক ছিলেন সৈয়দ ঈসা, কাজী মোতাহার হোসেন, কাজী ওবায়দুল হক, সৈয়দা রেহানা আখতার, এ কে এ ফিরোজ নুন, মিয়া মুসা হোসেন, অবাঙালি মঈন পায়ামী প্রমুখ। তখন বেতারের কোনও সংবাদ কর্মী ছিলেন না। তথ্য অফিস, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এবং সংবাদ বিজ্ঞপ্তির ওপর নির্ভরশীল ছিল বার্তা বিভাগ। এসব মাধ্যম থেকে আসা খবর প্রচার হত।
১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর শুক্রবার বেলা ১১ টায় রেডিও পাকিস্তান, খুলনা কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পত্র। সংগৃহীত ছবি : সঙ্গীত শিল্পী শেখ আব্দুস সালাম।
উদ্বোধন
দক্ষিণাঞ্চলের সংস্কৃতিমনা মানুষদের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনার শেষ নেই। চারিদিকে সাজ সাজ রব। রেডিও ভবনকে ঘিরে উৎসবমুখর পরিবেশ। ৪ ডিসেম্বর শুক্রবার, বেলা ১১টায় উদ্বোধনের জন্য বিশিষ্টজনদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণপত্রে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর ভাইস এডমিরাল এস এম আহসানের নাম ছাপা হয়। তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন রেডিও পাকিস্তানের মহা-পরিচালক মফিজুর রহমান। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়নি। সম্প্রচার ভবনের সামনে সকাল সাড়ে ৯ টায় ঘোষিকা সৈয়দা রেহানা আখতার ও সুরাইয়া বেগম রোজীর কন্ঠে রেডিও পাকিস্তান, খুলনা কেন্দ্রের আত্মপ্রকাশের ঘোষণাটি ইথারে ইথারে দেশবাসীর কাছে পৌছে যায়। প্রযোজক ছিলেন অনুষ্ঠান সংগঠক গোলাম কবীর। পাইওনিয়ার মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষা নাঈমা জোহার পরিচালনায় কল্লোল নামে শিশুদের অনুষ্ঠান সম্প্রচার হয়। উদ্বোধন পর্বে আব্দুল হালিম চৌধুরী একটি উর্দু কোরাস গানের প্রযোজক ছিলেন। তিনি ঢাকা কেন্দ্রের সঙ্গীত প্রযোজক। এই অনুষ্ঠানের জন্য খুলনায় আসেন। স্থানীয় সঙ্গীত প্রযোজক ছিলেন সৈয়দ নূরুল ইসলাম মুফতি। উদ্বোধনী পর্বে কোরাস গানটির ভাষা ছিল “দে পানাহা দে ইয়া এলাহী”। কন্ঠ দেন শেখ আব্দুস সালাম, শেখ বজলার রহমান, খন্দকার সিদ্দিকুর রহমান, আসাদুজ্জামান, শাহ মোঃ ইয়াসিন, বিলকিস আনার, জেবুন্নেছা বেগম, আহসান আরা রুমী, সেলিনা আখতার প্রমুখ। সঙ্গীত মিউজিশিয়ানরা হচ্ছেন মোঃ সাদত্তকী (তবলা), শেখ আলী আহমেদ (বাঁশি), শেখ হাবিবুর রহমান (ক্লারিনিওয়েট), শেখ হাফিজ (বেহালা), হারুণ (দোতারা), অমূল্য রায় (মেন্ডুলিন), মানিকগঞ্জের মজনু মিয়া (তানপুরা) ও সঙ্গীত প্রযোজক আব্দুল মজিদ (জাইলোফোন)।
উদ্বোধনী দিনে কবি জসীম উদ্দীন রচিত পদ্মাপার নামক নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। নাটকটি প্রযোজনা করেন ঢাকা কেন্দ্রের নাট্য প্রযোজক মোয়াজ্জেম হোসেন। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন এস এম মতিউর রহমান, আব্দুল হাফিজ, দেলোয়ার হোসেন, নূর আলী (গার্ড সাহেব), সুরাইয়া, এ কে এম আলাউদ্দীন, সুকুমার সমাদ্দার প্রমুখ। উল্লেখযোগ্য যন্ত্রী শিল্পীরা হচ্ছেন সাধন সরকার, ওস্তাদ আব্দুল মালেক চিশতী, ওস্তাদ শামসুদ্দিন আহমেদ, মোঃ সাদত্তকী, শেখ আলী আহমেদ, মজনু মিয়া, আব্দুল মজিদ (খালিশপুরে শহিদ), শেখ হাবিবুর রহমান, রাশেদ উদ্দীন তালুকদার। সঙ্গীত শিল্পীরা হচ্ছেন শাম্মী আক্তার, শেখ আব্দুস সালাম, বিনয় রায়, গৌরি শংকর ঘোষ, শেখ বজলার রহমান, এস এম মাজেদ জাহাঙ্গীর, মোজাফ্ফর হোসেন জোয়ার্দ্দার, নাঈমা হক বুলা, শামীম বুলবুল, প্রণব ঘোষ, মাস্টার ইউসুফ, ননী গোপাল শীল, কামরুল ইসলাম বাবলু, আব্দুল মজিদ, গোলাম রসুল, মলিনা দাস, মাসুদ হোসেন জোয়ার্দ্দার, নির্মলেন্দু ঘোষ (যশোর), অজয় চক্রবর্তী (ঝিনাইদহ), মোশাররফ হোসেন (যশোর), ওবায়দুল কাদের (যশোর), সেলিনা আক্তার (যশোর)। ৪ ডিসেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২৭ দিনে খুলনা রেডিও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শ্রোতাদের পছন্দমত গান, নাটক প্রচার হওয়ায় ভারতের আসাম, বিহার, আসানসোল, কলকাতা, মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমান থেকে চিঠি আসত।
প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় দু’টি অধিবেশনে ৫৫ মিনিটের অনুষ্ঠান সম্প্রচার হত। বেতার কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে সঙ্গীত, নাটক, শিশুদের অনুষ্ঠান, সাহিত্য, শিল্পসহ বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন বিষয়ে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান প্রচার হওয়ায় শ্রোতার সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং ট্রানজিস্টার সেট বিক্রি ও বাড়ে। খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা রেডিও সেন্টারের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন।
অসহযোগ আন্দোলন
মার্চে অসহযোগ আন্দোলনের আগ থেকে রেডিও সেন্টারে পাঞ্জাবী সৈন্য মোতায়েন করা হয়। তাদের সংখ্যা ২০/২৫ জন। সৈন্যদের জন্য এখানে ক্যাম্প করা হয়। কড়া পাহারা আর নিষেধ শর্তেও খুলনা রেডিও সেন্টার থেকে স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে গান, নাটক, কথিকা ও সংবাদ প্রচার হয়। (বেতার বাংলা সম্পাদক কাজী মাহমুদুর রহমান রচিত গ্রন্থ বেতার কথা)। একাত্তরের মার্চ থেকেই অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেয় এই বেতার কেন্দ্র। ২ মার্চ থেকে দেশব্যাপী হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর ও সিলেট কেন্দ্রের বেতার কর্মীরা একাত্মতা ঘোষণা করেন। অনুষ্ঠানসূচির পরিবর্তন ঘটিয়ে গণউদ্দীপনা মূলক গান, অসহযোগের ঘোষণা, বহিরাঙ্গঁন অনুষ্ঠান, নাটক ও শ্লোগান প্রভৃতি প্রচার হতে থাকে। জাতীয় সংবাদ রাওয়ালপিন্ডি থেকে রিলে করে প্রচার হত। স্থানীয় সংবাদের অসহযোগ আন্দোলনকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়া হয়। ৪ মার্চ রেডিও পাকিস্তান, খুলনা কেন্দ্র নাম বর্জন করে খুলনা বেতার কেন্দ্র নামের সম্প্রচার শুরু হয়। নথিপত্র ইংরেজির পরিবর্তে বাংলায় ব্যবহৃত হতে থাকে।
সাত মার্চের ভাষণ
বাংলাদেশ বেতারের উপ-মহাপরিচালক আশরাফ উজ জামান তার স্মৃতি কথায় লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে বাঙালি জাতির উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় দিক নিদের্শনা দেবেন। স্মৃতি কথায় বেতার ব্যক্তিত্ব উল্লেখ করেন জাতির এমন এক মুহূর্তে বেতার কর্মীরা নীরব ভূমিকা পালন করতে পারে না। ৫ মার্চ জাতীয় পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ ও ডাকসুর ভি পি আ স ম আব্দুর রব বেতার ভবনে এসে রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণ সরাসরি সম্প্রচারের দাবি করেন। সন্ধ্যায় বেতারের কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনায় মিলিত হন। বঙ্গবন্ধু পরামর্শ দেন ‘যে ব্যবস্থা নিতে হয় ভেবে চিন্তে নেবেন, বিপদের সম্ভাবনা থাকলে প্রচার হবে না।’
বেতারের অনুষ্ঠান কর্মীরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যে কোন মূল্যে তারা ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করবেই। ঢাকা বেতার ভবনের সামনে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ক্যাম্প। গোপন স্থানে বৈঠকের মাধ্যমে বেতারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে। সরাসরি সম্প্রচারে টেলিফোন ও বিদ্যুতের সহায়তা প্রয়োজন হয়। ৬ মার্চ নাগাদ এ ব্যাপারে সকল আয়োজন চূড়ান্ত হয়।
টেলিফোন যোগে রেসকোর্স থেকে প্রদত্ত ভাষণ শাহবাগ বেতার স্টুডিওতে এনে প্রেরণ কেন্দ্রের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হবে ইথারে-ইথারে। সকল সংযোগ বার বার পরীক্ষা করে বঙ্গবন্ধুকে আয়োজন সম্পন্ন’র কথা জানানো হল। কোনও বাঁধার সৃষ্টি হয়নি জেনে তিনি খুশী হয়েছিলেন। ৬ মার্চ রাত ৮টার বাংলা সংবাদের পর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারে পূর্ব ঘোষণা দেয়া হয়। ঢাকার বাইরে সকল আঞ্চলিক বেতার কেন্দ্র থেকে রীলে করে প্রচারের নির্দেশ দেয়া হয়।
৭ মার্চ বেতার অফিস বন্ধ রেখে ট্রান্সমিটার থেকে পূর্বে রেকর্ডকৃত অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। আঞ্চলিক পরিচালকের নেতৃত্বে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারের দায়িত্বে নিয়োজিত অনুষ্ঠান ও প্রকৌশল কর্মীদেরকে বেতার ভবন ও ভাষণ মঞ্চে রাখা হয়। উপস্থাপনা সংগঠক মফিজুল হক এবং উপস্থাপনা তত্ত্বাবধায়ক বাহরাম সিদ্দিকীকে দেয়া হয়েছিল স্টুডিও’র তত্ত্বাবধানে। স্টুডিওর বুথে ছিলেন অনুষ্ঠান সংগঠক আশফাকুর রহমান খান। মাষ্টার কন্ট্রোল রুমে রেডিও ইঞ্জিনিয়ার মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে ছিলেন সহকারি প্রকৌশলীরা। ভাষণ মঞ্চে আঞ্চলিক পরিচালক আশরাফ-উজ-জামান এর নেতৃত্বে কর্মরত ছিলেন সহকারি আঞ্চলিক পরিচালক আহমদ উজ জামান, অনুষ্ঠান সংগঠক নাসির আহমেদ চৌধুরী, অনুষ্ঠান সংগঠক কাজী আব্দুর রফিক, ইঞ্জিনিয়ার ফজলুর রহমান এবং আরও কয়েকজন প্রকৌশল কর্মী।
সকাল থেকে ঢাকার রাজপথে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। দলে দলে মানুষ মিছিল করে নানা রকম শ্লোগান সহকারে এগিয়ে যাচ্ছে রেসকোর্স ময়দানের দিকে। প্রায় সকলের হাতেই পতাকা, লাঠি কিংবা শ্লোগান শোভিত প্লাকার্ড। দূর-দূরান্ত, গ্রাম-গ্রামান্তর থেকেও মিছিল আসছে শহরে। সকাল দশটা থেকেই লোকে লোকারণ্য রেসকোর্স ময়দান। এত মানুষের সমাবেশ ঢাকায় আর কখনও দেখা যায়নি।
এদিকে দুপুর বারোটায় দ্বিতীয় অধিবেশনের শুরু থেকেই বার বার প্রচার করা হচ্ছিল ভাষণের পূর্ব ঘোষণা। সেই সাথে অসহযোগের শ্লোগান এবং দেশাত্মবোধক গান এক নম্বর স্টুডিওতে অনুষ্ঠান ঘোষণায় ছিল মঞ্জুর কাদের (শব্দ সৈনিক বাবুল আকতার)। আশফাকুর রহমান খান স্টুডিওর বুথে প্যানেল পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। মনিটরে হটলাইনে রেসকোর্স ময়দানে অপেক্ষমান মানুষের কোলাহল ও শ্লোগান শোনা যাচ্ছিল। এত সতর্কতামূলক আয়োজনের মধ্যে এক আশঙ্কা মন থেকে মুছে ফেলা যাচ্ছিল না- যদি শেষ মুহূর্তে কোন বাঁধা আসে! এজন্য বেতার ভবনের সবগুলো টেলিফোনের রিসিভার ক্রেডেল থেকে নামিয়ে রাখা হয়েছিল যাতে বাইরে থেকে কেউ ফোনে সংযোগ করতে না পারে। কিন্তু দুভার্গবশতঃ সেই আশঙ্কাই সত্য হলো। বার্তা বিভাগের সহকারী বার্তা সম্পাদক মহসিন উদ্দিন আহমদ বিকেল তিনটায় বৈকালিক পালায় কাজ করতে এসে তার টেলিফোনের রিসিভার নামানো দেখেন। এর কারণ জানা ছিল না বলে সেটি যথাস্থানে উঠিয়ে রাখেন। সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোন বেজে উঠলো। মহসিন রিসিভার তুলতেই অপর প্রান্ত থেকে সামরিক বাহিনীর গণমাধ্যম কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালেক সামরিক কর্তৃপক্ষের একটি ইংরেজি বার্তা পড়ে শোনায়। যার মর্মার্থঃ “পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের কোন ভাষণ বেতারে প্রচার করা যাবে না”। মহসিন তখনই বার্তাটি একটি চিরকুটে লিখে উপস্থাপনা সংগঠক মফিজুল হককে দিলেন। মফিজ সাহেব হট লাইনে বার্তাটি মঞ্চে অবস্থানরত আঞ্চলিক পরিচালককে পড়ে শোনান।
ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুর গাড়ি সভাস্থলে পৌঁছে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে ১০ লক্ষাধিক কন্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে মহাসমুদ্রের গর্জন ঃ ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’। বঙ্গবন্ধু মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে সেই শ্লোগানে সাড়া দিচ্ছিলেন। এ সময় আঞ্চলিক পরিচালক দ্রুত তাঁর কাছে গিয়ে তাঁকে সামরিক কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞার কথা জানালেন। এ কথা শুনে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণের মধ্যে নির্দেশ দিলেন “মনে রাখবেন কর্মচারীরা রেডিও যদি আমাদের কথা না শুনে, তাহলে কোন বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, তাহলে টেলিভিশনে যাবেন না।” এই নির্দেশ হটলাইনে শোনার পর বেতার কর্মীরা আঞ্চলিক পরিচালকের কথা মতো কোন ঘোষণা ছাড়াই তাৎক্ষণিকভাবে সম্প্রচার বন্ধ করে বেতার কেন্দ্র থেকে বের হয়ে সভা মঞ্চের সহকর্মীদের সাথে মিলিত হয়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বেতারে প্রচার সম্ভব না হলেও মঞ্চে কর্তব্যরত বেতার কর্মীরা একটি ছোট মেশিনে সম্পূর্ণ ভাষণ রেকর্ড করেন।
বঙ্গবন্ধু “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” এই ঐতিহাসিক ঘোষণা দিয়ে ভাষণ শেষ করার পর এ্যালিফ্যান্ট রোডে কাজী রফিকের বাসায় আঞ্চলিক পরিচালকের নেতৃত্বে বেতার কর্মীরা এক জরুরী সভায় মিলিত হন। সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়-বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার না করা হলে, বেতারের সব অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ থাকবে এবং কোন কর্মী বেতার কেন্দ্রে যাবে না। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার ফলে সেদিন ঢাকা বেতার কেন্দ্রের তৃতীয় অধিবেশন অর্থাৎ বিকেল, সন্ধ্যা ও রাতের অনুষ্ঠান প্রচার সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে দেশের উভয় অংশ এবং বহির্বিশ্ব ঢাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে থাকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে। খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে পিন্ডির প্রভুরা। তারা পূর্বাঞ্চলের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে অবিলম্বে ঢাকা বেতার কেন্দ্র চালু করার জন্য নির্দেশ দেন। এ সময় আঞ্চলিক পরিচালক তার বাসা ছেড়ে অন্যত্র অবস্থান করছিলেন। অনেক খোঁজাখুজির পর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী রাত ১০টার দিকে টেলিফোনে তাঁকে ঢাকা বেতার কেন্দ্র চালু করতে বলেন। আঞ্চলিক পরিচালক তাঁকে জানান, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করতে না দিলে, কর্মীরা বেতার কেন্দ্রে যাবে না।’ জেনারেল রাও তখন ভাষণ প্রচারে সম্মতি জানিয়ে অবিলম্বে অনুষ্ঠান প্রচার করতে বলেন। আঞ্চলিক পরিচালক তাঁকে জানান, ‘প্রকৌশল এবং অনুষ্ঠান শাখার কর্মীদের খবর দিয়ে এনে স্টুডিও এবং ট্রান্সমিটারের যন্ত্রপাতি চালু করে অনুষ্ঠান প্রচার রাতের অধিবেশনের সময়সীমার মধ্যে সম্ভব নয়। তার চেয়ে পরদিন ভোর থেকে পূর্ব ঘোষণা দিয়ে সকালে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করলে ভালো হবে।’ অগত্যা জেনারেল রাও ফরমান আলী আঞ্চলিক পরিচালকের কথা মেনে নিলেন।
পরদিন অর্থাৎ ৮ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট ও খুলনা কেন্দ্র থেকে একযোগে প্রচারিত হয়। এরপর ২৫ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন ৬টি বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ সম্পূর্ণ অথবা নির্বাচিত অংশ প্রচার করা হয়।
পাকিস্তান সরকারের একান্ত আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান ছিল রেডিও পাকিস্তান। তারই অধীনস্থ বাঙালি বেতার কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ বেতারে প্রচারের দাবিতে যে বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত এবং সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তার কাছে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা প্রথমবারের মত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। বাঙালি বেতার কর্মীদের ভূমিকা ও অবদান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে যথাযোগ্য স্থান লাভের দাবি রাখে।
সে সময়কার অনুষ্ঠান প্রযোজক (পরবর্তীতে আঞ্চলিক পরিচালক) সামছুর আলী বিশ্বাস স্থানীয় দৈনিকে দেয়া সাক্ষাতকারে (৮মার্চ, ২০১৪) উল্লেখ করেন অনুষ্ঠান প্রযোজক আব্দুস সাত্তার শেখ ও ওয়ালিউর রহমান ভাষণটি ৮মার্চ খুলনা কেন্দ্র থেকে প্রচারে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। ২৫ মার্চ পর্যন্ত ভাষণটি বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার হয়।
পঁচিশে মার্চ
বেতারের কর্মকর্তা কাজী মাহমুদুর রহমান রচিত বেতার কথা নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ২৫ মার্চ বিকেলের অনুষ্ঠান শেষে কর্মকর্তারা বেতার ভবন ত্যাগ করে। রাতে গণহত্যা, গুলিবর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের কারণে শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শহরের রাস্তা জনশূন্য হয়ে পড়ে। রিক্সা, বাস, ট্রাক অগ্নিদগ্ধ ও দোকানের ওপর গুলিতে ঝাঁঝরা করার চিহ্ন পাওয়া যায়। শহরের প্রধান প্রধান মোড়ে সশস্ত্র সেনা পাহারা ছিল। ২৬ মার্চ সকাল থেকে বেতারের সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। আঞ্চলিক পরিচালক ইব্রাহীম আকন, সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক আব্দুল মালেক খান ও বার্তা সম্পাদক এ আর শরীফ স্ব-পরিবারে বয়রা সার্কিট হাউজে অবস্থান করতেন। ২৫ মার্চ রাতের অপ্রত্যাশিত ঘটনার পর তারা কেউ বাসভবনের বাইরে আসেননি। ২৬ মার্চ সেনা সদর দপ্তর থেকে আঞ্চলিক পরিচালকের কাছে নির্দেশনা আসে রেডিও স্টেশন চালু করার জন্য। কেউ বাইরে আসতে সাহস পাচ্ছে না। সেনা সদস্যরা বহির্বিশ্বের কাছে দেখাতে চেয়েছিল পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। তথ্য অফিসের জনসংযোগ কর্মকর্তার সহযোগিতায় সেনাবাহিনী বেতার কর্মকর্তাদের বাসভবনের ঠিকানা নিয়ে তাদেরকে গল্লামারী বেতার ভবনে আসতে বাধ্য করে।
এর আগে নেভীর অবাঙালি ইঞ্জিনিয়ারদের দিয়ে রেডিও ভবনের ট্রান্সমিটার চালু করার চেষ্টা করে। বেতার ভবনে আসার আগে বেতারের কর্মকর্তারা ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা শুনতে পায়। কিন্তু খুব গোপনেও কাউকে বলতে সাহস পায়নি। আঞ্চলিক প্রকৌশলী বজলুল হালিম চৌধুরী, বেতার কর্মকর্তা কাজী মাহমুদুর রহমান ও গোলাম কবির বেতার ভবনে এসে সম্প্রচার চালু করে। সামরিক নির্দেশ মত উর্দু ও বাংলা গান বাজানো শুরু হয়। সেনা কর্মকর্তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী কোন রকম দুঃখের গান, হামদ ও নাত বাজানো যাবে না। বেতার কর্মকর্তাদের ওপর আরও নির্দশনা ছিল জয় বাংলা জাতীয় কোন অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রচার করেল অ্যাক্ট অব সাবোটার্জ হিসেবে গণ্য করা হবে এবং একমাত্র শাস্তি হবে মৃত্যুদ-। ভারত বিরোধী প্রচার জোরদার এবং পাকিস্তানকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য জনমত গঠনে অনুষ্ঠান প্রচার করতে হবে। রেডিও ভবনে অবস্থানরত সেনা সদস্যরা বাঙালি বেতার কর্মকর্তাদের বিশ্বাস করত না। বেতার ভবনের বাইরে যাওয়ার অনুমতিও ছিল না। প্রায় প্রতিদিন স্থানীয় সেনা সদর দপ্তরে বেতার কর্মকর্তাদের নিয়ে নতুন নির্দেশনা দেয়া হত। এ সময় কয়েকজন উর্দু ভাষী ঘোষক ও সংবাদ পাঠক নিয়োগ দেয়া হয়। তারা পাকিস্তানীদের প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠে। এভাবে তিন চার দিন মার্চের শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠান প্রচার হতে থাকে। পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার পক্ষে, ভারত বিরোধী প্রচারণা, আওয়ামী লীগ বিরোধী প্রচারণা, ছাত্রলীগ ও সংখ্যালঘুরা দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে নানা অনুষ্ঠানাদি প্রচার করা হত। ইপিআর, বাঙালি সেনা ও পুলিশদের স্ব-স্ব কর্মস্থলে ফিরে আসার নির্দেশনা প্রচার হত। এপ্রিলের প্রথম দিক থেকে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, পিডিপি ও নেজামে ইসলামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত রাজনীতিকরা কথিকা পাঠ করতেন। দুই একজন সাংবাদিকও এই কথিকা পাঠের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। মোট কথা রেডিওর অনুষ্ঠান এমনভাবে প্রচার হত শ্রোতারা মনে করতের দক্ষিণাঞ্চলের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
রেডিও সেন্টার দখলের যুদ্ধ
সেনানিবাস থেকে বাঙালি সৈনিক, ইপিআর, বাঙালি পুলিশ ও আনসার স্ব-স্ব কর্মস্থল ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাঙালি সেনা কর্মকর্তা মেজর এম এ জলিল এ সময় ছুটিতে বরিশালের গ্রামের বাড়িতে আসেন। ২৫ মার্চ গণহত্যা ও ২৭ মার্চ বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা পর তিনি আর চাকরিতে ফিরে যাননি। বরিশালের সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ২৭ মার্চ রাতের এক বৈঠকে ছুটিতে আসা মেজর এম এ জলিলকে দক্ষিণাঞ্চলের যুদ্ধের প্রস্তুতির এবং অধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, বরগুনা, বাগেরহাট ও খুলনা নিয়ে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকা। মুজিবনগর সরকার গঠনের পর এলাকাকে ৯ নম্বর সেক্টর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মে মাসে মুক্তিবাহিনী গঠনের পর থেকে বিজয় পর্যন্ত এবং পরবর্তীতে ফুলতলায় অস্ত্র জমা দেয়া পর্যন্ত মেজর এম এ জলিল ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দক্ষিণাঞ্চলের এই অধিনায়ক বাগেরহাট মহাকুমা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক আব্দুর রহমানের সাথে ৩ এপ্রিল তারিখে দেখা করতে বাগেরহাটে আসেন। বিপ্ল¬বী পরিষদের চেয়ারম্যান তার আগেই পূর্ব রূপসায় জাহানারা মঞ্জিলে যুব সমাজকে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প গড়ে তোলেন।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল ওহাবের বর্ণনা মতে বিভিন্ন স্থান থেকে ইপিআর, পুলিশ ও আনসার অস্ত্রসহ দেবীপুর গার্লস স্কুলেও ক্যাম্প গড়ে তোলে। মেজর এম এ জলিলের বাগেরহাট আগমণের খবর পেয়ে বিপ্লবী পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ কামরুজ্জামান টুকু দেখা করতে যান। মুক্তিযুদ্ধের এই অধিনায়ক কামরুজ্জামান টুকুকে অবহিত করেন চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণার পর মানুষ একটি বেতার কেন্দ্রের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি এবং যোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দেয়ার জন্য একটি বেতার কেন্দ্র অপরিহার্য। তাই তিনি গল্লামারীস্থ রেডিও পাকিস্তান, খুলনা কেন্দ্র দখলের জন্য বিপ্লবী পরিষদের চেয়ারম্যানকে পরামর্শ দেন। এ খবর বেতারের কর্মকর্তাদের কাছে ইতোমধ্যে পৌঁছে যায়। তাদের মধ্যে অনেকেই নিরাপদ স্থানে সরে পড়ে। বিপ্লবী পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান টুকু বাগেরহাট থেকে ক্যাম্পে ফিরে রেডিও সেন্টার দখলের পরিকল্পনা নিতে থাকে। শহরের চারিদিকে পাক সেনা টহল দিচ্ছে। ৪ এপ্রিল রাতে বেতার কেন্দ্র দখলের সিদ্ধান্ত হয়। যুদ্ধের অধিনায়ক নির্বাচন করা সেনাবাহিনীর অবসর প্রাপ্ত সুবেদার মেজর শেখ জয়নুল আবেদীনকে। যুদ্ধের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন বিপ্লবী পরিষদের চেয়ারম্যান। রাত আনুমানিক ৯টা নাগাদ মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলটি গল্লামারী রেডিও স্টেশনের উদ্দেশ্যে রূপসা ত্যাগ করেন। রাত আনুমানিক ১০টার দিকে নৌকা যোগে সশস্ত্র যোদ্ধারা রূপসা নদী পার হচ্ছিলেন। হঠাৎ এক যোদ্ধার রাইফেল থেকে গুলি বের হয়ে মাঝির গায়ে লাগলে তিনি প্রাণ হারান। তবুও যোদ্ধারা মনোবল হারায় নি। নিরালার দিকে অগ্রসর হয়। এই দলের ছিল আনুমানিক আড়াইশ’ যোদ্ধা। যুদ্ধের অধিনায়ক জয়নুল আবেদীন অনুধালুপ্ত নিরালা বাজারের বিপরীতে সিটি কলেজ হোস্টেলের কাছে তার দলবল নিয়ে অবস্থান করেন। যেন শহর থেকে পাক বাহিনী গল্লামারী রেডিও সেন্টারের দিকে না আসতে পারে। পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য যুদ্ধের অধিনায়ক সিটি কলেজ হোস্টেলের কাছে অবস্থান নেয়। শেখ কামরুজ্জামান টুকু ও নায়েক সিদ্দিক রেডিও সেন্টারের দক্ষিণ দিকে অবস্থান নেয়। চল্লিশ পঞ্চাশজন যোদ্ধা ক্যাপ্টেন আশিফুর রহমানের নেতৃত্বে পশ্চিম দিকে অবস্থান নেয়।
৪ এপ্রিলের প্রথম প্রহরে রেডিও স্টেশন দখলের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ শুরু হয়। রেডিও স্টেশনে অবস্থানরত পাক বাহিনী পাল্টা গুলি ছোঁড়ে। রাতের নীরাবতা কেটে যায়। আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়ে পশ্চিম বানিয়াখামার, গল্লামারী ও হাজীবাড়ি এলাকার অধিবাসীরা। পাকিস্তান বাহিনীর অবস্থান ছিল রেডিও ভবনের পশ্চিম পাশে একটি টিন সেডে, উত্তর পাশে ও প্রধান ফটকের পাশে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না থাকায় তাদের সামনে এগুতে অসুবিধা হচ্ছিল। গল্লামারী রেডিও স্টেশন এলাকায় যুদ্ধ হচ্ছে এ খবর পেয়ে শিপইয়ার্ড ও সার্কিট হাউজে অবস্থানরত পাক সেনারা ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সাহসী দল আনুমানিক রাত দু’টার দিকে উত্তর-পশ্চিম পাশের কলাবাগানের ভেতর দিয়ে বেতারের কাঁটা তারের বেড়ার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। পাক সেনাদের গুলিবর্ষণের ফলে এই দলটি ভেতরে ঢুকতে পারেনি। শেখ কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বাধীন দলটি রেডিও সেন্টারের প্রধান ফটকের কাছাকাছি চলে যায়। বিপদ আসন্ন দেখে সেনাবাহিনী বিরামহীন গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এ সময় দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরীর কর্মচারী হাবিবুর রহমান খান একটি বোমা নিয়ে মেইন গেট টপকিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে। তার অবস্থান স্পষ্ট হলে সেনাবাহিনী গুলি চালায়। গেটের কাছে হাবিবুর রহমান প্রাণ হারায়। এখানের যুদ্ধে মোসলেম নামক এক আনসার সদস্য শহিদ হয়। যুদ্ধের অধিনায়ক সুবেদার মেজর শেখ জয়নুল আবেদীন সিটি কলেজ ছাত্রাবাসারে পূর্ব দিকে একতলা ভবনে অবস্থান করেন। পাকিস্তানী সেনাদের কয়েকটি ট্রাক শের-এ-বাংলা রোড দিয়ে রেডিও স্টেশনের দিকে যাত্রা করলে যুদ্ধের অধিনায়ক ট্রাকের চাকায় গুলি করে গতি থামিয়ে দেয়। পাকিস্তানী সেনারা গাড়ি থেকে নেমে ট্রাক ঠেলে সামনে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলে অধিনায়কের রাইফেল গর্জে ওঠে। ঘটনাস্থলেই দশ-বার জন পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়। প্রতিপক্ষের গুলি এসে বিদ্ধ হয় অধিনায়ক জয়নুল আবেদীনের শরীরে। তিনি ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। অংশগ্রহকারী মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলে নিরাপদ স্থানে চলে যায়। বেতার কেন্দ্র দখলের অভিযান সফল হয়নি। মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্র ত্যাগ করেন। সকালে স্থানীয় জনগণ জানাজা শেষে সিটি কলেজ ছাত্রবাসের কাছে জয়নুল আবেদীনের দাফন সম্পন্ন করেন। এই বীর যোদ্ধার ডাক নাম মানিক মিয়া। তিনি ১৯২৮ সালে বাগেরহাট মহকুমার চিতলমারী থানার আড়–য়াবর্নি গ্রামের শেখ পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম শেখ লেহাজ উদ্দিন। মুক্তিযুদ্ধে শহিদ অধিনায়ক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে অংশগ্রহণের স্বীকৃতি স্বরূপ 1939-45 2nd world war Medal. Pakistan Medal Repubic commermoration, Tamgh-l-jang. Sitara-l-Harie. পদক পান। এই বীরযোদ্ধা স্বাধীনতার পর কোন খেতাব পাননি।
পাকিস্তান সরকারের সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী ও মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা আব্দুস সবুর খান ১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল খুলনা রেডিও স্টেশনে এসে মুজিবনগর সরকারের বিরুদ্ধে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নেন। পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার জন্য পাড়ায় মহল্লায় শান্তি কমিটির গঠনের ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। তখনকার দিনে শান্তি কমিটিকে ইংরেজিতে পীচ কমিটি বলা হত। এই শব্দটি সচারাচার চালু ছিল। মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামী ইসলাম ও পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি -পিডিপি’র সমন্বয়ে গড়ে ওঠে শান্তি কমিটি। স্থানীয় ডাকবাংলা ভবন ছিল পীচ কমিটির কার্যালয়। জামায়াতে ইসলামীর নেতা ও মুক্তিযুদ্ধকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের রাজস্বমন্ত্রী মাওলানা এ কে এম ইউসুফ খুলনার শান্তি কমিটির প্রধান ছিলেন। তার স্বাক্ষরিত পরিচয়পত্র ব্যবহার করত পাকিস্তানী অনুসারীরা। উল্লিখিত রাজনৈতিক দলের সমর্থক ছাড়াও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য, হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক, মাদ্রাসার শিক্ষক, মোড়ল, মাতব্বররা ছিল শান্তি কমিটির সদস্য।
নির্যাতন সেল
৪ এপ্রিল যুদ্ধের পরেও বেতার কেন্দ্রে অবস্থানরত সেনাবাহিনী আরও সতর্ক হয়। মাঝে মধ্যে সেনাবাহিনীর গাড়ি এই এলাকায় টহল দেয়। পাকিস্তানী সেনা সদর দফতরের নির্দেশনা মোতাবেক অনুষ্ঠানাদি প্রচার করা হয়। ১৬ জুন তারিখে রেডিওর অন্যান্য শিল্পীরা যোগদান করতে শুরু করে। শিল্পীদের উর্দুতে গান গাওয়াতে বাধ্য করা হত। সেনারা স্টুডিওর কাছেও অবস্থান করত। মিউজিশিয়ান শেখ আলী আহমেদের বর্ণনানুযায়ী একজন পাঞ্চাবী সৈন্য স্টুডিওতে ঢুকে তানপুরা নামক যন্ত্রটি দেখে বিস্মিত হয়। সেনা সদস্যকে বুঝানো হয় যন্ত্রটির নাম তানপুরা। উর্দুতে তার অভিমত ছিল “ইৎনা ব্যাড়া ঢোল”। তিনি আরও একদিনের বর্ণনা করতে যেয়ে বলেন, জুলাই মাসের দিকে “গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ গানটি যখন রেডিওতে সম্প্রচার হচ্ছিল পাঞ্জাবী সেনা না বুঝে মাথা দোলাতে থাকে। একজন শিল্পীর কাছে জানতে চায় “ইয়ে কিয়া গানা হায়”। শিল্পী তার জবাবে জানায় এটি রবীন্দ্র সঙ্গীত। গানটি কে লিখেছে সেনা সদস্য জানতে চাইলে তাকে অভিহিত করা হয় গীতিকার কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঠাকুর শব্দটি শোনার পর সেনা সদস্য মালাউন বলে আখ্যায়িত করে রাইফেলের বাট দিয়ে ট্রানজিস্টার সেটটি ভেঙ্গে ফেলে।
বেতারের অনুষ্ঠানাদি নির্দেশনা দিতে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আঞ্চলিক পরিচালক ইব্রাহিম আকনকে রাওয়ালপিন্ডিতে জরুরী সভায় তলব করা হয়। সেখানকার সভায় নির্দেশনা দেয়া হয় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও রাজাকার বাহিনীকে উৎসাহিত করতে হবে। শান্তি কমিটির সদস্যদের অনুষ্ঠানাদিতে উপস্থিতি করে পাকিস্তানের পক্ষে জনমত গঠন করতে হবে। মুক্তিবাহিনীকে দুস্কৃতকারী, ভারতীয় দুশমন ও আওয়ামী লীগকে দেশদ্রোহী দল বলে আখ্যা দিয়ে কথিকা, খবর ইত্যাদি প্রচার করতে হবে। তাদের পরামর্শ মোতাবেক মে মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত খুলনা কেন্দ্রের অনুষ্ঠানাদি চলে। এ সময়কার একটি দিনের স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে মিউজিশিয়ান শেখ আলী আহমেদ আরও উল্লেখ করেন, অনুষ্ঠান প্রযোজক সৈয়দ নুরুল ইসলাম মুফতি গল্লামারী ব্রীজের ওপর দিয়ে বেতার কেন্দ্র অভিমুখে আসছিলেন। ব্রীজের ওপরে সেনা সদস্যরা তার পরিচয় জানতে চান। নামের শেষে মুফতি সেনা সদস্যরা শোনে মুক্তি। মুক্তি শব্দটা শুনলেই তারা উত্তেজিত হয়ে যেত। মুক্তিবাহিনীর সদস্য ভেবে সেনারা নুরুল ইসলাম মুফতিকে গুলি করতে উদ্যত হয়। আঞ্চলিক পরিচালক ঘটনাস্থলে এসে এই বলে শনাক্ত করেন তিনি মুক্তি বাহিনীর সদস্য নয়, রেডিওর কর্মকর্তা এবং মুসলমান। তিনি সে যাত্রায় প্রানে বেঁচে যান। খালিশপুরের বিহারীরা আব্দুল মজিদ নামে সঙ্গীত প্রযোজককে হত্যা করে।
রেডিও সেন্টারের সন্নিকটে গল্লামারী এলাকাটি ছিল অত্যন্ত নির্জন। চারিপাশে ধান ক্ষেত। সেনাবাহিনী বিভিন্ন স্থান থেকে বাঙালি নারী পুরুষকে ধরে এনে এখানে জবাই ও গুলি করে হত্যা করত। অনেকের ভাগ্যে জানাজা ও কাফন জোটে নি। মে-ডিসেম্বর পর্যন্ত গল্লামারী ছিল কসাইখানা। রেডিও সেন্টারের সম্প্রচার ভবনের পেছনে দোচালা একটা ঘর ছিল। এই ঘরে আড়ার সঙ্গে পা ওপরের দিকে বেঁধে-ঝুলিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থকদের নির্যাতন ও বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে হত্যা করা হত। শেষে নিথর দেহ ভাসিয়ে দেয়া হত গল্লামারীর সংলগ্ন ময়ূর নদে। সাংবাদিক ও গবেষক গৌরাঙ্গ নন্দী বৃহত্তর খুলনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উল্লেখ করেছেন বেতার ভবনের দোচালা ঘরটিতে দেশ স্বাধীনের পর অনেকেই নির্যাতিতদের রক্তমাখা জামা কাপড় দেখতে পেয়েছেন। রক্ত দিয়ে একজন নির্যাতিত দেয়ালে লেখেন “মা তোমার সাথে আমার আর দেখা হবে না”। ভবনের আশেপাশে পাকিস্তানী বাহিনীরা ট্রাকে করে লাশ এনে গল্লামারী বিলে ও ময়ূর নদের খালে ফেলে দিত। পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকাররা রেডিও ভবনের পাশে বাঙালি নারী পুরুষদের হত্যা করার পর ছোরা রেডিও স্টেশনের টিউবওয়েলের পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলত। গল্লামারী সড়কের দুই পাশ দিয়ে কুকুরগুলো মানব দেহ খাওয়ায় ব্যস্ত থাকত।
গল্লামারী বধ্যভূমির বর্ণনা দিতে যেয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন যুদ্ধকালীন সময় কোন সুস্থ মানুষ প্রাণের ভয়ে গল্লামারী এলাকায় আসতে চাইত না। এখানে সচারাচর লাশ পাওয়া যেত ধান ক্ষেতে, পাট ক্ষেতে ও ময়ুর নদের পাড়ে। স্বাধীনতার পর এখানে নরকঙ্কালের স্তুপ পাওয়া গেছে। গল্লামারী এলাকায় শান্তি লতা সাহা নামে এক নারীকে হত্যা করা হয়। তিনি ফুলতলা থানার দামোদর সাহাপাড়া গ্রামের অধিবাসী। নকশাল আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১০ আগস্ট দাকোপ থানার গড়খালী গ্রামের মাহাতাব বিশ্বাসকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে আসে। ১১ আগস্ট রেডিও সেন্টারের ঐ নির্যাতন ভবনে তাকে হত্যা করা হয়। তার স্ত্রী সুখজান বিবির জবানবন্দী থেকে গবেষক উল্লেখ করেন এ ঘটনার সাথে জড়িত রাজাকাররা হচ্ছে নওশের শেখ, জহুর শেখ, সোহরাব মোল্লা, হামিজুদ্দিন শেখ, শফি গাজী, আসমত গাজী, এলাহী সানা ও মনি সানা। লেখক মীর আমীর আলী গল্লামারী বধ্যভূমিকে কসাইখানা বলে উল্লেখ করেছেন। রেডিও সেন্টারে অবস্থানরত পাকিস্তানী সেনারা আতঙ্কগ্রস্থ থাকত। সন্ধ্যার পর মুক্তিবাহিনী কখন চোরা গুপ্তা হামলা চালায়। গল্লমারী ব্রীজটি উড়িয়ে দেয়, এ নিয়ে প্রায় তারা চিন্তিত থাকত।
ডিসেম্বরের প্রথম দিকে যশোর সেনানিবাসের পতন হলে স্থানীয় বিভিন্ন ক্যাম্পের সেনা সদস্যরা মনোবল হারিয়ে ফেলে। মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলের আক্রমণের খবর তারা বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে রেডিও’র কর্মকর্তারা পেতে থাকে। যশোর সেনানিবাস থেকে সেনা, মিলিশিয়া ও বেলুচ পুলিশ খুলনা শহরে এসে অবস্থান নেয়। মিত্রবাহিনীর বিমান খুলনা শহরের বিভিন্ন স্থানের ওপর দিয়ে চক্র দেয়। ভারতীয় সেনা প্রধান জেনারেল মানেক শাহ পাকিস্তানী সেনাদের আত্মসমর্পনের আহ্বান জানিয়ে বিমান থেকে লিফলেট ছাড়ে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে সেনা ছাউনী ছেড়ে পাঞ্জাবীরা বাইরে সাধারণত বের হত না। বিমান হামলার পর সার্কিট হাউজ সদর দপ্তর ছেড়ে নিরাপত্তার জন্য স্থানীয় অধিনায়ক ব্রিগ্রেডিয়ার হায়াত খান নিউজপ্রিন্ট মিলস রেস্ট হাউজে আশ্রয় নেয়। এ দিকে ১৪ ডিসেম্বর মেজর জয়নাল আবেদীন (স্বাধীনতা পরবর্তী ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার) বেতার কেন্দ্র দখলের জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। পরবর্তীতে তারা পিছিয়ে যায়। ১৬ ডিসেম্বর রাতে রেডিও সেন্টার দখলের জন্য আর এক দফা হামলা করে। এই যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনী পরাজিত হয়। রাত ভর যুদ্ধে সারা শহর কাঁপতে থাকে।
রেডিও পাকিস্তান, খুলনা কেন্দ্রেই গড়ে উঠেছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। একাত্তরে নির্মম নির্যাতনের সাক্ষী এই স্থানটি। খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কে খুবি’র পরিত্যক্ত প্রবেশ দ্বারে ১৯৭১ গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট ২০১৬ সালের ৬ জানুয়ারি ম্মৃতিফলক স্থাপন করে। ইতিহাসবিদ প্রফেসর ডঃ মুনতাসীর মামুন ফলক উন্মোচন করেন।
রেডিও পাকিস্তান, খুলনা কেন্দ্রের মৃত্যু
১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর এ বেতার কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়। রেডিও পাকিস্তান, খুলনা কেন্দ্রের মৃত্যু হয় ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভোরে। পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে পাকিস্তানী বাহিনী বেতার কেন্দ্রের ১০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রান্সমিটার ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করে দেয়। স্টুডিও ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নষ্ট করে ফেলে। এ বেতার ভবন এলাকার সেনা ছাউনীর পাকিস্তানী সেনারা গুলি করতে করতে সার্কিট হাউজের দিকে এগোতে থাকে। ১৭ ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশ বেতার, খুলনা কেন্দ্র নামকরণ হয়। কিন্তু ট্রান্সমিটার ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় এ বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার শুরু করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রংপুর থেকে এক কিলোওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ট্রান্সমিটার এনে এখানে স্থাপনের মাধ্যমে এ কেন্দ্রের প্রচার পুনরায় শুরু হয়। তখন শ্রুতি পরিধি ছিল ১৬ কিলোমিটার। ১৯৭৪-৭৫ সালে পুনরায় ১০ কিলোওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ট্রান্সমিটার স্থাপনের কাজ শুরু হয়। ৭৬ সাল থেকে এ কেন্দ্রের শ্রুতি সীমা বেড়ে ৫৬ বর্গ কিলোমিটারে দাঁড়ায়। ১৯৭৯ সালের ১৩ জুলাই গল্লামারীর পরিবর্তে নুরনগরস্থ বর্তমান ভবনে অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়। ১৯৮১ সালের ২৮ এপ্রিল নওয়াপাড়ায় ১০০ কিলোওয়াট সম্পন্ন ট্রান্সমিটার স্থাপন করা হয়। ২০০৮ সালে তা সংস্কার হয়। গোটা বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ চলে আসে খুলনা কেন্দ্রের শ্রুতি সীমার আওতায়।