চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃদুর্নীতির দায়ে চট্টগ্রামের সাত পুলিশ কর্মকর্তা ফেঁসে যাচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধানে ক্ষমতার অপব্যবহারসহ আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তথ্য মিলেছে। এরই মধ্যে দুদক কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এক পুলিশ কর্মকর্তার সম্পদ ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে রয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের সহকারী পরিচালক (এএসপি) আবুল হাশেম, চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার সাবেক ওসি মো. রেফায়েত উল্লাহ, লোহাগাড়া থানার সাবেক ওসি মো. শাহাজাহান, সিএমপির পাঁচলাইশ থানার ওসি আবুল কাশেম ভূঁইয়া, সিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার এবিএম সাহাদাৎ হোসেন মজুমদার, সিএমপির ট্রাফিক বিভাগের সাবেক (বন্দর-টিআই প্রশাসন) আবুল কাশেম চৌধুরী, টেকনাফ মডেল থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। এসব পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ- তারা ক্রসফায়ারের ভয় দেখানোসহ নানাভাবে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এসব কর্মকর্তার দুর্নীতির চিত্র সংক্ষেপে তুলে ধরা হল-
আবুল হাশেম : ২০১৭ সালে দুদকের হটলাইনে (১০৬) আসা এক ফোনকলের সূত্র ধরে জেলা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের সহকারী পরিচালক (এএসপি) আবুল হাশেমের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। দুদক সূত্র জানায়, ২০১০-১১ থেকে ২০১৭-১৮ করবর্ষে হাশেম আয়কর নথিপত্রে বৈধ আয় দেখান ৬৭ লাখ ৬৫ হাজার ১৭৩ টাকা। কর পরিশোধসহ তার পারিবারিক ব্যয় ১৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রে মোট আয় থেকে খরচ বাদ দিলে দাঁড়ায় ৫৩ লাখ ৯০ হাজার ১৭৩ টাকা। এদিকে দুদকের অনুসন্ধানে তার বিরুদ্ধে মোট স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জনের খোঁজ পাওয়া যায় এক কোটি দুই লাখ ৩৭ হাজার ৪১৩ টাকার।
এখানে মোট আয়ের পরিমাণ বাদ দিলে ৪৮ লাখ ৪৭ হাজার ২৮৫ টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়। এ ছাড়া তার স্ত্রী তাহেরিনা বেগমের এক কোটি এক লাখ ছয় হাজার ৭৯৬ টাকা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের খোঁজ পায় দুদক। ওই টাকা থেকে মোট আয়ের পরিমাণ বাদ দিয়ে ১৯ লাখ ৫১ হাজার ৫৪৪ টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রাথমিকভাবে সত্যতা পায় দুদক।
সাহাদাৎ হোসেন মজুমদার : পুলিশ সার্জেন্ট পদে ১৯৮৫ সালে এবিএম সাহাদাৎ হোসেন যোগ দেন। ২০০৬ সালের ১৬ এপ্রিল ইন্সপেক্টর পদে তিনি পদোন্নতি পান। বর্তমানে তিনি সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসেবে সিএমপির মনসুরাবাদ ডাম্পিংয়ে কর্মরত। ফেনীর ফুলগাজী থানার আমজাদহাট এলাকার মোশারফ হোসেন মজুমদারের ছেলে সাহাদাৎ থাকেন নগরীর পাহাড়তলী থানার দক্ষিণ কাট্টলীর চুনা ফ্যাক্টরি মোড়ে।
সাহাদাৎ ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে দুই কোটি ২১ লাখ ১৩ হাজার ৯০০ টাকার স্থাবর সম্পদ ও ৪৪ লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টাকার অস্থাবর সম্পদ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে তার গ্রহণযোগ্য আয় এক কোটি ৭৭ লাখ ৫৩ হাজার ২৩৭ টাকা। বাকি এক কোটি দুই লাখ ১০ হাজার ৭১৬ টাকার আয়ের উৎস দেখাতে পারেননি সাহাদাৎ।
এ ছাড়া তার দ্বিতীয় ছেলে মো. আকিব জাভেদ মজুমদার লেখাপড়া করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ ছেলের লেখাপড়ার ব্যয়ভার সম্পর্কে দুদক কর্মকর্তাদের স্পষ্ট জবাব দিতে পারেননি তিনি। স্ত্রী ও সন্তানদের নামে কোনো সম্পদ আছে কি না, তার কোনো তথ্যও তিনি দেননি বলে জানিয়েছেন দুদক চট্টগ্রাম-১ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক নুরুল ইসলাম।
রেফায়েত উল্লাহ চৌধুরী : পটিয়া থানার সাবেক ওসি রেফায়েত উল্লাহ চৌধুরী স্ত্রীর করা নির্যাতন মামলায় সাময়িক বরখাস্ত হয়ে রাজশাহী রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত আছেন। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. হুমায়ুন কবীর জানান, প্রাথমিক অনুসন্ধানে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ মিলেছে রেফায়েত উল্লাহর বিরুদ্ধে। ফ্ল্যাট কেনা বাবদ ২০১৭ সালের ২৬ জানুয়ারি ছয়টি চেকের মাধ্যমে ৪১ লাখ ৫০ হাজার টাকা তিনি এক ব্যক্তিকে পরিশোধ করেন।
ওই বছরের ১৩ মার্চ নগরীর চান্দগাঁও এলাকায় এক হাজার ৪৫০ বর্গফুটের ওই ফ্ল্যাট নিবন্ধন করেন তার ভাই আফতাব উল্লাহ চৌধুরীর নামে। পরের বছরের ২২ জুলাই আফতাব তাদের আরেক ভাই হাফিজ উল্লাহ চৌধুরীর নামে হেবা দান করে দেন এ ফ্ল্যাট। এ ছাড়া ২০১৭ সালের মার্চে দুটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ৬৯ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ভাই আফতাব উল্লাহর নামে দেন রেফায়েত উল্লাহ।
দুদকের কর্মকর্তা আরও জানান, অবৈধভাবে আয় করা সম্পদ গোপন করতেই মূলত ভাইদের নামে ফ্ল্যাট কেনেন রেফায়েত। এ কারণে তার ফ্ল্যাটটি ক্রোক করার জন্য আদালতে আবেদন করা হলে আদালত ক্রোকের নির্দেশ দেন। তার বিরুদ্ধে মামলা অনুমোদনের জন্য ঢাকা সদর দফতরে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।
মো. শাহজাহান : লোহাগাড়া ও সন্দ্বীপ থানার সাবেক ওসি মো. শাহজাহান বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ জেলা টুরিস্ট পুলিশে কর্মরত। কুমিল্লার লালমাই থানার হাজাতখোলা বাজার কাতালিয়া গ্রামের সুলতান আহমদের ছেলে শাহজাহান। পরিবারসহ তিনি খুলশী থানার দামপাড়া ১৪ হাইলেভেল রোড লালখানবাজার এলাকায় বসবাস করেন। ১৯৯০ সালে চাকরি শুরুর পর থেকে শাহজাহানের নামে দুই কোটি ৬৪ লাখ ২৭ হাজার ৭০০ টাকা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৮৬ লাখ ৬৩ হাজার ৩৮৭ টাকা ঋণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
চাকরি নেয়ার পর থেকে তার বৈধভাবে আয় ৭৮ লাখ ৫২ হাজার ৯৭৬ টাকা। পারিবারিক ও অন্য সব খাতে তিনি ২৬ লাখ ১২ হাজার ৪৭৩ টাকা ব্যয় করেছেন। সব মিলিয়ে তার বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের পরিমাণ মিলেছে এক কোটি ২৫ লাখ ২৩ হাজার ৮১০ টাকা। এ ছাড়া তার স্ত্রী ফেরদৌসী আক্তারের নামে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ তিন কোটি ১৭ লাখ ৭৫ হাজার ৬১৭ টাকা। এর মধ্যে বৈধ আয় ৪৭ লাখ ৮৩ হাজার ৬৫৫ টাকা। পারিবারিক ও অন্যান্য খাতে তিনি ১৩ লাখ ২৮ হাজার ৭৩০ টাকা ব্যয় করেছেন। সব মিলিয়ে তার বিরুদ্ধে দুই কোটি ৮৩ লাখ দুই হাজার ৬৯২ টাকা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুদক।
দুদক চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক মো. হুমায়ুন কবীর জানান, ওসি মো. শাহজাহান ও তার স্ত্রী ফেরদৌসী আক্তারের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে চার কোটি ৮২ লাখ ছয় হাজার ৫০২ টাকা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে আরও স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ থাকতে পারে বলে মনে হচ্ছে। এসব বিষয়ে তদন্ত শেষে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।
টিআই আবুল কাশেম চৌধুরী : চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের বন্দর জোনের সাবেক টিআই-প্রশাসন আবুল কাশেম। এক বছর ধরে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে দুদক। ফেনীর পরশুরাম থানার বাঘমারা গ্রামের মোখলেছুর রহমান চৌধুরীর ছেলে কাশেম। ১৯৮৫ সালে পুলিশ সার্জেন্ট পদে কাশেম যোগ দেন। কাশেম ও তার স্ত্রী ফাতিমা বেগমের বিরুদ্ধে ৫৫ লাখ ২২ হাজার ৪৬৩ টাকাসহ নামে-বেনামে স্থাবর সম্পত্তি থাকার খোঁজ পেয়েছে দুদক।
এ প্রসঙ্গে দুদক চট্টগ্রাম-১ কার্যালয়ের উপ-পরিচালক লুৎফর কবীর চন্দন জানান, তাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তথ্য মিলেছে। প্রদীপ কুমার দাশ : টেকনাফ মডেল থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ নগরীর পাঁচলাইশ ও বায়েজিদ বোস্তামী থানায়ও ওসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১৫ সালে বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি থাকাকালে সুপার রিফাইনারি লিমিটেডের চেয়ারম্যান শিল্পপতি সেলিম আহাম্মদের বিরুদ্ধে তেল পাচারের মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগে প্রদীপ সাময়িক বরখাস্ত হয়েছিলেন। তার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে দুদক।
আবুল কাশেম ভূঁইয়া : ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ৩০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগে পাঁচলাইশ থানার ওসি কাশেম ভূঁইয়াসহ ছয় পুলিশ সদস্য ও তিন সোর্সের বিরুদ্ধে মামলা করেন নগরীর পতেঙ্গা এলাকার বাসিন্দা নুরুল আবছার। মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছেন দুদক। চলতি বছরের ২৫ মার্চ আদালতে করা মামলায় বাকি আসামিরা হলেন : পতেঙ্গা থানার এসআই প্রণয় প্রকাশ, আবদুল মোমিন, এএসআই তরুণ কান্তি শর্মা, কামরুজ্জামান ও মিহির কান্তি। এ ছাড়া ইলিয়াছ, জসিম ও নুরুল হুদা নামে তিন সোর্সকে আসামি করা হয়েছে। মামলার এজাহারে নুরুল আবছার বলেন, ২০১৮ সালের ১ জুন বিকালে নগরীর পতেঙ্গা কাঠগড় এলাকা থেকে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা তাকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ৩০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন।
পরদিন তাকে ইয়াবা ব্যবসায়ী অপবাদ দিয়ে আটক রাখা হয়। একপর্যায়ে তিনি ১৫ লাখ টাকা পুলিশের হাতে তুলে দেন। অবশিষ্ট ১৫ লাখ টাকা না দেয়ায় তাকে বিদেশি মদ উদ্ধারের একটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে চালান দেয়া হয়। জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে নুরুল আবছার পাঁচলাইশ থানার ওসিসহ নয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপসহকারী পরিচালক নুরুল ইসলাম জানান, মামলাটি এখনও তদন্তাধীন। বাদীর কাছ থেকে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে।