চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃজাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সার্ভারে ঢুকে কনটেইনার খালাসের ঘটনায় জড়িত সিএন্ডএফ এজেন্টদের অর্থের বিনিময়ে অবৈধ সুবিধা দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর ও মংলা বন্দর কাস্টমসের ৩২ কর্মকর্তা। পণ্য খালাসের বিভিন্ন স্তরের এসব কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ মদদ থাকায় অভিনব কায়দায় পণ্য খালাস নেয়া সম্ভব হয়েছে। এ ঘটনায় একদিকে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে, অন্যদিকে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।
সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। সম্প্রতি প্রতিবেদনটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে (পিএমও) পাঠানো হয়। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে এনবিআরকে নির্দেশ দিয়েছে পিএমও। সার্ভার জালিয়াতির ঘটনায় এনবিআর গঠিত তদন্ত কমিটির সুষ্ঠু তদন্ত নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
এতে বলা হয়েছে, সার্ভার জালিয়াতির মাধ্যমে পণ্য পাচারের ঘটনায় জড়িত কাস্টমসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এবং তদন্তে নিয়োজিত কাস্টমস কর্মকর্তারা একে অন্যের পরিচিত। কাজেই এই তদন্ত কমিটি দিয়ে সঠিকভাবে তদন্ত হওয়ার বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। এছাড়া জালিয়াতিতে জড়িত কর্মকর্তারা এখনও কাস্টম হাউসে কর্মরত। ফলে সুষ্ঠুভাবে তদন্ত কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা আছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ঠদের ধারনা দুটি আইডি শুধু চট্টগ্রামে নয়, ঢাকার ছয়-সাতটি স্থান থেকেও লগইন করা হয়েছে। এতে ধারণা করা হচ্ছে, শুধু চট্টগ্রাম,মংলা বন্দরই নয়, এই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে কমলাপুর আইসিডি ও অন্যান্য বন্দর থেকেও পণ্য ছাড় করানো হয়েছে।
কর্মকর্তা না থাকার পরও এত দিন কী করে আইডি সচল থাকে, অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমের সিস্টেম ম্যানেজার সফিকুর রহমানের কাছে প্রশ্ন করা হলে এর কোনো জবাব মেলেনি। এই সফটওয়্যারে প্রতিবছর নিরীক্ষা হয় কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ নিয়ে তদন্ত চলছে, কোনো কথা বলা যাবে না।
জালিয়াতির ঘটনা তদন্ত দ্রুত শেষ করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে কাস্টমস কর্মকর্তাদের বদলিসহ পাঁচ দফা সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে। অন্য সুপারিশগুলো হচ্ছে- ২২টি চালান ছাড়ের ঘটনায় জড়িত সিএন্ডএফ এজেন্টদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা, অবসরপ্রাপ্ত বা অন্য স্থানে বদলি হওয়া কর্মকর্তাদের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডের ইউজার আইডি স্থায়ীভাবে বন্ধ করা, চট্টগ্রাম কাস্টমসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী সম্পদের হিসাব নেয়া এবং প্রয়োজনে দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে সম্পদের বিষয়ে তদন্ত করা।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘অসাধু আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্টদের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে চট্টগ্রাম,মংলা কাস্টমসের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা আমদানি পণ্যের যথাযথ শুল্ক আদায় না করে বন্দর থেকে কনটেইনার খালাসে সহযোগিতা করছে। সুচতুর অসাধু আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্ট মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে কনটেইনারে পণ্য নিয়ে এসে কায়িক পরীক্ষা না করে উচ্চ শুল্ক হার ও দেশের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পণ্য বন্দর থেকে খালাস করে নিয়ে যাচ্ছে। এতে একদিকে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং অন্যদিকে ক্ষতিকর দ্রব্য প্রবেশের কারণে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।
২২টি চালানের কনটেইনার নম্বর, ঘোষিত পণ্য, বিল অব অ্যান্ট্রি, আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্টদের নাম উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব চালানে ঘোষণাবহির্ভূত, উচ্চ শুল্ক হারযুক্ত, আমদানিনীতি আদেশপরিপন্থী, জাতীয় ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য হুমকিযুক্ত পণ্য থাকায় চালানগুলো খালাস না করার অনুরোধ থাকার পরও অবৈধ অর্থের বিনিময়ে দুর্নীতিগ্রস্ত বন্দর ও কাস্টমস কর্মকর্তারা কনটেইনার খালাসে সহযোগিতা করেছেন।
যেসব কর্মকর্তা জড়িত : গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, চালানগুলো খালাসে সহযোগিতা করেছেন এনবিআরের বিভিন্ন পর্যায়ের ১৫ জন কর্মকর্তা। তারা হলেন- সিস্টেম অ্যানালিস্ট গোলাম সারোয়ার, চট্টগ্রাম কাস্টমসে তৎকালীন এআইআর শাখার উপকমিশনার শাহিনুর রহমান পাভেল, তৎকালীন এআইআর শাখায় কর্মরত রাজস্ব কর্মকর্তা সুলতান আহমেদ, রাজস্ব কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম, নূরে আলম, হাবিবুল ইসলাম, মনোয়ার হোসেন চৌধুরী, সাইফুল ইসলাম, মেহেরাব আলী, এসএম মোশারফ হোসেন, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা এএইচএম নজরুল ইসলাম, শাহরিয়ার হোসেন, মোহাম্মদ নূর-ই আলম, সাইফুন্নাহার জনি, মির্জা সাইদ হাসান ফরমান।
এর মধ্যে শাহিনুর রহমান পাভেল ও সুলতান আহমেদকে অবৈধ অর্থের বিনিময়ে পণ্য খালাসে অন্যদেরও সহযোগিতা করার জন্য সরাসরি অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাদের ব্যাপারে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২২টি কনটেইনার ছাড়াও বিভিন্ন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও সিএন্ডএফ এজেন্টের কাছ থেকে তারা দু’জন অবৈধ অর্থের বিনিময়ে প্রচুর পরিমাণে আমদানিকৃত পণ্য খালাসে সহযোগিতা করেছে।
এছাড়া বন্দরের পরিবহন বিভাগের ১৭ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এসব ঘটনায় জড়িত ছিলেন। তারা হলেন- উচ্চমান বহিঃসহকারী শাহাবুদ্দিন, সানোয়ার মিয়া, মফিজুর রহমান হেলেন, শেখ বাচ্চু মিয়া, মো. ইলিয়াছ, হামিদুর রহমান, নাজিম উদ্দিন, কবির আহম্মেদ, শ্যামল কৃষ্ণ ভৌমিক, সালাউদ্দিন পায়েল, মোরশেদুল হাসান, ওমর ফারুক, অর্পণ কান্তি দেবনাথ, মাইনুদ্দিন, অনিক, আবদুল গনি, মোস্তাফিজুর রহমান।
প্রসঙ্গত, অন্য অফিসে বদলি হওয়ার পরও এক সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার ‘ইউজার আইডি’ ব্যবহার করে চট্টগ্রাম কাস্টমসের ‘অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে’ ৩ হাজার ৬৮১ বার লগইন করা হয়েছে। অপরদিকে অবসরে যাওয়া আরেক রাজস্ব কর্মকর্তার আইডি ব্যবহার করে ২০১৭ সালের ২১ নভেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১১৬ বার সিস্টেমে লগইন করা হয়েছে।
আমদানিকৃত কিছু কনটেইনার খালাসে শুল্ক গোয়েন্দার আপত্তি থাকা সত্ত্বেও এ দুই আইডিতে লগইন করে চালান খালাস করা হয়। এ ঘটনায় দুই সিএন্ডএফ এজেন্টের মালিকের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা ও তাকে আটক করে পুলিশে দেয়া হয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর থেকে এনবিআরে এসব তথ্য জানানো হয়।
এ ঘটনায় প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করতে এনবিআর থেকে ৪টি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তৎকালীন কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট (আপিল) কমিশনারেটের কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলমের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়, যিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া শুল্ক গোয়েন্দা অতিরিক্ত মহাপরিচালক আবদুল হাকিম, এনবিআরের সিআইসি সেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক খালেদ মো. আবু হোসেন এবং চট্টগ্রাম কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার এইচএম শরিফুল হাসানের নেতৃত্বে আরও ৩টি কমিটি করা হয়।
তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে শুক্রবার রাতে কমিটির প্রধানদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তারা কেউ কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে একটি তদন্ত কমিটিপ্রধান নাম প্রকাশ না করার শর্তে শনিবার সন্ধ্যায় টেলিফোনে বলেন, তদন্তে কাস্টমস কর্মকর্তাদের যোগসাজশ পাওয়া যায়নি। তবে চট্টগ্রাম কাস্টমসের গাফিলতি পাওয়া গেছে। কারণ সিআইসি ও শুল্ক গোয়েন্দা থেকে অনুরোধ করার পরও চালানগুলো কাস্টমস অ্যাসেসমেন্ট করেনি। অ্যাসেসমেন্ট করা হলে অন্তত বোঝা যেত, এর ভেতরে কী আছে? সে অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া যেত। জানা গেছে, এনবিআরের পাশাপাশি পুলিশের সিআইডিও সার্ভার হ্যাকের ঘটনা তদন্ত করছে।