যুগান্তরের-বিশেষ করে ‘তৃতীয় মতের’ পাঠকদের খ্রিস্টীয় নববর্ষের আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই। কারোনাজর্জরিত বর্তমান বিশ্বে বেঁচে থাকাই যখন দুরূহ, তখন প্রার্থনা করি আপনারা যে যেখানে আছেন তারা ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং করোনার মৃত্যু ছোবল থেকে মুক্ত থাকুন। ১ জানুয়ারি অর্থাৎ নতুন বছরের প্রথম দিনটিতেই ঢাকা থেকে যে সংবাদ পেয়েছি, তাতে যেন সংকেত পাচ্ছি, এ বছরটি যতই ভালো হোক আমাদের অশান্তি ঘোচেনি। ঠাকুরগাঁও জেলার (বৃহত্তর রংপুর) পীরগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে আবার আঘাত হানা হয়েছে। এবার কোনো মাদ্রাসাছাত্র নয়, ভাস্কর্যের ক্ষতি করার দায়ে ধরা পড়েছে নূর আলম নামে ৪২ বছরের যুবক। তাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। সে কোনো মৌলবাদী দলের সঙ্গে যুক্ত কিনা তা এখনো জানা যায়নি।
কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার চেষ্টা করেছিল কতিপয় মাদ্রাসাছাত্র। কিন্তু একই জেলায় বাঘা যতীনের ভাস্কর্য কোনো মৌলবাদী দলের লোকেরা ভাঙেনি। ভেঙেছে যুবলীগের স্থানীয় কতিপয় নেতা। তাদের উদ্দেশ্যটিও ছিল আলাদা। পীরগঞ্জ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী প্রয়াত ওয়াজেদ মিয়ার এলাকা। এ এলাকায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার চেষ্টার মূলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের সঙ্গে ব্যক্তিগত পাগলামিও থাকতে পারে। বাঘা যতীনের ভাস্কর্য ভাঙার চেষ্টা থেকেই মনে হয়, ভাস্কর্য ভাঙা হলেই কেবল মৌলবাদী ও মাদ্রাসাছাত্রদের ওপর দোষ চাপিয়ে লাভ নেই। সেখানে অন্যদের রাজনৈতিক অভিসন্ধিও থাকতে পারে।
ঠাকুরগাঁও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুলেরও এলাকা বলে পরিচিত। ৩০ ডিসেম্বর বিএনপি সারা দেশে গণতন্ত্র হত্যা দিবস পালন করেছে। এ দিবস পালনের সঙ্গে পীরগঞ্জে জাতির পিতার ভাস্কর্যের ওপর হামলার কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, তা পুলিশেরই তদন্ত করে বের করতে হবে। আবার এমনও হতে পারে, ঘটনাটি একজন মাত্র মানুষের নাম কেনার জন্য ব্যক্তিগত পাগলামি। সেটি যাই হোক, পীরগঞ্জের মতো এলাকায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের ওপর হামলার প্রকৃত কারণ পুলিশকে খুঁজে বের করতে হবে।
কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার পরই সরকারি ঘোষণায় জানা গিয়েছিল, দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত জাতির পিতার ভাস্কর্য রক্ষার জন্য পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা থাকবে। ঘোষণাটি শুনে আমি আনন্দবোধ করিনি। বঙ্গবন্ধু তার জীবনের একটি বড় অংশ কাটিয়েছেন পুলিশের হাতে বন্দি অবস্থায়- অর্থাৎ পুলিশ পাহারায়। এখন তার অক্লান্ত সাধনায় প্রতিষ্ঠিত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে তারই দলের শাসনামলে তার ভাস্কর্যকেও যদি পুলিশ পাহারায় কাটাতে হয়, তাহলে তার চেয়ে অগৌরবের বিষয় আর কিছু নেই। এজন্য মৌলবাদীরা অবশ্যই বহুলাংশে দায়ী। কিন্তু আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগ সরকারও এজন্য কম দায়ী নয়।
আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর সাধারণ অনুসারী, তাদের বেশিরভাগই আশা করেছিলাম ঢাকার যে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে জাতির কাছে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন, সেটিকে আমেরিকার গেটিসবার্গের মতো স্বাধীনতার উদ্যান ঘোষণা করে, আব্রাহাম লিঙ্কনের মতো বঙ্গবন্ধুর বিশাল ভাস্কর্য স্থাপন করে ভাস্কর্যের পাদদেশে ৭ মার্চের ভাষণ বাংলা ও ইংরেজিতে খোদাই করে লেখা থাকবে। এ ভাস্কর্যের চারপাশ ঘিরে থাকবে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত গ্রন্থাগার, গবেষণাগার, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের স্থান। বঙ্গবন্ধুর আরেকটি ভাস্কর্য থাকবে তিনি যেখানে চির বিশ্রাম নিয়েছেন তার সেই জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায়। প্রত্যহ শত শত মানুষ যেখানে জাতির পিতাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে যায়।
সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানকে গেটিসবার্গের কায়দায় স্বাধীনতা পার্ক হিসেবে তৈরি না করে এবং সেখানে বঙ্গবন্ধুর বিশাল ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠা না করে দেশের জেলায় জেলায় সেই ভাস্কর্য স্থাপন আমলাদের স্তাবকতাপ্রসূত পরামর্শের ফল বলে আমি ধারণা করি। রমনা রেসকোর্সের সঙ্গে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর যে স্মৃতি জড়িত, ইতিহাস থেকে তাকে মুছে ফেলার জন্য স্বাধীনতার তথাকথিত ঘোষক জেনারেল জিয়াউর রহমান এ ময়দানে শিশু উদ্যান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। সে চক্রান্ত সফল হয়নি। এ ময়দানে স্বাধীনতার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে অনেক কিছুই হাসিনা সরকার করেছে, কিন্তু গেটিসবার্গের মতো রমনার ময়দান স্বাধীনতার ইতিহাসের স্মারক পার্ক হয়ে ওঠেনি।
বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধুর প্রধান ভাস্কর্য কেন পুরান ঢাকার ধোলাইখাল এলাকায় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার কারণ আমি জানি না। হয়তো সিদ্ধান্তটি সুচিন্তিত ও যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু আমার বিশ্বাস, জাতির পিতার একটি কেন্দ্রীয় ভাস্কর্য স্থাপনের উপযুক্ত স্থান সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান। এটিকে গেটিসবার্গের কায়দায় মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিরক্ষার উদ্যানে পরিণত করা উচিত। এটিকে এমনভাবে ইতিহাসের
উন্মুক্ত জাদুঘরে পরিণত করা উচিত, যা পরিদর্শনে বিদেশের অসংখ্য পর্যটক তো আসবেই, সেই সঙ্গে আমাদের তরুণ প্রজন্মও স্বাধীনতার দৃশ্যমান ইতিহাস থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে গর্বিত হতে পারবে।
ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর একটি কেন্দ্রীয় ভাস্কর্য এবং টুঙ্গিপাড়ায় বর্তমান ছোটো ভাস্কর্যটির বদলে একটি বড় ভাস্কর্য ছাড়া জেলায় জেলায় এই ভাস্কর্য স্থাপন উচিত হয়নি। এতে বঙ্গবন্ধুর মর্যাদাহানি হয়েছে। তাকে ছোটো করা হয়েছে এবং দুষ্কৃতকারীদের সেই ভাস্কর্যের অবমাননা করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। আমার ধারণা-জেলায়-উপজেলায় এভাবে বঙ্গবন্ধুর বহু ভাস্কর্য স্থাপন স্তাবকতাপ্রিয় আমলাদের অতিভক্তি প্রদর্শনের ফল। এভাবে স্থানে-অস্থানে জাতির পিতার ভাস্কর্য স্থাপন এবং তার দীর্ঘকালীন রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা না রাখা জাতির পিতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন নয়। বরং তাকে যাতে দুর্বৃত্তরা অসম্মান প্রদর্শন করতে পারে, তার সুযোগ খুলে দেওয়া।
দুটি উদাহরণ। লন্ডন ভাস্কর্যের শহর। নিজেদের রাজারানী, পণ্ডিত, মনীষীদের ভাস্কর্য তো আছেই, সেই সঙ্গে বিদেশের গান্ধী, ম্যান্ডেলা প্রমুখের ভাস্কর্র্যও আছে। সেন্ট্রাল লন্ডনে একটি পার্কের মধ্যে গান্ধীজির দণ্ডায়মান মূর্তি আছে। এককালে দেশি-বিদেশি গান্ধীভক্তরা এ পার্কে গান্ধীর স্ট্যাচুতে শ্রদ্ধা জানাতেন। এখন এ পার্ক আবর্জনায় ভর্তি এবং গান্ধী মূর্তি অবহেলিত। তার মাথায় কাক বসে এবং মলমূত্র ত্যাগ করে। একই অবস্থা দক্ষিণপূর্ব লন্ডনে প্রয়াত সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের মূর্তির। মাথায় কাক ও অন্যান্য পশুপাখির মলমূত্র। সর্বাঙ্গে আবর্জনা, বোঝাই যায় দীর্ঘকাল এ ভাস্কর্যের কোনো রক্ষণাবেক্ষণ নেই।
এখন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের কথায় আসি। যে আমলারা এখন ভক্তিতে গদগদ হয়ে জেলা-উপজেলায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণে অতি উৎসাহ দেখাচ্ছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে এ ভাস্কর্যের রক্ষণাবেক্ষণ তো হবে না, ভাস্কর্যের মাথায় কাক ও পশুপাখি বসাও বন্ধ করার ব্যবস্থা হবে না। কলকাতায় শ্যামবাজারের মোড়ে অশ্বারোহী নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ভাস্কর্যের দুরবস্থা যারা দেখেছেন, তাদের কাছে জেলা-উপজেলায় জাতির পিতার ভাস্কর্য হরেদরে তৈরি করা হলে ভবিষ্যতে তার অবস্থা কী হবে সে সম্পর্কে সতর্ক করছি মাত্র।
আর জাতির পিতার ভাস্কর্য কেউ ভাঙতে চাইলে পুলিশ অবশ্যই অপরাধীকে ধরে বিচারে সোপর্দ করবে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করা উচিত হবে না। ভাস্কর্য নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি এ ভাস্কর্যের অবমাননার ব্যাপারে আরও উৎসাহিত হবে। আর এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা না হলে শত্রুপক্ষ নিরুৎসাহিত হবে। লন্ডনে যখনই কোনো টোরি সরকারবিরোধী বড় বড় শোভাযাত্রা হয়, তখন ওয়েস্ট মিনস্টারে স্থাপিত চার্চিলের বিশাল ভাস্কর্যটিকে সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ হিসেবে ভাঙার চেষ্টা হয়। মূর্তিটিকে রক্ষার জন্য শুধু মোটা তেরপাল দিয়ে সেটিকে ঢেকে রাখা হয়। বিক্ষোভ ও শোভাযাত্রা শেষ হলেই তেরপাল আবার সরিয়ে নেওয়া হয়। তবে পুলিশ ভাস্কর্য ভাঙায় অপরাধীকে ধরতে পারলে এজন্য বিচারে তার কঠোর শাস্তি হয়। অপরাধীদের অভিভাবকদের সঙ্গে সরকার এ ভাস্কর্য ভাঙা নিয়ে কোনো রাজনৈতিক আগাম বৈঠকে বসে না।
ব্রিটিশ আইনে এ ভাস্কর্য ভাঙা অপরাধ। যে কোনো অজুহাতেই এ ভাস্কর্য ভাঙতে গেলে অপরাধীকে কঠোর সাজা পেতে হয়। বাংলাদেশেও সরকারের উচিত, ভাস্কর্য সম্পর্কে মৌলবাদীদের সঙ্গে আপসরফা দ্বারা সমস্যার সাময়িক সমাধানের বদলে কঠোর আইন করা এবং তা কার্যকর করা। তবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হইচই করা নয়। জেলায় জেলায় ভাস্কর্য স্থাপন না করে ঢাকার সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির পিতার ঊর্ধ্বে অঙ্গুলি উত্তোলনকারী একটি বিশাল কেন্দ্রীয় ভাস্কর্য স্থাপন এবং তার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা আবশ্যক।