শেখ মাহতাব হোসেন :: খুলনার ডুমুরিয়ায় চালের চড়া বাজার দরে নিন্ম আয়ের মানুষেরা চরম বিপাকে পড়েছেন। মহামারী করোনায় চলমান লকডাউনে কর্মহীন অথবা উপার্জন কমে যাওয়া মানুষদের জন্য এ দুর্ভোগ মাত্রা ছাড়িয়েছে। খুচরা পর্যায়ে ৪৬ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরের নিচে কোনো চাল নেই।
নগরীতে যে চাল কেজি প্রতি ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, মফস্বলের মুদি দোকানগুলোতে তা ৫২ এবং প্রত্যন্ত গ্রামের বাজারে ৫৪-৫৫ টাকা কেজি দামে বিক্রি হচ্ছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরা পর্যায়ে চালের দাম কেজি প্রতি গড়ে তিন থেকে ৫ টাকা বেড়েছে। পাইকারীতে বস্তা প্রতি ৫০ থেকে ১শ’ টাকা দাম বেড়েছে। এ মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে সাত থেকে ২৫ দিনের ব্যবধানে। আবার কোনো চালের দাম গত দু’ মাসের ব্যবধানে প্রতি বস্তায় ৫শ’২৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। খুলনায় চালের বাজারে কেন এ অস্থিরতা? এ প্রশ্নের উত্তরে চাল কল মালিক, পাইকারী আড়ৎদার ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে ভিন্ন-ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া গেছে।
পাইকারী আড়ৎদারদের সূত্রে জানা গেছে, বৈশাখ মাস থেকে বোরো ধানের চাল বাজারে উঠতে শুরু করে। জৈষ্ঠ্য মাসে ভারত হতে চাল আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। রাইস মিল মালিকরা তখন থেকেই বস্তা প্রতি ২৫-৫০ টাকা করে দাম বাড়ানো শুরু করে। এভাবে বাড়াতে-বাড়াতে তারা চালের দর বর্তমান পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। তারা সিন্ডিকেট করে এ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। বাজারে তখনও চালের কোনো সংকট ছিল না, এখনও নেই।
খুলনার চালকল মালিকদের মধ্যকার একটি সূত্র জানান, বৃহৎ পুঁজির অধিকারী কয়েকজন অটোমেটিক রাইসমিলের মালিক বোরো মৌসুমের শুরুতেই সাড়ে ৮শ’/৯শ’ টাকা মন দরে পর্যাপ্ত ধান কিনে মজুত করেছেন। এখন সেই ধান এক হাজার ৫০ টাকা মন। যশোর ও কুষ্টিয়াসহ উত্তরবঙ্গের বেশ কয়েকটি অটোমেটিক রাইস মিলের মালিক চালের বাজার দর উঠা-নামা নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা সুযোগমত চালের দাম বাড়িয়ে থাকেন। অন্যদিকে, নগরীর বড় বাজারে পাঁচ-সাত জন আড়ৎদার আছেন, যাদের গুদামেও পর্যাপ্ত চাল মজুত করার সক্ষমতা আছে। রাইস মিল মালিকেরা যখন দাম বাড়িয়ে দেন, তখন তারাও আগের কম দামে কেনা চাল বেশি দামে বিক্রি শুরু করেন।
ভারত থেকে চাল আমদানি বন্ধের সময় ধান-চালের কোনো সংকট না থাকার পরও দাম বাড়তে থাকার যৌক্তিকতা কি? এ প্রশ্নের জবাবে চাল কল মালিক সমিতির এক নেতা বলেন, চাল আমদানি বন্ধের খবরে ফড়িয়ারাও ধানের দাম বাড়য়ে দিয়েছিলেন।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, খুলনার নয় উপজেলাসহ মেট্রো অঞ্চলে ২০৫টি লাইসেন্সধারী চালকল রয়েছে। এরমধ্যে অটোমেটিক রাইস মিল ১৮ টি, বাকীগুলো চাতালের চাল কল। যদিও পাইকারী বিক্রেতারা বলছেন, খুলনার চালের বাজারের চাহিদার বৃহৎ অংশের যোগান আসে যশোর ,সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, নাটোরের গুরুদাশপুর, সেরপুর, দিনাজপুর, নওগা, পাবনার ঈশ্বরর্দিসহ উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলার রাইস মিল থেকে।
নগরীর বড় বাজারের পাইকারী আড়ৎদারদের সূত্রে জানা গেছে, গত দুই মাস আগে ইরি আতপ ৫০ কেজি ওজনের বস্তা ১২শ’ ৫০ টাকা ছিল। এখন দাম বেড়ে ১৭শ’ ৫০ টাকা হয়েছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে একই ওজনের সেদ্ধ মোটা চাল প্রতি বস্তায় ৫০ টাকা বেড়ে দু’ হাজার ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বালাম-২৮ কেজি প্রতি দু’ টাকা বেড়ে ২৫ কেজির প্রতি বস্তা ১২শ’ ৫০ টাকা হয়েছে। বিভিন্ন ব্রান্ডের মিনিকেট চাল কেজিতে এক টাকা বেড়ে ১৪শ’ ৮০ থেকে ১৫শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভাল মানের আতপ গত ১৫ দিনে কেজিতে চার টাকা দাম বেড়ে ২৫ কেজি ওজনের বস্তা ১৬শ’ টাকা হয়েছে।
বড় বাজারের একজন খুচরা ব্যবসায়ী জানান, চলের দাম প্রতি কেজিতে গড়ে তিন থেকে পাঁচ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। সেদ্ধ মোটা ৪৬-৫০, বালাম ৫০-৫৫, মিনিকেট ৬০-৬৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
পাইকারী ব্যবসায়ী ও রাইস মিল মালিকদের সূত্রে জানা গেছে, খুচরা বিক্রেতা ও মুদি দোকানীরা প্রতি কেজি চালে চার-পাঁচ, এমনকি ছয় টাকাও লাভ করার চেষ্টা করেন। যে কারণে পাইকারী ও খুচরা পর্যায়ে দামের তুলনামূলক তারতম্য বেশি। তবে, খুচরা বিক্রেতার বলছেন- আড়ৎ থেকে চাল কেনার পর পরিবহণ খরচসহ তাদেরকে ওইরকম লাভেই বিক্রি করতে হচ্ছে।
সূত্রমতে, নগরীর বড় বাজারে ছোট-বড় মিলিয়ে শ’ খানেক পাইকারী চালের আড়ৎ রয়েছে। ডুমুরিয়ি ও ফুলতলায় চালের পাইকারী আড়তের সংখ্যা শাতাধিক। এসব আড়ত থেকে নগরী ও উপজেলা সমূহের খুচরা বিক্রেতারা চাল কেনেন।
গত ২৩ জুলাই থেকে চলমান লকডাউনে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, দর্জি শ্রমিক, পরিবহণ শ্রমিকসহ নানা শ্রেণী পেশার খেটে খাওয়া মানুষের উপার্যন থমকে আছে। রিক্সা চালক, ভ্যান চালক, ফেরিওয়ায়লাসহ যারা করোনা সংক্রমনের ঝুঁকি নিয়ে বের হচ্ছেন, তাদের ইনকামও আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। চালের বাড়তি দাম তাদেরকে ভীষন পীড়া দিচ্ছে। কয়েকজন খেটে খাওয়া মানুষের সাথে কথা বলে এ দুর্ভোগের কথা জানা গেছে। যদিও করোনায় কর্মহীনদের জন্য সরকারিভাবে খাদ্য সহায়তা অব্যাহত আছে।
খুলনা জেলা চালকল মালিক সমিতির সভাপতি মোহাঃ মুস্তফা কামাল বলেন, যে চালের কেজি প্রতি মিল রেট ৪১ টাকা অথবা ৪১ টাকা ৫০ পয়সা, সেই চাল যদি খুচরা পর্যায়ে ৪৮/৫০ টাকায় বিক্রি হয়, তার জন্য তো চাল কল মালিকেরা দায়ী নন। খুলনার মিল মালিকদের মধ্যে কোনো সি-িকেট নেই বলে দাবি করে তিনি বলেন, যে যেমন দামে পারেন ধান কেনেন, যে যেমন দামে পারে চাল বিক্রি করেন। মিলগুলো সচল রাখার জন্য যে পরিমাণ ধান স্টকে রাখা প্রয়োজন ততটুকুই আছে বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।