শেখ মাহতাব হোসেন:: খুলনা যশোর জেলায় পাঁচটি উপজেলার দুই লক্ষ একর জমিতে বোরো ধান চাষ অনিশ্চিত। আড়াই লাখ মানুষ বারো কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে , চলতি মৌসুমে বীজতলা করতে না পেরে কৃষক দিশেহারা, পনি নিষ্কাশন পথ খর্নিয়া নদী ও শোল মারী নদী ভরাট হওয়ায় কৈয়া নদী প্রায় ত্রিশ বছর পর আবারও বিল শিংগা,ডাকাতিয়ায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা দেয়ার আশংকা করা হচ্ছে। গেলো অক্টোররের শেষ বর্ষায় তলিয়ে যাওয়া বিল ডাকাতিয়া ও সংলগ্ন এলাকার কয়েক হাজার চিংড়ি ঘের ভেসে যাওয়ায় চাষিরা মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির শিকার ও পরিবার নিয়ে কি খেয়ে বাঁচবেন আগামী একটি বছর সে চিন্তায় ঘুম হচ্ছে না তাদের। জলাবদ্ধতার মূল কারণ বটিয়াঘাটা উপজেলার শোলমারী নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় কৈয়া নদী দিয়ে একমাত্র পানি নিষ্কাশন পথ বন্ধ। ফলে এবার জলাবদ্ধতা রয়ে যাওয়া এবং খুলনা-যশোর জেলার ডুমুরিয়া-ফুলতলা- অভয়নগর-কেশবপুর- মনিরামপুর উপজেলার ২লক্ষাধিক একর আয়াতনের দেশখ্যাত বিল ডাকাতিয়া। ১৯৮৮ সালের পর থেকে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
১৯৯০ সালের দিকে পরিস্থিতি ভয়াবহ হলে তখন আওয়ামী লীগ নেতা গাজী আবদুল হাদী ও কৃষক সংগ্রাম সমিতি নেতা সুলতান মল্লিকের যৌথ- নেতৃত্বে ভুক্তভোগী কৃষক ও অসহায় মানুষের ব্যাপক আন্দোলন-সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ জনতা দৌলতপর- চুকনগর সড়কের শলুয়া গেটের পাশে আমভিটায় সন্ধ্যার খাল কেটে দিলে বিল থেকে অনেক পানি বেরিয়ে যায়। বিলডাকাতিয়ার জলাবদ্ধতা নিরসনে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে কেজেডিআরপি প্রকল্প হাতে নিয়ে শলুয়া স্লইচস গেটের মুখ থেকে কৈয়া পর্যন্ত নদী ও কয়েকটি খাল খনন, কৈয়া নদীর নির্গমন শোলমারী নদীর তীরে বাঁধ দিয়ে ১০ ভেন্টের ব্লুইস গেট তৈরি করা হয়।
বিলডাকাতিয়ার সাড়াভিটা গ্রামের চিংড়ি ঘের। এই ঘেরের পানি এখন এতো বেশি যে এক মাসের মধ্যে পানি না নামলে বোরো ধান চাষ সম্ভব হবে না। ৬০ মণ ধান উৎপাদিত হয়। প্রতিমণ ধানের মূল্য এক হাজার ধরা হলে দুই লাখ একর জমিতে বোরো ধানের উৎপাদন দাঁড়ায় ৪লাখ ৪৭ হাজার টন। যার বাজার মূল্য ১২শ কোটি টাকা। এবার বেরো আবাদ না হলে কেবল ধানের আর্থিক ক্ষতি হবে এটা। এছাড়া গবাদিপশুর খড়ের প্রকট অভাব দেখা দেবে বলেও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানায়।
তাছাড়া বোরো ধানইতা কাতিয়ায় আবারও ২৫-৩০ বছর ধরে বিল ডাকাতিয়া এলাকার মানুষ জেগে যাওয়া বিলে খন্ড খন্ড জমিতে নিজের মতো করে ভেড়ি-বাধ দিয়ে মাছ চাষের পাশাপাশি বোরো মৌসুমে সুমে ধান ও ভেড়িতে প্রকার সবজি চাষ করে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে বেশ। নানা ঘুরিয়ে বেশ নির্বিঘ্নে জীবন-যাপন করছিলেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে শোলমারী নদীতে পলি জমে জুমে অনেকাংশে ভরাট হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি গেটের ভেতরে কৈয়া নদীর সংযোগ স্থানে পলি জমে ভরাট হওয়ায় বিল ডাকাতিয়ার তলদেশ অপেক্ষাকৃত অনেক নিচু হয়ে পড়ে। এর ফলে ধীরে ধীরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে থাকে। গত অক্টোবরে অতি বর্ষণে সমগ্র বিলের চিংড়ি ঘেরগুলো তলিয়ে তলিয়ে যাওয়ায় মাছ বের হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ভেড়ির। সকল সবজি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় চাষিরা চরম ক্ষতির শিকার হন।
আর তখন থেকেই ডুমুরিয়া উপজেলার রংপুর ও রঘুনাথপুর ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিদের উদ্যোগে ভুক্তভোগি জনগণ পানি নিষ্কাশনের আশায় মাস জুড়ে প্রতিদিন শত শত কৃষক কৈয়া আগষ্ট-সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস এলাকার শোলমারী ১০ ভেন্টের গেটের কাছে এসে সামনের নদীতে নেমে স্বেচ্ছাশ্রমে পলি অপসারণ করেছেন। ডুমুরিয়া-ফুলতলার সংসদ সদস্য ও ডুমুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যানের সার্বক্ষণিক তদারকি ও পানি উন্নয় ‘বোর্ডেরসহায়তায় ২ মাসেরও অধিক সময় ধরে ব্লুইস গেটের বাইরে বা ভেতরেপলি অপসারণ কাজ চলে। কিন্তু নদীর তলদেশ থেকে বিলের তলদেশ অনেকনিচু হওয়া ডাকাতিয়া থেকে আশানুরূপ পানি বের হয়নি। ওইসব চেষ্টায় পলি অপসারণের ২ মাস পার হলেও বিল ডাকাতিয়া থেকে মাত্র ১-দেড় ফুট পানি নেমেছে। আর তাতে চিংড়ি- মাছের ঘেরের ভেড়ি বাঁধ সামান্যই জেগেছে। চলতি বোরো মৌসুমের শুরুতে ঘেরের মধ্যে এখনও ৩ থেকে ৫ ফুট পানি থাকায় আর ১ মাস পরও ধান রোপণের কোনো সুযোগ। তৈরি হবে না। তবে গ্রাম লাগোয়া কিছু পরিমাণ উচু জমিতে ধান হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি অফিসার ইনসাদ ইবনে আমিন বলেন, বিল ডাকাতিয়ায় ডুমুরিয়া উপজেলা অংশে জলাবদ্ধতার পরিমাণ দিনে-দিনে কমে আসছে। আশাকরি বোরো আবাদে সমস্যা হবে না। কিন্তু ডাকাতিয়া বিলের, কৃষকরা সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, গত ২ মাসে বিলের মাত্র ১ থেকে দেড় ফুট পানি কমায় শুধুমাত্র চিংড়ি ঘেরের বেড়ি-বাঁধই দেখা যাচ্ছে। তবে ঘেরের মধ্যে এখনও ৩-৫ ফুট পানি রয়েছে। এ অবস্থায় পানি না সরলে কিভাবে ধান চাষ সম্ভব?
হারি নিয়ে ১৬ বিঘা জমিতে ধান-মাছ চাষি নিউটন বাড়ই বলেন, ডুমুরিয়া উপজেলার টোলনা, পাকুড়িয়া, কোমরাইল, আন্দুলিয়া, দেডুলী, শাহপুর, কৃষ্ণনগর, থুকড়া, রুপরামপুর, গজেন্দ্রপুর, রামকৃষ্ণপুর, রামকৃষ্ণপুর, ঘোনা, শলুয়া, পাহাড়পুর, সাড়াভিটা, বটবেড়া, বারানসি, মুজারঘুটা, বসুরাবাদ, ধামালিয়া, রঘুনাথপুর ও রংপুর এলাকার এক লক্ষাধিক মানুষ এই বিল ডাকাতিয়ার ‘মাছ-ইরি-তরকারি চাষ ও গরু ছাগল পালনের ওপরই আমরা নির্ভরশিল। এসব এলাকার কোথাও ধান চাষের মতো
অবস্থা হয়নি।
অবিনাশ বালা বলেন, জলাবদ্ধতার কারণে আমাদের এলাকার ঠাকুরঝি পুকুর মহাশ্মশানে যাওয়ার ১ কিলোমিটর রাস্তা দিয়েও চলাচল করা যাচ্ছে না বলে, অন্য এলাকায় নিয়ে আমাদের মরদেহ সৎকার করতে হচ্ছে।
ইতোমধ্যে আমাদের ঘের তলিয়ে মাছ-তরকারি শেষ, আসন্ন বোরো মৌসুমে ধান চাষ করতে না পারলে আমাদের পথে বসতে হবে। তাছাড়া জমির হারি দেবো কী করে বা আমরা কী খাবো ?
অনুপ বসাক বলেন, কিছুদিন আগে বিল ডাকাতিয়ার তরকারি নিয়ে ঢাকার বাজার ভরতো। এখন আমাগে খাওয়ার তরকারিও নেই। এখন ধান করতি না পারলি আমাগে মরা ছাড়া কোনো উপায় নেই। এ অবস্থা গুটুদিয়া ইউনিয়নের উত্তরাংশ, ডুমুরিয়া সদররের খলশি- খাজুরা-মির্জাপুর ভুলটে, মাধবকাটি বিলের উত্তরাংশ, খর্নিয়া ইউনিয়নের উখড়া উত্তর ও দক্ষিণ এবং মেছাঘোনা কার্তিকডাঙ্গা বিলে।
ডুমুরিয়া উপজেলা পানি কমিটির সম্পাদব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিল ডাকাতিয়ার ভেতরে জোয়ার ধারা সৃষ্টি করে পলি ফেলে উঁচু করার দাবিতে পানি সম্পদমন্ত্রীর কাছে আমাদের উপজেলা চেয়ারম্যান, ২ ভাইস চেয়ারম্যান ও ১৪ ইউনিয়নের সকল চেয়ারম্যান স্বাক্ষরিত একটি আবেদন করেছি।
সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত রংপুর ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ সমরেশ মন্ডল বলেন, বিল ধান লাগানোর উপযোগী করতে এলাকার কৃষকদের নিয়ে পলি অপসারণসহ পানি উন্নয়ন বোর্ডে দেন-দরবার করেই চলেছি।
জলনিষ্কাশনে বিশেষ তৎপর ডুমুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান গাজী এজাজ আহমেদ বলেন, জলাবদ্ধতার কারণে সকল মাছের ঘের ভেসে গেছে। এখন ধান চাষ করতে গেলে অবিলম্বে উচ্চক্ষমতার পাম্প মেশিনের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুর রহমান তাজকিয়া বলেন, বিগত বর্ষার সময় ১০ ভেন্টের সংযোগ খালের পলি অপসারণ করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও বিলের তলদেশ নিচু হওয়ায় আশানুরূপ পানি বের হচ্ছে না। তাই আমরা ভবদহর মতো উচ্চক্ষমতার চক্ষমতার পাম্প মেশিন বসিয়ে পানি নিষ্কাশনের জন্য উচ্চপর্যায়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছি।
ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শরীফ আসিফ রহমান বলেন, খুলনা জেলা প্রশাসক মহোদয়ের থে সম্প্রতি জলাবদ্ধ বিলডাকাতিয়া এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে। খুলনার পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে সমন্বয় করে দ্রুত জলাবদ্ধতা নিরসনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
সাবেক মন্ত্রী খুলনা-৫ আসনের সাংসদ নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, আশু পানি সুরানোর চেষ্টা অব্যাহত আছে। তবে নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় স্থায়ী সমাধানের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। আপাতত হলে কৃষক সেচপাম্প বসিয়েও যদি বোরো ফসল চাষ করানো যায় তা ক্ষতির হাত থেকে বাঁচবে। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখা।