কাজি আবদুল্লাহ :: বর্ষা মৌসুমের ৪ মাস পরও ‘বিল ডাকাতিয়া’-সহ ডুমুরিয়া উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের বেশ-কয়েকটি বিলের পানি আশানুরুপ না কমায় বোরো ধান চাষ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। চাষিরা হতাশ।
ডুমুরিয়া উপজেলার জলাবদ্ধতা মুক্তির চেষ্টারতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গেল মৌসুমের অতিবর্ষায় ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিল ডাকাতিয়া-সহ সমগ্র উপজেলার বেশিরভাগ বিল-খালে জলাদ্ধতা সৃষ্টি হয়। উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে ২৪১টি গ্রামের মধ্যে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ রংপুর, মাগুরাঘোনা, ধামালিয়া, রঘুনাথপুর, রুদাঘরা, খর্ণিয়া, গুটুদিয়া ও ডুমুরিয়া সদর ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের রাস্তাঘাট ও বাড়ি-ঘরে পানি উঠে যায়। ওই জলাবদ্ধতায় ২০ হাজারের অধিক চিংড়ি ঘের ভেসে যাওয়ায় দেড়’শ কোটি ও ঘেরের আইলের পাশাপাশি ক্ষেতের নানা প্রকার সবজি পঁচে আনুমানিক ২’শ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
পলি পড়ে ও দখলের ফলে নদী-খালগুলো ভরাট হওয়ায় কোনো ভাবেই পানি না নামায় জলাবদ্ধ সাধারণ মানুষের জীবন-যাত্রা থমকে পড়ায় দিশেহারা অবস্থা। মানুষ তার মরদেহ কবর দেওয়ার জায়গাও পাচ্ছিলো না। উপজেলা প্রশাসনিক ভবনের নিচেও পানিতে ছয়লাব। ওই সময় জলাবদ্ধতা থেকে বাঁচতে এলাকার নেতা-জনপ্রতিনিধিদের ডাকে সর্বস্তরের মানুষ, শোলমারী ১০ ভেন্টের স্লুইচ গেটের সামনে ও পেছনের খালের পলি অপসারণে স্বেচ্ছায় হাত-লাগান। পাশাপাশি ডুমুরিয়া উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড ২টি ভাসমান স্কেভেটর দিয়ে শোলমারী নদীর পলি অপসারণ শুরু করে। এছাড়াও মানুষের চরম দূরাবস্থা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে খুলনা কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশ(বিএডিসি) কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকটি বিলে ধান চাষের আশা নিয়ে উচ্চ শক্তির বৈদ্যুতিক পাম্প মেশিন স্থাপনের ব্যবস্থা করে। কিন্তু খুলনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ডিমান্ড নোটের টাকা ও বর্ধিত বিদ্যুৎ মূল্যের দাবিতে অনড় থাকে। তা নিয়ে প্রায় ১ মাস যাবৎ অনেক দেন-দরবার চেষ্টা-তৎবিরের পর ডুমুরিয়া উপজেলা প্রশাসন, বিএডিসি ও সাধারণ কৃষকদের যৌথ উদ্যোগে টাকা জমা দেওয়ার পর বিদ্যুৎ সমিতি সংযোগ দেয়। কিন্তু পাম্প মেশিন চালু হতে অনেক দেরি হওয়ায় বিলগুলো থেকে আশানুরুপ পানি নামেনি।
এতোসব চেষ্টার পরও সমগ্র বিল ডাকাতিয়া-সহ বাদুড়িয়া, ঘোষড়া ও কাঞ্চনপুর বিলের অধিকাংশ জমির উপরে ৩ ফুটেরও অধিক পানি রয়েছে। তবে ওইসব বিলের কিছু জমিতে বোরো চাষ হবে।
উপজেলা কৃষি অফিস বলছে, সাধারণত ডিসেম্বর মাস থেকে এ অঞ্চলের কৃষকরা বীজতলায় ধান বপন করে জানুয়ারিতে ক্ষেতে চারা রোপন করেন। কিন্তু চলতি বছর অতিবর্ষার কারণে এখনও বীজতলা তৈরি চলছে। এ বছর ২১ হাজার ৮’শ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তারমধ্যে ২ হাজার ৫’শ হেক্টর জমি জলাবদ্ধ থাকতে পারে। আর বিল ডাকাতিয়া’য় প্রায় সাড়ে ৬ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে ১ হাজার হেক্টর জমি জলাবদ্ধ। কিন্তু ভুক্তভোগী চাষিরা বলছেন, ৬ হাজার তো দূরের কথা, ১ হাজার হেক্টর জমিতেই চাষাবাদ হবে না।
এ প্রসঙ্গে বিল ডাকাতিয়া অঞ্চলের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ সাড়াভিটা’র চাষি লক্ষণ মন্ডল(৪০) বলেন, এ বছর বিলে ৭ থেকে ৮ ফুট পানি বেড়েছিলো। তবে বর্তমানে অধিকাংশ চিংড়ি ঘেরের আইল(বাধ) জেগেছে। পাশাপাশি গ্রাম সংলগ্ন বিলের চারপাশে অল্প-কিছু জমিও জেগেছে। তবে বেশিলভাগ জমিতে এখনও ৩ ফুটের বেশি পানি থাকায় ধান চাষের আশা নেই, যদি কিছু মাছ হয়। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সাড়াভিটা, বারানসি, বটবেড়া, কৃষ্ণনগর এলাকার। গত ২ বছর ধরে ধান হচ্ছে না। বাড়ির গরু-বাছুর বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছি। তবে এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো সহায়তা পাইনি। অন্যতম ক্ষতিগ্রস্থ ঘোষড়া বিলের কৃষক আব্দুস সেলিম বলেন, এখনও সমগ্র বিল পানি নিচে। তবে আমরা মেশিন লাগিয়ে চেষ্টা করছি। দেরিতে হলেও ৫০-৬০ শতাংশ জমিতে ধান চাষ হবে।
উপজেলা কৃষি অফিসার ইনসাদ ইবনে আমিন বলেন, আমরা আশা করছি, বিল ডাকাতিয়া ও ঘোষড়া বিলের অধিকাংশ জমিতে বোরো চাষাবাদ হবে। তবে উপজেলার মাগুরাঘোনা ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম হেলাল বলেন, কাকুড়পাড়া, ঘোষড়া, বাদুড়িয়া বেতাগ্রাম বিলের বেশিরভাগ জমিতে এখনও ৩ থেকে সাড়ে ৪ ফুট পানি আছে। কৃষকরা দোমকল দিয়ে পানি সরানোর চেষ্টা করলেও আরও ১ মাস লাগতে পারে। তবে অনেক জমিতেই বোরো চাষ হবে না। বিল ডাকাতিয়া সংলগ্ন সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ রংপুর ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ সমরেশ মন্ডল বলেন, পানি নিষ্কাশনের জন সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। কিন্তু বিল ডাকাতিয়ার সামান্য কিছু জমি জাগলেও অধিকাংশ জমিই এখনও ৩-৪ ফুট পানির নিচে। সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জমিতে ধান চাষ হতে পারে। খুলনা কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশ(বিএডিসি)’র নির্বাহী প্রকৌশলী জামাল ফারুক বলেন, সমগ্র ডুমুরিয়া উপজেলায় মোট ৫৪টি উচ্চ ক্ষমতার সেচ-পাম্প বসানো হয়েছে। তারমধ্যে এ বছর বসানো হয়েছে ১৯টি। উপজেলার জলাবদ্ধ বিলগুলোর মধ্যে সেচ ও শুষ্ক মৌসুমের কারণে ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হতে পারে। আর বিল ডাকাতিয়া-সহ রংপুর এলাকার ৬ থেকে ৭ হাজার হেক্টর জমি এখনও জলাবদ্ধ।