শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বিমা খাতের কোম্পানি ডেল্টা লাইফ ইন্সুরেন্সে ব্যাপক অনিয়ম চলছে। গ্রাহককে পলিসিরি টাকা না দেওয়া, তহবিল বাড়িয়ে দেখানো এবং সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। শুধু তা-ই নয়, ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে টাকা আদায় হলেও তা কোম্পানির হিসাবে দেখানো হয়নি। ব্যাংক হিসাবে রয়েছে বড় ধরনের গরমিল। এমনকি কোম্পানির আর্থিক রিপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রেও মানদণ্ড মানা হয়নি। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ৪৭ ধরনের অনিয়ম চিহ্নিত হয়েছে।
এই খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইন্সুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটির (আইডিআরএ) নিয়োগ দেওয়া দুটি প্রতিষ্ঠানের বিশেষ নিরীক্ষা ও তদন্তে উঠে এসেছে উল্লিখিত সব চাঞ্চল্যকর তথ্য। এমন নাজুক অবস্থা দেখে সংশ্লিষ্টদের মন্তব্য-নানা অনিয়মে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির ‘বারোটা বেজেছে’। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে এই মুহূর্তে প্রশাসক নিয়োগের বিকল্প নেই।
এদিকে প্রতিষ্ঠানটির ১০টি অনিয়মকে অধিকতর তদন্তের সুপারিশ করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ মনে করছে, এই কোম্পানি গ্রাহকের স্বার্থ ক্ষুণ্নের পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদের নিজেদেরও ক্ষতি করেছে। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে শিগগিরই প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে কেন প্রশাসন নিয়োগ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে কোম্পানিকে চিঠি দিয়েছে আইডিআরএ। ৩১ জানুয়ারির মধ্যে চিঠির জবাব দিতে বলা হয়েছে। আইডিআরএ সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এ ছাড়াও এসব অনিয়ম ও ব্যর্থতার কারণে প্রতিষ্ঠানের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আদিবা রহমানের পুনঃনিয়োগের আবেদন বাতিল করেছে আইডিআরএ।
জানতে চাইলে বিমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্সুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি (বিআইএ) শেখ কবির হোসেন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হলো আইডিআরএ। আর এ খাতে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব তাদের। এ কারণে তারা যদি মনে করে, কোনো কোম্পানিতে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার দরকার রয়েছে, সেক্ষেত্রে তারা নিয়োগ দিতে পারে। এর আগেও বায়রা লাইফে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফলে বিষয়টিকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখছি। কারণ গ্রাহকের দাবি পূরণ না করা এবং বিভিন্ন কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তবে প্রশাসকের নিয়োগের মতো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কোম্পানিকে অনিয়মের ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। এ ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হলে প্রশাসক দিতে পারে।
জানতে চাইলে ডেল্টা লাইফ ইন্সুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আদিবা রহমান রোববার লিখিতভাবে যুগান্তরকে বলেন, কেন প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে না, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ ব্যাপারে আমাদের কাছে ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এর ব্যাখ্যা দেব। তবে একটি বিষয় বলতে পারি, আইডিআরএ-এর এক কর্মকর্তা আমাদের কাছে ঘুস চেয়েছিলেন। আমরা সেই ঘুস না দেওয়ায় তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন। আদিবা রহমান আরও বলেন, ওই কর্মকর্তা মোবাইল ফোনে ঘুস চেয়েছেন। আমাদের কাছে এর রেকর্ড রয়েছে। এগুলো আমরা দুদকে দিয়েছি। আর অডিট রিপোর্টে কিছু অভিযোগ তুলেছেন। তবে রিপোর্টেই বলা আছে এগুলো প্রমাণিত নয়। এক্ষেত্রে প্রমাণিত না হলে অভিযোগ আমলে নেওয়া যায় না। ডেল্টা লাইফের সিইও আরও বলেন, একটি নির্ধারিত সময়ে সবকিছু প্রকাশ করব। তখনই আপনারা বিষয়টি জানতে পারবেন। তবে টাকা তোলার ব্যাপারে তিনি বলেন, নগদ টাকা তোলা সংক্রান্ত কোনো বিধান নেই। এই বিষয়টি সঠিক নয়। আর পলিসি তামাদির ব্যাপারে তিনি বলেন, পলিসি তামাদি হতে পারে। এতে কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি ঠিক নয়। আইডিআরএ-এর চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ডেল্টা লাইফে গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষা করা হচ্ছে কি না, তা নিরীক্ষার জন্য গত বছর দুটি ফার্মকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এগুলো হলো-এমএস হাওলাদার ইউনূস অ্যান্ড কোং এবং এমএস ফেমস অ্যান্ড আর। এর একটি ফার্ম নিরীক্ষা এবং অন্যটি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের তদন্ত করেছে।
এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ২২টি অডিট আপত্তির ক্ষেত্রে বিমা আইন ও বিধির লঙ্ঘন হয়েছে। ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালের নিরীক্ষা করা হয়। প্রতিবেদনে ১০টি বিষয়ে অধিকতর তদন্তের কথা বলা হয়েছে। তদন্ত করতে গিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে আরও ২৫টি অনিয়ম পাওয়া গেছে। এসব অনিয়মের বিষয়ে কোম্পানির পক্ষ থেকে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনের ব্যত্যয় স্বীকার করে নিয়েছে কোম্পানিটি। কিন্তু এসব বিষয়ে কীভাবে সংশোধন করা এবং গ্রাহকদের স্বার্থ কীভাবে পুনরুদ্ধার করা হবে, এ ব্যাপারে কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি। চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, কর্তৃপক্ষের বিশ্বাস-এই কোম্পানির মাধ্যমে ভবিষ্যতেও গ্রাহকের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হতে পারে। সেক্ষেত্রে বীমা আইন ২০১০ সালের ৯৫ ধারা মোতাবেক কোম্পানিতে কেন প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে না, তা সাতদিনের মধ্যে জানাতে হবে।
এক্ষেত্রে ৩১ জানুয়ারি বেলা সাড়ে ১১টার মধ্যে জবাব দিতে হবে।
আইডিআরএ সূত্র জানায়, ২০১৯ সালে কোম্পানির প্রচুর পরিমাণ পলিসি তামাদি হয়েছে। এক্ষেত্রে ১৮০ কোটি টাকা প্রিমিয়াম বঞ্চিত হয়েছে কোম্পানিটি। এক্ষেত্রে সরকারের বড় অঙ্কের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। আলোচ্য সময়ে ২২১ কোটি টাকার ব্যাংক বিবরণী পাওয়া যায়নি। ২১৮ কোটি টাকা ব্যাংকে যথাযথভাবে জমা হয়নি। আইডিআরএ-এর নির্দেশনা রয়েছে, ৫ হাজার টাকার বেশি নগদ লেনদেন করা যাবে না। কিন্তু এটি আমলে নেয়নি কোম্পানিটি। আলোচ্য সময়ে প্রচুর পরিমাণে নগদ লেনদেন করেছে, এ প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে ২০২০ সালের ডিসেম্বরেই ১০০ কোটির বেশি নগদ উত্তোলন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে মুনাফায় বড় অংশের কমিশন দেখানো হয়েছে। ব্যাংকের যে বিবরণী দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে সুদ ও লভ্যাংশের তথ্য ভেরিফাইড নয়। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও শর্ত মানেনি এ প্রতিষ্ঠান। নিয়মেই বাইরে গিয়ে জেড ক্যাটাগরির শেয়ারে বিনিয়োগ করা হয়েছে। ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা সার্ভিস আদায় করলেও তা কোম্পানির হিসাবে দেখানো হয়নি। বিভিন্ন সময়ে ক্ষতিপূরণ হিসাবে পাওয়া ৩৯ লাখ টাকা কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে নেই। এ ছাড়াও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ৫৯ কোটি টাকা প্রিমিয়াম আদায় হয়নি। কিন্তু সেখানেও বড় অনিয়ম পাওয়া গেছে। কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন যেভাবে তৈরি করা হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড মানা হয়নি। অন্যদিকে ২০১৫, ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে ২৫৪ প্রিমিয়াম বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। কোম্পানিটি একটি প্রতিবেদনে বলেছে তাদের গ্রাহক সংখ্যা ১৮ লাখ। কোম্পানি আইডিআরএ-এর কাছে যে তথ্য দিয়েছে, সেখানে পলিসির সংখ্যা দেখানো হয়েছে ২ লাখ ১ হাজার ১২টি। কোম্পানির ৯০ শতাংশ পলিসির ক্ষেত্রে মোবাইল নম্বর নেই। এ কারণে আইডিআরএ মনে করছে, এখানে গ্রাহকের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়াসহ ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে।
জানা গেছে, বিমা খাতের অন্যতম প্রভাবশালী কোম্পানি ডেল্টা লাইফ। ১৯৮৬ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৯৫ সালে শেয়ারবাজারে আসে। এর আগেও মামলা সংক্রান্ত বিভিন্ন জটিলতায় দীর্ঘদিন কোম্পানির লভ্যাংশ আটকে ছিল।