চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃ টাকার অংকে এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে প্রকল্পটিতে। এবার ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইস্পিড রেলপথ নির্মাণে বড় একটি প্রকল্প নিতে যাচ্ছে সরকার। রূপপুরের পর এটিই হবে সম্ভাব্য সবচেয়ে বড় প্রকল্প।
প্রকল্পটির চূড়ান্ত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত দ্রুতগতির রেলপথটি নির্মাণে খরচ হবে ১ হাজার ১৪০ কোটি ডলার বা প্রায় ৯৭ হাজার কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রী রেলপথটি কক্সবাজার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় এখনো চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অংশের ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়নি। তবে এ অংশের নির্মাণ ব্যয় ৫০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম ভায়া কুমিল্লা/লাকসাম দ্রুতগতির রেলপথ নির্মাণের জন্য ‘সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিশদ ডিজাইন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হচ্ছে ১১০ কোটি টাকা। চীনের ‘চায়না রেলওয়ে ডিজাইন করপোরেশন’ (সিডিআরসি) ও বাংলাদেশের ‘মজুমদার এন্টারপ্রাইজ’ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিশদ নকশা প্রণয়নের কাজ করছে।
এরই মধ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন বাংলাদেশ রেলওয়েতে জমা দিয়েছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এতে হাইস্পিড রেলপথের জন্য সম্ভাব্য চারটি গতিপথ নির্ধারণ করেন সমীক্ষা প্রকল্পের পরামর্শকরা। ২২৭ দশমিক ৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ‘ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-কুমিল্লা-ফেনী-চট্টগ্রাম’ রেলপথকে রাখা হয় ‘অপশন ১’ হিসেবে। ‘অপশন ২’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ২৩৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ‘ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-কুমিল্লা-লাকসাম-ফেনী-চট্টগ্রামকে। ‘অপশন ৩’-এ রাখা হয় ২২২ দশমিক ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-বাগমারা-ফেনী-চট্টগ্রামকে। আর ‘অপশন ৪’ হিসেবে রাখা হয় ২২০ দশমিক ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-লাকসাম-ফেনী-চট্টগ্রামকে।
এ চার গতিপথের মধ্যে প্রথমটিতে (ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-কুমিল্লা-ফেনী-চট্টগ্রাম) হাইস্পিড রেলপথ নির্মাণের সুপারিশ করেন পরামর্শকরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ গতিপথটি অনুমোদন করেছেন। রেলপথটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১৪০ কোটি ডলার। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী (প্রতি ডলারে ৮৪ টাকা ৮৭ পয়সা) এতে ব্যয় হবে ৯৬ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। এ বিনিয়োগের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টারনাল রেট অব রিটার্ন (এফআইআরআর) ধরা হয়েছে ৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আর ইকোনমিক ইন্টারনাল রেট অব রিটার্ন (ইআইআরআর) ধরা হয়েছে ১৫ দশমিক ১৮ শতাংশ।
নির্মাণব্যয়ের এ প্রাক্কলন শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম অংশের জন্য বলে জানিয়েছেন প্রকল্পটির পরিচালক কামরুল আহসান। তিনি বলেন, ‘সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনে নির্মাণ ব্যয়ের যে প্রাক্কলন করা হয়েছে, বিশদ নকশা প্রণয়নের সময় সেখান থেকে কিছুটা কম-বেশি হতে পারে।’ তবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অংশের নির্মাণ ব্যয় সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) কবে নাগাদ প্রকল্পটি উঠতে পারে—এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রকল্প পরিচালক বলেন, এখন বিস্তারিত নকশা প্রণয়নের কাজ চলছে। এটা শেষ হলেই উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরি করা হবে। আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়াগুলো শেষ করে আগামী বছরের মধ্যেই প্রকল্পটি একনেকে উঠতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড রেলপথ নির্মাণে ৬৬৮ দশমিক ২৪ হেক্টর জমি প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে অধিগ্রহণ করতে হবে ৪৬৪ দশমিক ২ হেক্টর।
রেলপথটির গতিপথ চূড়ান্ত করার পাশাপাশি বিভিন্ন কারিগরি মানও অনুমোদন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রকল্প কার্যালয়ের তথ্য বলছে, রেলপথটি হবে শুধু যাত্রী পরিবহনের জন্য। ডিজাইন স্পিড ধরা হয়েছে প্রতি ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার। স্ট্যান্ডার্ড গেজের দুটি লাইন নির্মাণ করা হবে, যেগুলোর এক্সেল লোড হবে ১৭ টন ধারণক্ষমতার। বিদ্যুত্চালিত রেলপথটি হবে পাথরবিহীন। ব্যবহার করা হবে অত্যাধুনিক ‘অটোমেটিক ব্লক’ সিগন্যাল ব্যবস্থা।
রেলপথটিতে একটি ট্রেন বিরতিহীনভাবে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যেতে সময় নেবে ৫৫ মিনিট। আর বিরতি দিয়ে চললে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছতে সময় লাগবে ৭৩ মিনিট। দিনে প্রায় ৫০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা যাবে হাইস্পিড রেলপথটি দিয়ে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে যাতায়াত সহজ হওয়ার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট এলাকায় নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করেন রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। হাইস্পিড রেলপথ প্রকল্পটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী প্রকল্পের গতিপথ ঠিক করে দিয়েছেন। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-কুমিল্লা-ফেনী-চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে হাইস্পিড লাইনটি নির্মাণ করা হবে। এজন্য আমরা বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন করছি। রেলপথটি নির্মাণে কত টাকা খরচ হবে, কী পরিমাণ জায়গা অধিগ্রহণ করতে হবে, কীভাবে অধিগ্রহণ সম্পন্ন করা হবে, সেই কাজগুলোও আমরা করছি। হাইস্পিড রেলপথের সঙ্গে আরো কিছু বিষয় জড়িত। রেলপথটিতে যেসব ট্রেন চলাচল করবে, সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলাদা ওয়ার্কশপ লাগবে। দক্ষ জনবলও লাগবে। রেলপথটি যেহেতু এলিভেটেড হবে, সেহেতু কমলাপুরের সঙ্গে এর সংযোগটি নিয়েও বিশদ পরিকল্পনা প্রয়োজন। হাইস্পিড ট্রেনের বিষয়টা মাথায় রেখে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনটি আধুনিকায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সব কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে বলে জানান তিনি।
ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ নির্মাণে বিনিয়োগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মন্ত্রী বলেন, এটা অনেক টাকার প্রকল্প। বিদেশী সাহায্য ছাড়া আমাদের পক্ষে বাস্তবায়ন করা কঠিন। বিনিয়োগের জন্য আমরা প্রয়োজনীয় কাজগুলো করে যাচ্ছি।সূত্র-বণিক বার্তা