ফকির শহিদুল ইসলামঃ প্রানঘাতী করোনাা ভাইরাসের প্রভাবে করোনা উৎসস্থল চীনে কাঁকড়া-কুচিয়া রপ্তানী বন্ধ থাকায় দেশের তিন উপকূলীয় জেলা খূলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় অঞ্চলের অত্যন্ত ব্যস্ত কাঁকড়া-কুচিয়া বাজার আর ঘেরগুলোতে শূণ্যতা আর অনিশ্চিয়তা দৃশ্যমান। করোনা দুর্যোগে স্থবির হয়ে পড়ছে দক্ষিণাঞ্চলের কাঁকড়া-কুচিয়া রপ্তানী বাণিজ্য। করোনা প্রর্দুভাব দেখা দেয়ার আগেও রপ্তানিযোগ্য কাঁকড়া-কুচিয়া প্রক্রিয়াজাতকরণের এ কারখানাগুলো ছিল কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর। সেখানেই এখন আশ্চর্য নীরবতা। শুয়ে বসে অলস দিন কাটছে শ্রমিকদের। ফলে বেকার হয়ে পড়েছেন কাঁকড়া-কুচিয়া সংগ্রহ-লালনপালন ও রপ্তানির সঙ্গে জড়িত প্রায় জড়িত প্রায় ৫ লক্ষ পরিবার । রপ্তানী বন্ধ ও রপ্তানিকারকদের পাওনা আটকে যাওয়ায় এ সাথে সংশ্লিষ্ঠরা রয়েছে মারাত্বক অর্থনৈতিক সংকটে! রপ্তানিকারকদের কাছে পাওনা টাকা আটকে যাওয়ায় ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না খামারিরা। দ্রুত রপ্তানি পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে ২০০ কোটি টাকা লোকসানের আশঙ্কা করছেন কাঁকরা-কুচিয়া রপ্তানিকারকরা। বিপর্যয়ের মুখে এখানকার এই খাতের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার প্রান্তিক কাঁকড়া-কুচিয়া চাষী। বিশেষ করে চীনে রপ্তানী বন্ধ থাকায় দেশের উপকূলীয় তিনটি জেলায় কাঁকড়া শিল্পের সাথে জড়িত প্রায় ৫ লক্ষ পরিবার এখন রয়েছে মারাত্বক অর্থনৈতিক সংকটে দিন যাপন করছেন। খুলণাঞ্চল থেকে দৈনিক প্রায় ৪৫ টন কাঁকড়া-কুচিয়া রপ্তানি হতো। যার ৯০ শতাংশই যেত চীনে। তবে করোনা ভাইরাসের আক্রমণে স্থবির চীনে ২০ জানুয়ারির পর কুচিয়া রপ্তানি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে।
রপ্তানির তথ্য মতে, ২০১৯ সালে কাঁকড়া-কুচিয়ার মাধ্যমে বৈদেশিক আয়ের পরিমাণ প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। এ বছর ১১০০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও তা শুরুতেই খেল বড় ধরনের ধাক্কা। লোকাসান গুনতে শুরু করেন বাংলাদেশে করোনা মহামারী হিসেবে বিস্তারের অনেক আগে থেকেই। বাংলাদেশ লাইভ অ্যান্ড চিলড ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনে নিবন্ধিত রপ্তানিকারকের সংখ্যা রয়েছে ২০৪টি।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, বর্তমানে প্রায় ২০০ কোটি টাকার কাঁকড়া-কুচিয়া মজুদ আছে। ১০০ কেজিতে দৈনিক ৫-৭ থেকে কাঁকড়া-কুচিয়া মারা যাচ্ছে। আগামী কিছু দিনের মধ্যে রপ্তানি কার্যক্রম পুনরায় শুরু না হলে মজুদ করা কাঁকড়া-কুচিয়া সম্পূর্ণ মারা যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। বিষয়টি নিয়ে চীনের সাথে আলোচনা করে রপ্তানি পুনরায় শুরু করতে সরকারকে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান খাত সংশ্লিষ্টদের।
সূত্রমতে,বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর কারনে অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত রয়েছে বিদেশে কাঁকড়া ও কুই”া রপ্তানী। সারাবিশ্বে করোনা মহামারীর রুপ নিয়েছে। তবে এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এখানকার রপ্তানীযোগ্য কাঁকড়া-কুইচার সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে চীন। চীন করোনা ভাইরাসের উৎসস্থল হওয়ার কারনে দেশটি গত ২৫ জানুয়ারী থেকে সব ধরনের পণ্য আমদানীর উপরে নিষেধাজ্ঞা জারী রেখেছে।
সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে দেশের রামপাল-বাগেরহাট কাঁকড়া ডিলার সমিতির সাধারণ সম্পাদক স্বপন মন্ডল বলেন, সাধারনত নববর্ষ উৎসবের সময় চীনে প্রচুর পরিমানে কাঁকড়ার চাহিদা থাকে। আমরা তাই চীনের নববর্ষকে সামনে রেখে ব্যাপক পরিমানে দেশটিতে কাঁকড়া –কুইচা রপ্তানী করে থাকি। কিন্তু প্রানঘাতী করোনায় এবছর তা সম্ভব হয়নি, ফলে প্রচুর পরিমানে কাঁকড়া-কুইচা নষ্ট হয়েছে। এর ফলে আমাদের মতো প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের ব্যাপকভাবে আর্থিক লোকসানের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের লাগোয়া মূলত তিনটি উপকূলীয় জেলায় কাঁকড়ার চাষ ও রপ্তানী প্রক্রিয়াজাত করা হয়ে থাকে। দেশে উৎপাদিত ও প্রক্রিয়াকৃত এই কাঁকড়া মূলত চীন, জাপান, তাইওয়ান, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, জার্মানী ও অষ্ট্রেলিয়ায় রপ্তানী করা হয়। তবে মোট রপ্তানীর প্রায় ৯০ শতাংশই ধরে রেখেছে চীনের বাজার।
গত ২৫ জানুয়ারী থেকে ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত চীনে কাঁকড়া রপ্তানী পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে বলে নিশ্চিত করেন বাংলাদেশ লাইভ ক্র্যাব অ্যান্ড ঈল ফিশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন -এর (বাংলাদেশ কাঁকরা ও বান মাছ রপ্তানীকারকদের সংগঠন) মহাসচিব কাজী মাহাবুবুল আলম আজাদ।
তিনি বলেন, এরপর কিছুদিন আমরা চীনের কয়েকটি প্রদেশে রপ্তানী অব্যাহত রাখার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু গত ২৩ মার্চের পর থেকে বাংলাদেশ সরকার দেশের সব বিমান বন্দরগুলো বন্ধ করে দেয়। এ অবস্থায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলে আমরা হয়ত শিগ্রই আবারো কাঁকরা-কুইচা রপ্তানী শুরু করতে পারবো বলে আশা করছি। তিনি আরো বলেন, আমাদের জন্য আরো একটি বড় সমস্যা হচ্ছে আমরা এখনও পর্যন্ত রপ্তানীকৃত কাঁকড়ার কোনো মূল্য পাইনি। বিদেশে রপ্তানী করা কোনো চালানের মূল্যই এখন পর্যন্ত আমাদেরকে পরিশোধ করেনি এসব চালানের আন্তর্জাতিক ক্রেতারা। ফলে আমরা প্রান্তিক চাষিদের পাওনা পরিশোধ করতে পাড়ছি না ।
প্রাথমিক ক্ষতির পরিমান সম্পর্কে জানতে চাইলে মাহাবুবুল আলম আজাদ বলেন, আমাদের হিসাব মতে এই খাতে এখন পর্যন্ত লোকসানের পরিমান কমপক্ষে চার বিলিয়ন টাকা (৪৬.৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)। এই ক্ষতির সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হচ্ছে এই খাতের সাথে জড়িত তৃণমূল পর্যায়ের প্রান্তিক চাষীরা। দেশে এই শিল্পের সাথে জড়িত আছে প্রায় পাঁচ লাখেরও বেশি প্রান্তিক চাষী যাদের প্রায় সবাই দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। রপ্তানী বন্ধ থাকায় দেশের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে কাঁকড়া –কুইচা শিল্পের সাথে জড়িত প্রায় ৫ লক্ষ চাষী ,পরিবার ও সশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা এখন ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মুখে রয়েছেন ।
অপরদিকে চাহিদা কমে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারেও কাঁকড়ার ভয়াবহ দরপতন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। স্থানীয় বাজারে কাঁকড়ার মূল্য কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ হ্রাস পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে পাইকারী কাঁকরা বিক্রেতা মোঃ রহম আলী সানা বলেন, স্বাভাবিক সময়ে দেশের স্থানীয় বাজারে উন্নত প্রজাতির কাঁকড়ার মূল্য কেজি প্রতি ছিল ২,৫০০ টাকা। আর মহামারীর এই সময়ে কাঁকড়ার মূল্য মারাত্বকভাবে নিম্নগামী, এখন আমরা দেশের বাজারে এক কেজি কাঁকড়া ৮০০ থেকে ৯০০ টাকার বেশি কোনোভাবেই বিক্রি করতে পারছি না।
বাজারে মূল্য কমার পাশপাশি আমাদের আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে তাদের কাছে এখন বিপুল পরিমান অবিক্রিত প্রক্রিয়াজাতকৃত কাঁকড়া-কুইচা পড়ে আছে। দেশের বাজারে কাঁকড়া-কুইচা ও বান মাছের চাহিদা এখন বলতে গেলে একদমই নেই। তিনি আরো বলেন, এখানে বলে রাখা ভালো যে আমাদের দেশের কাঁকড়া-কুইচা ব্যবসায়ীরা পুরোপুরি বিদেশী বাজারের উপরেই নির্ভরশীল বলেই এ বির্পযয় অবস্থা তৈরি হয়েছে।