ধরুন, সরকারি ঘোষণা এলো, আগামী ১ ঘণ্টা যার যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে, কোনো অপরাধ হবে না। ইনডেমনিটি দেওয়া হবে। কি হবে তাহলে? যার যা খারাপ/বেআইনি কাজ করার ইচ্ছা তাই করবে। কেউ গিয়ে চুরি করবে, কেউ খুন, কেউ কাউকে থাপ্পড় মারবে, কেউ ২০০ কিমি গতিতে গাড়ি চালাবে ইত্যাদি।
আপনি কোন খারাপ কাজটা করবেন ভেবে দেখেন তো? এইরকম সময়ে কোনো ভালো কাজের কথা মাথায় আসে কিনা, তাও ভেবে দেখেন। না সকলের মাঝে যা আইন দ্বারা নিষিদ্ধ, যেটা স্বাভাবিক সময়ে করা যায় না, তাই করার প্রবণতা জাগবে।
ভালো কাজ করার জন্য তো আইন নিষেধ করে না। মন্দ বা ক্ষতিকর কাজে বাধা দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রের দরকার, আইনের দরকার, সরকারের দরকার।
রাষ্ট্র তার এই নিয়ন্ত্রণমূলক কাজটি মূলতঃ সরকার বা নির্বাহী বিভাগের মাধ্যমে করে থাকে।
নির্বাহী বিভাগই সরকারের মূর্তরুপ। তাই সরকারের সমালোচনা মানে নির্বাহী বিভাগের সমালোচনার সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়।
অপরিহার্যতা থাকা স্বত্তেও সরকার বা নির্বাহী বিভাগ যতটা না প্রশংসিত তার চেয়েও ঢের বেশি সমালোচিত।
Henry David Throreau তার Civil Disobedience (১৮৪৯) বইয়ে উল্লেখ করেছিলেন- The government is the best which governs the least. অর্থাৎ তিনি মিনিমাম government চান।
যদিও তিনি সরকারের প্রয়োজনিয়তা উপেক্ষা করতে পারেননি। তিনি সরকারকে কর দিতে অস্বীকার করেছিলেন। সরকার, কর এই সবকে তিনি তার ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ মনে করতেন। তিনি বেশ কয়েক বছর বনে একা ছিলেন। তার উক্তির কারণ তার জীবনধারার দিকে তাকালে বোঝা যায়।
অর্থনৈতিক সংস্কারবাদী রোনাল্ড রিগ্যান বলেছিলেন-The most terrifying line in English is-I am from the government and I am here to help. মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থক একজন রাষ্ট্রনায়ক রাষ্ট্রের ভূমিকাকে ছোট করবেন-এটাই স্বাভাবিক। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময় তিনি তার এই উক্তিকে কীভাবে মূল্যায়ন করেছিলেন- তা আগ্রহোদ্দীপক।
Nietzsche বলেছিলেন- Everything the state says is a lie and everything it has, it has stolen.
তিনি হয়ত ভুল বলেননি। রাষ্ট্র হয়ত মিথ্যাও বলে। ধরুন, আমেরিকাতে খুব খারাপ একটি রোগ ছড়িয়ে পড়তে যাচ্ছিল। এইসময় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এসে এই দুঃসংবাদ দেবেন না। তিনি জনগণের হতাশা কাটাতে নিশয়ই আশার বাণী (মিথ্যা হলেও) শোনাবেন। Law and Order situation খারাপ হলে নির্বাহী বিভাগকেই তা নিয়ন্ত্রণে অনেক কিছুই করতে হবে।
রোহিঙ্গা সমস্যার কথাই ধরুন না। ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিলেও সমস্যা, না দিলেও সমস্যা। এই যে একদল অত্যাচারিত, বুভুক্ষ, গৃহহীন মানুষকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, খাবার দেওয়া হচ্ছে- এটা খুব বেশি প্রশংসিত নয়। এমনকি দুই-একজন রোহিঙ্গা জনপ্রতিনিধি, পুলিশের ওপর হামলা পর্যন্ত চালিয়েছে। এখন যদি Law and Order রক্ষার স্বার্থে পুলিশ যদি একটু ভূমিকা নিত, তাদের খাবার দাবারে একটু সমস্যা হলে বা জেলা প্রশাসনের কেউ ত্রাণ বা অন্যান্য সামগ্রী বিতরণ করতে গিয়ে বিশৃঙ্খলা দেখে মেজাজ হারিয়ে ফেলে- তাইলেই রব উঠবে- কি অমানবিক আচরণ!!! কেউ চিন্তাও করবেনা—৫/৬ লাখ বাস্তুহীন, স্বজনহারা, অত্যাচারিত লোককে নিয়ন্ত্রণ প্রশাসনের ২০-২৫ জন অফিসার এবং ১০০-১৫০ জন পুলিশের জন্য কতটা কঠিন ছিল?
মাঝে-মাঝে মনে হয় নির্বাহী বিভাগ তথা সরকারকে মানুষ অভিভাবক ভাবে। তবে প্রশংসা করার জন্য নয়। দায়িত্ব পালনের জন্য অথবা কি পেয়েছে, কি পায়নি, তার হিসাব নেওয়ার জন্য।
প্রতিটি শিশুর কাছে তার বাবা হারকিউলিস। শিশু তার বাবার গঠন, পেশি ইত্যাদি দেখে সে এইরুপ ধারণা পোষণ করে। সে মনে করে তার বাবা তাকে বাঘ, দৈত্য-দানব থেকে রক্ষা করতে সক্ষম। তেমনি নাগরিকরা মনে করে সরকার বা নির্বাহী বিভাগ যেকোনো কিছু করতে পারে। ব্যক্তির তুলনায় সরকার বা নির্বাহী বিভাগ অনেক বড়, ক্ষমতাশালী। তাই এই ধরনের ধারণা পোষণ অমূলক নয়।
মায়ের মত নির্বাহী বিভাগও সারাদিন এমন অসংখ্য কাজ করে, যা thankless.
একটি ধারণা প্রচিলত আছে যে, নির্বাহী বিভাগ মানেই ক্ষমতার অপব্যবহার অথবা অধিক ব্যবহার। অনেক সময় নির্বাহী বিভাগকে অনেক কিছু করতে হয়, যা না করলে বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে। সেক্ষেত্রে আইনের কিছুটা ব্যত্যয় হতে পারে। দিনের শেষে দেশ ও মানুষের ভাগ্যের জন্য নির্বাহী বিভাগকেই জবাবদিহি করতে হয়।
সরকার বাজারে হস্তক্ষেপ করলে এক শ্রেণি চটে উঠবে, আবার যখন ক্রাইসিস দেখা দেবে তখন সবাই সরকারি হস্তক্ষেপ আশা করবে এবং এই ধরনের হস্তক্ষেপে বাধ্য করবে।
মুক্তচিন্তার, বাজারের দেশ মার্কিন দেশেও কিন্তু ক্রাইসিস এর সময় নির্বাহী তথা সরকারকে বাজারে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে।
চলমান করোনাভাইরাস মোকাবেলায় Medical Equipment বানানোর জন্য USAতে Defence Production Act, 1950 এর আওতায় বেশ কিছু কোম্পানিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
নির্বাহী বিভাগের অজনপ্রিয়তার পেছনে “জিভের আগায় মধু” তত্বও প্রাসঙ্গিক। কৌটিল্যর উক্তির রেফারেন্স টেনে বলা যায়, মধু জিভের আগায় থাকলে যেমন এর স্বাদ উপভোগ না করে পারা যায় না, তেমনি ক্ষমতা থাকলে এর কিছুটা অপব্যবহারের সম্ভাবনা থেকেই যায়। আর সেটা শুধু নির্বাহী বিভাগ কেন, যেকোনোও প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও সত্য।
আরেকটি বিষয় দেখা যায়, একই কাজ নির্বাহী বিভাগ করলে একরকম মূল্যায়ন হয়, আর কোনো ব্যক্তি বা কমিশন করলে আরেকরকম মুল্যায়ন হয়।
ধরুন, রোহিঙ্গা শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে নির্বাহী বিভাগ নিজ থেকেই অনেক কাজ করল, এটা খুব একটা প্রশংসিত হবে না। একই কাজ সরকার তথা নির্বাহী বিভাগ যদি, ধরুণ, মানবাধিকার কমিশনের persistence, advocacy এর কারণে করল- কি হবে তখন? মানবাধিকার কমিশনের নামে জয়ধ্বনি উঠবে। কাজটি সম্পন্ন করা নির্বাহীর নাম হয়ত কালেভদ্রে মুখে আসতেও পারে কারো। আকাশচুম্বী প্রত্যাশা থাকা স্বত্তেও যে বিভাগটির ক্ষমতা কমানোর পক্ষে সবসময় কথা উঠে সেটাও নির্বাহী বিভাগ। এটা অবশ্য পৃথিবীজুড়ে প্রচলিত। তারপরও দিনের শেষে জনগণের চাহিদা নির্বাহী বিভাগের কাছেই। এটাই স্বাভাবিক
সবশেষে আমার যা মনে হয়, মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীনতাপ্রিয়। চেতন বা অবচেতন মনে মানুষ কোনো ধরণের নিয়ন্ত্রণ পছন্দ করে না। বিজ্ঞ আদালত বা কমিশনসমূহ যেখানে মানুষের বিভিন্ন ধরনের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলে, সেখানে নির্বাহী বিভাগকে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার রক্ষার স্বার্থে মানুষের প্রত্যাশিত স্বাধীনতাকে সামাজিক চুক্তির নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এই নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে মধুতত্ব অনুসারে Abuse/excess হবার সম্ভাবনা থাকে। আর সেটাই নির্বাহী বা নির্বাহী বিভাগকে অজনপ্রিয় করে তোলে।
লেখক: মোঃ ইউসুপ আলী, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, খুলনা।