চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় আমনের বাম্পার ফলনের হাসি আবারও ম্লান হচ্ছে কৃষকের। উৎপাদন খরচও উঠছে না। স্বপ্ন ভঙ্গে হতাশ কৃষক। অথচ ভরা মৌসুমেও প্রধান খাদ্য দ্রব্য চালের মূল্য হ্রাস সুবিধা পায়নি ক্রেতারা। এদিকে খুলনার নয় উপজেলায় ৯ হাজার ১২০ মেট্রিক টন আমন সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা গেল এক মাসে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত মাত্র ৭৩ মেট্রিন টন ধান সংগ্রহ করেছে খাদ্য বিভাগ।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের সূত্র জানায়, কৃষকের কাছ থেকে প্রতিমণ ধান এক হাজার ৪০ টাকায় ক্রয় করছে খাদ্য বিভাগ। জেলায় এবার নয় হাজার ১২০ মেট্রিক টন আমন সংগ্রহ করা হবে খুলনার নয়টি উপজেলা থেকে। গত ২০ নভেম্বর থেকে ধান সংগ্রহের নির্দেশনা থাকলেও ২৮ নভেম্বর রূপসায় আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে খুলনাতে আমন সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়। তবে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত খুলনাতে মাত্র ৭৩ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও মোঃ তানভীর রহমান। তিনি বলেন, রূপসা উপজেলার মধ্যদিয়ে খুলনাতে আমন সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। খুলনাতে ধান একটু দেরিতে উঠে, সে কারণে আমন সংগ্রহ একটু দেরি হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৭৩ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করা হয়েছে। ন্যায্য মূল্যে সরকারের কাছে ধান বিক্রয়ে কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। একজন কৃষক সর্বনিম্ন তিন বস্তা ও সর্বোচ্চ তিন মেট্রিক টন ধান বিক্রি করতে পারবেন।
অন্যদিকে, কৃষক বলছেন ভিন্ন কথা। উৎপাদন খরচ, শ্রম মূল্য মিটিয়ে বর্তমান বাজার মূল্যে ধান বিক্রি করলে কৃষকরা ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়ছে। সরকারি মূল্যে ধান বিক্রি করলে লোকসান কিছুটা কম হলেও মিলারদের কাছে দিলে চরম আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে কৃষক।
ডুমুরিয়ার থুকড়া এলাকা গাজী অটো রাইচ মিলস্’র স্বত্বাধিকারী মোঃ মোনায়েম গাজী বলেন, পুরাতন ইরি কৃষকের কাছ থেকে কিনতেছি ৭৫০ থেকে আটশ’ টাকায়। সরকারি সংগ্রহের পরে এবার আমন ধান বিক্রি হতে পারে সর্বোচ্চ ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায়।
ডুমুরিয়া বাজার, সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা ও যশোরের মণিরামপুরের একাধিক চাল ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, নতুন আমনের টেন-৩ ও স্বর্ণা জাতের ধান মণ প্রতি ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা দরে বিকিকিনি হচ্ছে।
কৃষকদের দেয়া তথ্যমতে, বর্তমানে প্রতি মণ ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ অন্তত ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা। অথচ এই ধান হাট-বাজারে মণ প্রতি বিক্রি হবে/হচ্ছে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায়। তার মানে প্রতি মণ ধানে কৃষককে লোকসান গুণতে হচ্ছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। এ হিসাবে প্রতি বিঘায় গড়ে ২৫ মণ ধান উৎপাদন হলে ধান চাষ করে লোকসান গুণতে হচ্ছে কমপক্ষে চার হাজার টাকা। এছাড়াও রয়েছে শ্রম মূল্য।
অভিযোগ রয়েছে, আমন কাটা ও মাড়াই শুরু হওয়ার পর মূলত চালকল মালিকরাই ধানের দাম নিয়ন্ত্রণ করে। বাজারে ধান ওঠার পর সিন্ডিকেট করে তারা অন্তত দুই সপ্তাহ কোনো ধান কেনেন না। এর ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বাজারে ধানের দাম পড়ে যায়। আর তখন ধান কিনে গুদামজাত করা হয় এবং ওই ধান দিয়ে সারাবছর চাল তৈরি করে বেশি দামে বিক্রি করে মিলাররা।
একাধিক কৃষক জানান, প্রতি বছর সরকারিভাবে ধান কেনা হলেও প্রকৃত কৃষকরা ফড়িয়া ও দালালদের কারসাজিতে ন্যায্য মূল্যে ধান বিক্রি করতে পারেন না। ফলে কৃষক উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়।
ডুমুরিয়ার মির্জাপুর এলাকার কৃষক গুরুপদ মন্ডল বলেন, ‘কৃষকের কষ্টে উৎপাদিত শস্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতকরণের ব্যাপারে সত্যিই কি কেউ ভাবেন? ধান ফলানো ছাড়া তো কোন উপায় নেই তাই বাধ্য হয়ে ফি (প্রতি) বছর লোকসান হলেও ধান চাষ করছি!’ এভাবে কৃষকের বুকের জমাটবাঁধা কষ্ট প্রকাশ করলেন গুরুপদ মন্ডল। সরেজমিনে একাধিক বাজারে দেখা গেছে, মোটা চাল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা এবং চিকন চাল প্রকার ভেদে ৪৫ থেকে ৫০টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খুলনা কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক পঙ্কজ কান্তি মজুমদার জানান, এবারও খুলনাতে আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। এখনো ধান কাটা চলমান, তাই উৎপাদনের পরিমাণ এখনি সঠিক বলতে পারছি না।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের মে মাসে ২৬ টাকা কেজি দরে সাড়ে তিন হাজার কৃষকের কাছ থেকে এক হাজার ৯১৩ মেট্রিক টন বোরো ধান সংগ্রহ করেছিল খাদ্য বিভাগ। অথচ খুলনাতে বোরো উৎপাদন হয় দুই লাখ ৬৬ হাজার ৯৮৭ মেট্রিক টন। লোকসানের মুখে পড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধান না কেটে ক্ষেতে অগ্নিসংযোগ করেছিল কৃষক।
উৎপাদিত ধান ও সংগ্রাহ পরিমাণের পার্থক্যই বলে দিচ্ছে কৃষকের লোকসানের সহজ অংক, বললেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সদস্য ফুলতলা মহিলা কলেজের প্রভাষক মোঃ জাহাঙ্গীর আলম।
এ অর্থনীতিবীদ বললেন, কৃষকের উৎপাদিত অতি সামান্য অংশই কিনছে সরকার। তাও ক’জন প্রান্তিক কৃষক সে সুযোগ পাচ্ছেন? সামান্য ধান ক্রয় করে কৃষকের উৎপাদন খরচ উঠানো যাবে না। বাজারে চালের উচ্চমূল্য; এদিকে কৃষক ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। সহজেই বোঝা যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের অতিমুনাফার সহজ অংক। মধ্যস্বত্তভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে খোলা বাজারে কৃষকের ধান্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, ধান-চাল ক্রয় মনিটরিং করতে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। টিমগুলো জেলার ধান-চাল সংগ্রহ ও বাজারদর মনিটরিং করছে। কোন অনিয়ম পেলে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।