বাংলাদেশ সরকারের অগ্রাধিকারমূলক মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতুর দশ নম্বর পিলারে আজ শুক্রবার সকালে একটি ফেরি ধাক্কা খেয়েছে। গত দু মাসে এ নিয়ে পঞ্চম বারের মতো সেতুর পিলারে ফেরির আঘাতের ঘটনা ঘটলো।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মোঃ শফিকুল ইসলাম বিবিসিকে বলেছেন, “ফেরির ধাক্কা সত্ত্বেও সেতুর স্থাপনা নিয়ে উদ্বেগের কোন কারণ নেই। এতে সেতুর ক্ষতির কোন সম্ভাবনাই নেই।”
মিস্টার ইসলাম কয়েকদিন আগে বলেছিলেন সেতু নির্মাণের আগেই এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করা হয়েছে এবং চার হাজার টনের নৌযান এসে ধাক্কা দিলেও সেতুর কোন ক্ষতি হবে না।
পদ্মা সেতু নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি জানিয়েছে, পদ্মা সেতু যান চলাচলের উপযোগী হতে ২০২২ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত লেগে যাবে।
অন্য সব আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করে আগামী বছরের জুন নাগাদ সেতু খুলে দেয়ার চিন্তা আছে সরকারের।
সেতুর ওপর এখন যান চলাচলের সড়ক নির্মাণের কাজ চলছে।
দু মাসে ৫ বার পিলারে ধাক্কা ফেরির, ওবায়দুল কাদের বলেছেন ষড়যন্ত্র এখনো শেষ হয়নি
আজ শুক্রবার সকাল সাতটার দিকে কাকলী নামক ফেরিটি সেতুর দশ নম্বর পিলারে আঘাত করে। মাদারীপুরের বাংলাবাজার থেকে সেতুটি মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটে যাচ্ছিলো।
এ ঘটনার পরপরই সেতু এলাকায় গেছেন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
সেখান থেকেই বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “সেতু সলিড একটি স্থাপনা। এতে সেতুর কোন ক্ষতি হবে না। তবে এ ধরণের ঘটনা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। এছাড়া ফেরিগুলোর অনেক ক্ষতি হচ্ছে। জানমালের নিরাপত্তার বিষয়টিও আছে। আজই এ নিয়ে করণীয় নির্ধারণ করতে বৈঠক হবে।”
এর আগে গত ৯ই অগাস্ট মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাট থেকে ছেড়ে আসা একটি ফেরি পদ্মা সেতুর দশ নাম্বার পিলারে আঘাত করেছিলো।
পরদিন সিদ্ধান্ত হয়েছিলো যে পদ্মা নদীতে স্রোতের তীব্রতা না কমে আসা পর্যন্ত মাওয়ায় নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর নিচ দিয়ে ভারি যানবাহনবাহী ফেরি চলাচল করতে পারবে না।
এর আগে গত মাসে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অন্য দুটি ফেরি, সেতুর ১৬ ও ১৭ নম্বর পিলারে আঘাত করেছিল। সবগুলো ঘটনাতেই ফেরির সংশ্লিষ্টদের চাকুরী থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্তের পর আটক করে তদন্ত করছে কর্তৃপক্ষ।
নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী তখন বলেছিলেন পদ্মা নদীতে এখন তীব্র স্রোত এবং সেতুর পিলার ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ কাজের স্থাপনার জন্য স্রোতের চরিত্রেও পরিবর্তন এসেছে।
“স্রোতের ঘুর্ণি পরিবর্তিত হচ্ছে। পদ্মা এমনিতেই আনপ্রেডিক্টেবল নদী। ফেরিগুলো টার্ন নিয়ে সেতুর পিলারের মাঝখান দিয়ে আসা দুরূহ হয়ে গেছে,” বলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, জুলাইয়ে সেতুর পিলারে আঘাতের ঘটনার পর ফেরির রুট পরিবর্তনের প্রস্তাব নাকচ করেছে সেতু কর্তৃপক্ষ।
কর্তৃপক্ষ আশা করছে আগামী এক বছরের মধ্যেই সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হবে এবং সে কারণে নতুন ফেরি রুট করলে তাতে অর্থের বিরাট অপচয় ঘটবে বলে মনে করছে তারা।
তবে সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বুধবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন পদ্মা সেতুর পিলারে বারবার ফেরির ধাক্কা চালকের অদক্ষতা, নাকি নাশকতা সেটি খতিয়ে দেখা হবে।
তিনি বলেন, “ফেরির ধাক্কা বারবার কেন? একবার নয়, দুবার নয়, চার-চারবার। অদক্ষতার জন্য চালককে শাস্তি দিলেন। চাকরীচ্যুত করলেন। চালকের অদক্ষতা, নাকি নাশকতা, তা খতিয়ে দেখতে হবে। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই বারবার এ ঘটনা কেন ঘটবে? আমাদের বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। এই প্রকল্প নিয়ে ষড়যন্ত্র ছিল, তা এখনো শেষ হয়নি”।
সংরক্ষিত এলাকা থেকে ভারতীয় নাগরিক আটক
পদ্মা সেতুর কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড এলাকা থেকে গত দেড় বছরে বিভিন্ন সময়ে অন্তত এগারজন ভারতীয়কে আটক করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে নিয়মিত টহলরত সেনা সদস্যরা।
গত জুনে রূপসা রায় ও বিজয় কুমার রায় নামে দুজন ভারতীয় নাগরিককে সেতুর সংরক্ষিত এলাকা থেকে সেনা সদস্যরা আটক করে।
কিন্তু এসব ভারতীয়রা পদ্মা সেতু এলাকায় কেন এসেছিলো বা কি করছিলো সে সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন জাজিরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান।
জাজিরা থানা পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেও তাদের কাছ থেকে কোন তথ্য উদ্ধার করতে পারেনি।
জাজিরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলছেন আটককৃতদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
“তাদের এখানে কারণ সম্পর্কে তথ্য এখনো পাইনি। তবে বিচার চলছে। তারা কারাগারে আছে,” মিস্টার রহমান বলছিলেন।
জানা গেছে সর্বশেষ গত ২৫শে জুন জাজিরার নাওডোবা এলাকা থেকে রূপসা রায় নামে এক ব্যক্তিকে আটকের পর জানা যায় তিনি গুজরাটের অধিবাসী।
তার দুদিন আগে আটক হওয়া বিজয় কুমার রায়ের বাড়ি ভারতের বিহারে। তাদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ ও সেতু নির্মাণের সাথে জড়িত কর্মকর্তারা বলছেন ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথম একজন ভারতীয় আটক হয়েছিলো। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিহার থেকে আসা টুনা রায়, ওড়িশার বীরু মণ্ডল, বিহারের সোনু সিংসহ মোট এগার জনকে আটক করা হয়েছে।
এদের অনেকেই উদ্দেশ্যহীন ঘোরাফেরার সময় সেনা সদস্যরা আটক করেছে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছে।
তবে সেতুর প্রকল্প পরিচালক বলছেন এসব বিষয়ে নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই কারণ তারা মনে করে সেতু এলাকায় নিরাপত্তার জন্য কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে।
তিনি বলেন, “বিদেশি নাগরিক আটকের বিষয়টি নিরাপত্তা ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেখছে। তবে এটি ঠিক যে আমাদের মূল চিন্তা হলো সেতু স্থাপনার নিরাপত্তা। সরকারের উচ্চপর্যায়েও বিষয়টি নিয়ে কথা হচ্ছে”।
পদ্মা সেতু নিয়ে কিছু তথ্য
* পদ্মা সেতুতে গাড়ির লেন থাকবে একেক পাশে দুটো করে এবং একটি ব্রেকডাউন লেন। অর্থাৎ মোট ছয় লেনের ব্রিজ হচ্ছে, যদিও একে বলা হচ্ছে ফোর লেনের ব্রিজ।
* পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য (পানির অংশের) ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। তবে ডাঙার অংশ ধরলে সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য প্রায় নয় কিলোমিটার।
* দ্বিতল পদ্মা সেতুর এক অংশ থাকবে মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায়, আরেক অংশ শরীয়তপুরের জাজিরায়।
* সেতুর ওপরে গাড়ি চলাচল করবে, রেল চলবে নিচের অংশে।
* পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ করা হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। গত বছরের ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এসব খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি।