পাইকগাছা : খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি ইউপির বিরাশি গ্রামের বছর তিনেক আগে ভাগ্য বদলের আশায় বাড়ি ছাড়েন ওয়াহিদুজ্জামান লিটন (৩০)। পাইকগাছা থেকে রাজধানীতে এসে কাজ নিয়েছিলেন পোশাক কারখানায়। করোনা মহামারিতে কাজ হারিয়ে গত মার্চে ফিরে আসতে হয়েছিল গ্রামে। তুমুল ব্যস্ততার নগরীতে না ফিরে সিদ্ধান্ত নিলেন বাবার পেশা অর্থাৎ কৃষিকাজ করেই ভাগ্য ফেরাবেন তিনি। তবে চেয়েছিলেন গতানুগতিক ফসল না ফলিয়ে ব্যতিক্রমী কোনো আবাদ করতে। বিভিন্নজনের সঙ্গে পরামর্শ করে ফরিদপুরের কৃষি উদ্যোক্তা মামুনুর রহমান রাজের পরামর্শে সিদ্ধান্ত নিলেন ইতালিয়ান সবজি স্কোয়াশ চাষের।
পরামর্শের জন্য পাইকগাছা উপজেলা কৃষি অধিদফতরের স্মরণাপন্ন হন তিনি। তাকে পূর্ণ সহযোগিতা করেন অধিদফতরের সংশ্লিষ্টরা। উপজেলার কপিলমুনি ইউনিয়নের বিরাশি গ্রামের আদর্শ কৃষক বিল্লাল হোসেনের দুই ছেলের মধ্যে বড় তিনি।প্রথম মৌসুমেই সাফল্য পেয়েছেন লিটন। তার অভাবনীয় সাফল্যের পর সুন্দরবন উপকূলীয় লবণাক্ত পানির জনপদে ‘সবুজ স্কোয়াশ বিপ্লবের’ স্বপ্ন দেখছে স্থানীয় কৃষি অধিদফতর।পাইকগাছা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সহায়তায় জৈব কৃষি ও জৈবিক বালাই ব্যবস্থাপনায় প্রদর্শনী খামার হিসেবে উপজেলার বিরাশি গ্রামে গড়ে উঠেছে স্কোয়াশের আকর্ষণীয় খামারটি। সপ্তাহ দুয়েক আগে থেকে খুলনার বিভিন্ন এলাকার বাজারে উঠতে শুরু করেছে দেশের ভোক্তাদের কাছে অপরিচিত সুস্বাদু সবজি স্কোয়াশ।খুলনা জেলার একমাত্র কৃষক হিসেবে মাত্র ১ বিঘা জমিতে এই সবজিটির চাষ করে ২ লক্ষাধিক টাকা আয়ের স্বপ্ন দেখছেন লিটন।
লিটন জানান, মাত্র ১ বিঘা জমি লিজ নিয়ে কৃষি অফিসের সহযোগিতায় স্কোয়াশের উন্নত জাতের ‘রেলি এফ-১’ বীজ সংগ্রহ করে গড়ে তোলেন আবাদ। গত ৯ নভেম্বর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম, উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা শেখ তোফায়েল আহম্মেদ তুহিন ও আবুল কালামের উপস্থিতিতে বীজ বপন করা হয়।সংশ্লিষ্ট এলাকার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা শেখ তোফায়েল আহম্মেদ তুহিন জানান, স্কোয়াশের জীবনকাল ৭৫ থেকে ৮০ দিন। এটি মূলত একটি শীতকালীন সবজি। বেলে দোআঁশ মাটিতে নভেম্বরের প্রথম থেকে দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে এর বীজ বপন করতে হয়। বপনের ৫০ দিনে এর থেকে ফল সংগ্রহ করা যায়। লিটনের ক্ষেতের ১ বিঘা জমিতে ১ হাজার ৬ শ টি গাছ রয়েছে। প্রতিটি গাছ থেকে গড়ে ১০-১৫ টি ফল পাওয়া যায়। প্রতিটি ফলের ওজন দেড় থেকে ২ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। সবুজ ও লম্বাকৃতির হালকা সাদা রংয়ের প্রতিটি স্কোয়াশে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন এ, সি, ই, কে-সহ কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিন রয়েছে। লাউ ও মিষ্টি কুমড়ার বিকল্প হিসেবে রান্না করে খাওয়া যায় সুস্বাদু এই সবজিটি।
তিনি আরও জানান, স্কোয়াশের পাতা ও কাণ্ড সবজি হিসেবে খাওয়া যায়। তবে লাউয়ের মতো লম্বা হয় না। এর উচ্চতা এক থেকে দেড় ফুট হয়। প্রতি বিঘা (৩৩ শতক) জমিতে স্কোয়াশ চাষে জমি প্রস্তুতে ১২-১৪ হাজার টাকা বাদে খরচ হয় ৩৪-৩৫ হাজার টাকা। ‘বারি স্কোয়াশ-১’ জাতটি অবমুক্ত করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট।লিটন জানান, প্রায় দু সপ্তাহ আগে থেকে তার উৎপাদিত স্কোয়াশ বাজারে আসতে শুরু করেছে। প্রথমে স্থানীয় আগড়ঘাটা, গদাইপুর, পাইকগাছা ও সর্বশেষ দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম বৃহত্তম পাইকারী মোকাম আঠারো মাইলে স্কোয়াশ বাজারজাত করা হয়েছ। অপরিচিত হওয়ায় শুরুতে স্কোয়াশের চাহিদা কম থাকলেও মাত্র দু সপ্তাহের ব্যবধানে স্থানীয় বাজারগুলোতে এর চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ।তিনি জানান, সোমবার (৪ জানুয়ারি) আঠারো মাইল বাজারে পৌঁছানো মাত্রই বিক্রি হয়ে যায় তার স্কোয়াশের চালান।
মোকাম থেকে পাইকারি কিনে স্থানীয় সবজির দোকানে খুচরা বিক্রি করেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। একবার যারা স্কোয়াশ খেয়েছেন তারা আবার খুঁজতে থাকায় রাতারাতি এর চাহিদা বেড়েছে বাজারে। বাজারে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত।এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, পরীক্ষামূলকভাবে পাইকগাছার বিরাশি এলাকায় ১ বিঘা জমিতে স্কোয়াশের আবাদ হয়েছে। কৃষি বিভাগের পক্ষে বিভিন্ন উপকরণ সরবরাহের পাশাপাশি নিয়মিত মনিটরিং এবং ফিডব্যাক নেয়া হচ্ছে। আগামীতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় এই সবজির আবাদ বাড়তে পারে বলে ধারণা তার।সুন্দরবন উপকূলীয় লবণাক্ত পানির জনপদে অনুকূল পরিবেশে তরমুজের পর স্কোয়াশের ওপর ভর করে এগিয়ে যাবে আধুনিক কৃষি। কৃষকের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও এমনটাই আশা।