পাইকগাছায় পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়েছে ভেনামি চিংড়ির চাষ। ধ্বংসের মুখে থাকা সম্ভাবনাময় চিংড়ি শিল্পকে টেকাতে ভেনামি চাষের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। চিংড়ি শিল্প সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সফল ভেনামির পরীক্ষামুলক আবাদে প্রান্তিক পর্যায়ে শুরু হবে এর বানিজ্যিক আবাদ। আর এমনটি হলে প্রান্তিক পর্যায়ের ব্যাপকভিত্তিক আবাদে চিংড়ীশিল্প ফিরে পাবে তার হারানো যৌবণ। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, নানা সংকটে ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে দেশীয় বাগদা ও গলদা চিংড়ির উৎপাদন। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ি রফতানিতে সুবিধা করতে পারছে না বাংলাদেশ। পক্ষান্তরে চিংড়ির আর্ন্জাতিক বাজার চলে যাচ্ছে ভেনামি চাষকারী চীন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের দখলে। এমন পরিস্থিতিতে ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন গত ১২ বছর ধরে সরকারের সাথে আলোচনা চালিয়ে আসছিল। অবশেষে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উচ্চ ফলনশীল ভেনামি জাতের চিংড়ির পরীক্ষামূলক চাষের অনুমতি দেয়া হয় কক্সবাজারের অ্যাগ্রি বিজনেস এবং সাতক্ষীরার এনজিও সুশীলনকে। ইতোমধ্যে কক্সবাজারের অ্যাগ্রি বিজনেস ব্যর্থ হয়েছে। আর সুশীলন প্রকল্প বাস্তবায়নে সাথে নেয় যশোর বিসিক শিল্পনগরীর এম ইউ সি ফুডসকে। ৩১ মার্চ থাইল্যান্ড থেকে তারা বিমানযোগে ভেনামি চিংড়ির আট লাখ আমদানি করে খুলনার পাইকগাছা উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস্য অধিদফতর ও মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীনস্থ লোনা পানি কেন্দ্রের চারটি পুকুরে অবমুক্ত করা হয। পুকুরে পোনা অবমুক্তির পর থেকে নিয়মিত পরিচর্যা ও পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছেন চিংড়ি বিশেষজ্ঞ ফিস ইন্সপেকশন ও কোয়ালিটি কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত উপপরিচালক প্রফুল্ল সরকার।
তিনি জানান, প্রতি সপ্তাহে চিংড়ির গ্রোথ এবং রোগবালাই অনুসন্ধানে নমুনা পরীক্ষা করা হয়। চলতি বছর এপ্রিল-মে মাসে তাপমাত্রা বেশি থাকায় সফলতা নিয়ে কিছুটা শঙ্কা থাকলেও নিয়মিত পর্যবেক্ষণে মনে করা হচ্ছে, ভেনামির রোগ প্রতিরোধ এবং জীবন ধারণ ক্ষমতা বাগদার তুলনায় বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, পোনা ছাড়ার পর থেকে সাত সপ্তাহ পর্যন্ত চিংড়িতে রোগবালাই সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এ বিপজ্জনক সময় অতিক্রমের পর গত ৬ জুন পুকুরের পরিবেশ, ভাইরাসসহ অন্যান্য রোগবালাই প্রতিরোধব্যবস্থা পরিদর্শন এবং চিংড়ির ফিজিক্যাল গ্রোথ পরিমাপে নমুনা পরীক্ষা করে একটি বিষেশজ্ঞ টিম। পরিদর্শন টিমে ছিলেন, খুলনা ফিস ইন্সপেকশন ও কোয়ালিটি কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি ডিরেক্টর মজিনুর রহমান, বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন কবীর, পরিচালক এম এ হাসান পান্না, বাংলাদেশে ভেনামি চিংড়ি চাষের সম্ভাব্যতা যাচাই কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট শেখ রফিকুজ্জামান, এম ইউ সি ফুডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল দাসসহ ফিস ইন্সপেকশন ও কোয়ালিটি কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তারা। পরিদর্শনকালে প্রকল্পের ডিডি মজিনুর রহমান বলেন, ভেনামির পোনা ছাড়ার পরের ৬৮ দিনে গ্রোথ ও ফার্টিলিটি রেট খুবই আশাব্যঞ্জক। প্রতিটির ওজন ৮ গ্রাম থেকে সর্বোচ্চ ২৫ গ্রাম পর্যন্ত হয়েছে। গড় ওজন পাওয়া গেছে ৮.৭৫ গ্রাম। ভেনামি চিংড়ির উৎপাদনকাল ১২০ দিন। প্রথম ৬০ দিনে এদের যে গ্রোথ হয়, পরবর্তী ৬০ দিনে তার তিন গুণেরও বেশি হয়। সে হিসেবে আশা করা যায় চিংড়ি ধরবার সময় প্রতিটির গড় ওজন পাওয়া যাবে ২৫ গ্রাম। বিশ্ববাজারে গলদা ও বাগদার অব্যাহত দরপতনসহ নানা সংকটে লোকসানের মুখে রয়েছেন চাষিরা।
এর ফলে রফতানি আয় হ্রাসের পাশাপাশি কর্ম সংস্থান কমছে আশংকাজনকহারে। ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন কবীর বলেন, কাঁচামাল হিসেবে চিংড়ির অভাবে মাছ কোম্পানিগুলো বন্ধের উপক্রম হয়েছে। দেশে উৎপাদিত চিংড়িতে যে কয়টি কোম্পানি চালু আছে সেগুলোর সক্ষমতা ও ধারণ ক্ষমতার মাত্র ১৮-২০ শতাংশ চাহিদা মিটছে। ফলে প্রক্রিয়াজাতকরণ খরচও বেশি হচ্ছে। এসময় আশার কথা শুনিয়ে তিনি বলেন, প্রতি হেক্টরে যেখানে বাগদার উৎপাদন পাওয়া যায়, ৩৫০ থেকে ৪০০ কেজি। সখানে ভেনামির উৎপাদন সাত থেকে আট হাজার কেজি পর্যন্ত সম্ভব। বাগদা কয়েকবার চাষ হলেও গলদার চাষ হয় বছরে একবার। কিন্তু ভেনামি চাষ করা যায় বছরে তিনবার। ফ্রোজেন ফুডস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক এবং বাংলাদেশে নিবিড়-আধা নিবিড় বাগদা চিংড়ি চাষের প্রবর্তক এম এ হাসান পান্না জানান, ভেনামি চিংড়ি চাষ ব্যাপকভাবে করতে হলে দেশেই ভেনামির এসপিএফ পোনা উৎপাদনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে প্রান্তিক চাষি পর্যায়ে ব্যাপকভাবে ভেনামি চাষ বিস্তার লাভ সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে তারা দেশবাংলা হ্যাচারিতে সিপি থাইল্যান্ডের সহায়তায় ভেনামি পোনা উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছেন বলেও জানান তিনি। ফাও এবং গ্লোবাল অ্যাকুয়াকালচার অ্যালায়েন্সের পরিসংখ্যান মতে, ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাপী মোট ৪৪ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে ভেনামি ছিল প্রায় ৩৪ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন, যা মোট উৎপাদনের ৭৭ শতাংশ। ভেনামি চিংড়ি উৎপাদনের হার ক্রমাগত সবখানে বাড়লেও বাংলাদেশের অবস্থান ছিল শূণ্যের কোঠায়।
এ বিষয়ে দেশের প্রথম ভেনামি চিংড়ি চাষের উদ্যোক্তা এম ইউ সি ফুডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল দাস জানান, চিংড়ির বিশ্ববাজার রয়েছে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের। যার ৮০ ভাগই দখল করে নিয়েছে অন্যরা। যেখানে আমরা পিছিয়ে রয়েছি। বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে আমাদের ভেনামি চাষের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) পাইকগাছা লোনা পানি কেন্দ্রের পাইলটিং প্রজেক্টের চারটি পুকুরে আগামী ১৫-২০ জুলাই নাগাদ আহরণ করা হবে পরীক্ষামূলক চাষের ভেনামি চিংড়ি। এম ইউ সি ফুড গত ১ জুন ভেনামি রফতানি শুরু করার অনুমতি চেয়ে এফআইকিউসি খুলনার ডেপুটি ডিরেক্টর বরাবর আবেদন করেছে। সে আবেদন মোতাবেক তারা ১৫ থেকে ২০ টন চিংড়ি পাবে বলেও জানানো হয়। সর্বশেষ এমন পরিস্থিতিতে আশা করা হচ্ছে, ভেনামি চাষ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পাশাপাশি বাড়বে কর্মসংস্থানও। বিপর্যয়ের মুখে থাকা চিংড়ি শিল্প ফিরে পাবে তার হারানো যৌবন