>> পেঁয়াজ-রসুনের ভরা মৌসুম চলছে
>> পেঁয়াজের দাম ৩০ টাকার বেশি রাখতে চায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়
>> শ্যামবাজারে পেঁয়াজ কেনার মানুষ নেই : আমদানিকারক
বিশ্বের মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমলেও ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশে। প্রতিবছরই সিয়াম সাধনার মাসটিতে দেশের বাজারে অন্যান্য নিত্যপণ্যের পাশাপাশি বাড়ে পেঁয়াজ, রসুন ও আদার দাম। এবারও আসন্ন রমজানে এসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে- এমন আশঙ্কায় রয়েছেন সাধারণ ক্রেতারা।
তবে ক্রেতাদের এমন আশঙ্কায় স্বস্তির বাতাস দিচ্ছেন শ্যামবাজারের আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, এবার রোজা ভরা মৌসুমে। তাই পেঁয়াজ-রসুন-আদার দাম বাড়ার কোনো সম্ভবনা নেই।
পাইকারি বাজারে এমন পরিস্থিতি হয়েছে যে, পেঁয়াজ নেওয়ার মানুষ নেই। আমাদের হিসাব অনুযায়ী, রমজান ও কোরবানির ঈদে কোনো সমস্যা হবে না। সমস্যা হবে আগস্টে মো. হাফিজুর রহমান, পেঁয়াজ আমদানিকারক একই সুরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও বলছে, পেঁয়াজের সরকার নির্ধারিত দাম ধরে রাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত পেঁয়াজ মজুত আছে। একইসঙ্গে আগামী ২০ মার্চ থেকে দেশের চাষিরা পেঁয়াজ তোলা শুরু করবেন। ফলে পেঁয়াজের দাম কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
শ্যামবাজারের পেঁয়াজ আমদানিকারক মো. হাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বর্তমানে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে না, কমে গেছে। শ্যামবাজারে পেঁয়াজ কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৩১ থেকে ৩২ টাকায়। এ পাইকারি বাজারে এমন পরিস্থিতি হয়েছে যে, পেঁয়াজ নেওয়ার মানুষ নেই।’
পেঁয়াজের মজুত বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত মজুত নেই। কিন্তু দেশি পেঁয়াজ ওঠা শুরু হয়েছে, ফলে এবার পেঁয়াজের ঘাটতি থাকবে না। আমাদের হিসাব অনুযায়ী, রমজান ও কোরবানির ঈদে কোনো সমস্যা হবে না। সমস্যা হবে আগস্টে। পেঁয়াজের দাম বাড়ে মূলত ইন্ডিয়ান কন্ট্রোল মাইর (ভারত রফতানি বন্ধ করলে) গেলে। আর এটা হবে আগস্ট মাসে। এর আগে তেমন কোনো সমস্যা হবে না। দেশে এখন পর্যাপ্ত ভারতীয় পেঁয়াজ রয়েছে। মাঝে ভারতের পেঁয়াজ না আসায় দাম বেড়েছিল।’
এ আমদানিকারক বলেন, ‘গত সপ্তাহে দুই-তিন দিনের জন্য বাজার (পেঁয়াজের দাম) বেড়েছিল। গত দুদিনে আবার কমে গেছে। গত রমজানেও কিন্তু পেঁয়াজের কোনো সমস্যা ছিল না। যা হইছে সেটা রমজানের পর। এর বাইরে আদা, রসুনের দামও তুলনামূলক অনেক কম। দেশি রসুন ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে শ্যামবাজারে। অন্যদিকে, আদাও ৪২ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শ্যামবাজার সব জিনিসের দাম কম, কোনো জিনিসের দামই বেশি নয়।’
শ্যামবাজার পেঁয়াজ, রসুন সমিতির প্রচার সম্পাদক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘মার্চে গ্রাম থেকে পেঁয়াজ শহরে আসে। এখন পেঁয়াজের ভরা মৌসুম। আগামী দেড় মাস জমি থেকে পেঁয়াজ উঠে শহরে আমদানি হবে। অন্যান্যবারের চেয়ে এবার পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলনও হয়েছে। সুতরাং যখন রোজা শুরু হবে, তখন দেশে পেঁয়াজের ভরা মৌসুম থাকবে। এছাড়া প্রতিদিন চারটি স্থলবন্দর দিয়ে ৩০-৩৫টি ট্রাকে করে ভারতীয় পেঁয়াজ দেশে ঢুকছে। গত ১০-১২ দিন ধরে এ কার্যক্রম চলছে। একদিকে ভারত রফতানি করছে, অন্যদিকে দেশি পেঁয়াজে বাজারগুলো সয়লাব হবে।’
কয়েকদিন আগেও পেঁয়াজের দাম বেড়েছিল, কিন্তু কেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানকার মুড়িকাটা জাতের পেঁয়াজের শেষ সময় ছিল এবং ভারতীয় পেঁয়াজও কয়েকদিন আমদানি বন্ধ ছিল। ফলে গত সপ্তাহে পেঁয়াজের দাম বেড়েছিল। কিন্তু এখন বাজারে ২৫-৩০ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। দাম আরও কমতে পারে।’
আদার দামের বিষয়ে শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘গত ৭৫ দিন ধরে আমাদের পাইকারি বাজারে আদা বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে। এই ৭৫ দিনই ভারতের কেরালা থেকে বাংলাদেশে আদা আসছে। ফলে গত আড়াই মাসে আদার দাম বাড়েওনি কমেওনি। এর মধ্যেই আবার চায়না আদা আসতে শুরু করেছে। বাজারে চায়না আদা আসায় এর দাম কেজিপ্রতি দুই-এক টাকা কমছে। সুতরাং আদার দামও বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।’
রসুন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ছয় জেলায় রসুন উৎপাদন হয়। সারাদেশ থেকে রসুন আসছে। এ নিত্যপণ্যেরও এখন ভরা মৌসুম। বর্তমানে পাইকারি বাজারে ২৮ টাকা থেকে ৩৫ টাকা দরে সুপার কোয়ালিটির রসুন বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রচুর পরিমাণে রসুন আমদানি হচ্ছে। সুতরাং ভরা মৌসুমে রসুনের দামও বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। রমজান ও ঈদ পর্যন্ত আদা, রসুন ও পেঁয়াজের দাম বাড়বে না।’
রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত সপ্তাহের তুলনায় এই সপ্তাহে পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমলেও অপরিবর্তিত রয়েছে আদা ও রসুনের দাম। গত সপ্তাহে পেঁয়াজের কেজি ৫০ টাকা দরে বিক্রি হলেও এ সপ্তাহে ৫ থেকে ১০ টাকা কমে তা দাঁড়িয়েছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়।
আদা গত সপ্তাহের মতো গতকালও (সোমবার) বিক্রি হয়েছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে। একইভাবে অপরিবর্তিত রয়েছে রসুনের দাম। দেশি রসুন ৬০ টাকা দরে বিক্রি হলেও চায়না রসুন বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা করে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য (আইআইটি) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘রমজানকে সামনে রেখে আমরা পেঁয়াজসহ আরও ছয়টি আইটেম নিয়ে ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) মাধ্যমে ব্যাপকভাবে মাঠে নামছি। টিসিবির মাধ্যমে ব্যাপক অপারেশন করেছি বলেই আজকে পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে।’
এবার রোজায় কোনো সংকট হবে না। কারণ চলতি মাসের ২০ তারিখের পর থেকে বড় পেঁয়াজটা বাজারে আসছে। রমজানে আমাদের চ্যালেঞ্জ হবে দামটা ৩০ টাকার উপরে রাখা।
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান, অতিরিক্ত সচিব, আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য অনুবিভাগ
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকদিন দেশে পেঁয়াজ লাগে ছয় হাজার টন; ৬০০ ট্রাক। যেখানে দিনে ৬০০ ট্রাক পেঁয়াজ লাগে, সেখানে ভারত থেকে আসছে মাত্র ৩০ থেকে ৩৫টি ট্রাক। তাহলে তো পেঁয়াজের দাম বাড়বেই। এছাড়া কয়েক দিনের মধ্যে রাখি জাতের পেঁয়াজ (দেশে উৎপাদিত) বাজারে আসা শুরু করবে। সুতরাং সপ্তাহখানেক একটু সমস্যা হবে এটাই স্বাভাবিক। রাখি পেঁয়াজটা নেমে গেলে ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় পেঁয়াজ পাওয়া যাবে।’
সফিকুজ্জামান বলেন, ‘রমজান মাসে তিন থেকে সোয়া তিন লাখ টন পেঁয়াজ লাগে। রমজানে এবার কোনো ক্রাইসিস (সংকট) হবে না। কারণ চলতি মাসের ২০ তারিখের পর থেকে বড় পেঁয়াজটা বাজারে আসছে। রমজানে আমাদের চ্যালেঞ্জ হবে দামটা বাড়তি রাখা। ৩০ টাকার উপরে দামটা রাখাই এখন আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ। এই বছর আমরা কোনো গ্রুপকে দিয়ে পেঁয়াজ আমদানি করাব না। সরাসরি টিসিবি নিজেই এবার পেঁয়াজ আমদানি করবে। আগামী বছর তেল থেকে শুরু করে যা যা আমদানি করার জিনিস আছে, সেগুলো টিসিবিই করবে। আমরা আর কারও ওপর নির্ভরশীল থাকব না। ইতোমধ্যেই দেড় লাখ টন পেঁয়াজ টিসিবির মাধ্যমে আনা হয়েছে।’
আদা-রসুন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রসুন তো খুচরা বাজারে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। চাইনিজ রসুন আমদানি করা হয়েছে। রসুনের পাশাপাশি আদাও পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে। চাহিদার বেশিরভাগ আদাই আমদানি করা হচ্ছে।’
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন ও সাবেক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মফিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পেঁয়াজ ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের সঙ্গে সভা করেছি। তারা আশ্বস্ত করেছে এবার পেঁয়াজ, আদা ও রসুন নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। এরপরও বাজার থেকে তথ্য সংগ্রহ করা শুরু করেছি। প্রতিযোগিতা পরিপন্থি কোনো কিছু হলেই আমরা ব্যবস্থা নেব।’